বাংলা সিনেমার একটি জনপ্রিয় গান আছে ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে/আরে লাল লাল নীল নীল বাত্তি দেইখ্যা নয়ন জুড়াইছে/ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে...।’ গত শতকের আটের দশকে ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার এই গানটি একসময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। পরিতাপের বিষয়, এই ঢাকা শহরই বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
চলতি বছরে ১৪০টি দেশ নিয়ে এই তালিকা তৈরি করেছে লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। এই তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ‘বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহরগুলোর’ মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালের তালিকা অনুসারে বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে ছিল ঢাকা।
কয়েক বছর ধরে বাসযোগ্যতার বিবেচনায় ঢাকার অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে রয়েছে। এর চেয়ে খারাপ অবস্থা সিরিয়ার দামেস্ক এবং নাইজেরিয়ার লাগোসের। স্বাস্থ্যসেবা-সংস্কৃতি, পরিবেশ-শিক্ষা ও অবকাঠামো কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রেখে এ তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে।
নতুন এ জরিপ অনুসারে ২০২১ সালে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জাপানের ওসাকা। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অনুসারে, বসবাসযোগ্য শীর্ষ ১০ শহরের মধ্যে নিউজিল্যান্ডের দুটি, জাপানের দুটি, অস্ট্রেলিয়ার চারটি ও সুইজারল্যান্ডের দুটি রয়েছে।
উল্লেখ্য, করোনার মোকাবিলায় কোন দেশ কেমন পদক্ষেপ নিয়েছে, এর প্রভাব পড়েছে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায়। করোনা মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে এবার নন্দিত হয়েছে নিউজিল্যান্ড।
ইআইইউর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে নিউজিল্যান্ড কঠোর লকডাউন আরোপ করেছিল। এর ফলে দেশটির অকল্যান্ড, ওয়েলিংটনসহ বিভিন্ন শহরের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়েছে। এসব শহরের মানুষ করোনা-পূর্ববর্তী জীবনে ফিরে যেতে পেরেছে।
যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা, যানবাহন সংকট, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, মশার উপদ্রব, ভয়াবহ যানজট, পয়োনিষ্কাশনের করুণ অবস্থা, জলাবদ্ধতা, রাস্তাঘাটের করুণ দশা, ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি প্রভৃতি সমস্যায় ঢাকা নগরী বিপর্যস্ত। এ অবস্থায় ঢাকা নগরীতে জীবনযাপন যে সত্যিই ঝুঁকিপূর্ণ তা কারো অজানা নয়। এই ময়লা-আবর্জনার পাশাপাশি ভয়াবহ বায়ু ও শব্দদূষণের কারণে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে আমাদের প্রিয় নগরী। এখানে বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের বদলে আমরা নিচ্ছি কার্বন ডাই-অক্সাইডের বিষ।
সহনীয় মাত্রার চেয়ে ছয় গুণ বেশি সিসাসহ বিভিন্ন দূষিত পদার্থ মিশে আছে ঢাকার বাতাসে। দূষণে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে মানুষ। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দূষণমুক্ত নয়। বিষাক্ত বর্জ্যে ভরা এসব নদী থেকেও দূষণ ছড়াচ্ছে।
একদিকে ঢাকায় বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষের নিজস্ব কোনো বাড়ি নেই, অপরদিকে পুরান ঢাকায় মানুষের বাস জরাজীর্ণ ভবনে। সব মিলিয়ে ঢাকার বাসিন্দারা ভালো নেই।
পৃথিবীতে রাজপথকে দেখা হয় শহরের জীবননালি হিসেবে। মোটামুটি সচ্ছল দেশেও সেই জীবননালিকে সুন্দর, সবুজ ও গতিশীল রাখা হয়। একসময়কার কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর বা দিল্লির থেকেও ঢাকা সুন্দর ও স্বচ্ছন্দ ছিল। কিন্তু তা আজ কেবলই ইতিহাস।
ঢাকা বিশ্বের ঘনবসতিতম শহর, ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেশি, ঢাকা ভূমিকম্প-ভবনধস, অগ্নিকাণ্ড-জলাবদ্ধতার মতো প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের লীলাভূমি হওয়ার সঙ্গে এ শহরের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতারও যোগাযোগ আছে। ঢাকার পানির স্তর যত নেমে যাচ্ছে, ততই এই শহর পরিত্যক্ত হওয়ার দিকে গড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্পদের অভাব নয়, সম্পদের ভুল ও স্বার্থতাড়িত ব্যবহারই ঢাকার দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী।
ঢাকা শহরে সবচেয়ে বড় আপদের নাম জ্যাম। রাস্তায় বের হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে বসে থাকতে হয়। এখানে সিএনজিচালিত অটোরিকশা আছে, যা কখনও মিটারে চলে না। নিজেদের ইচ্ছে ও পছন্দমতো গন্তব্য ছাড়া যায় না।
অ্যাপভিত্তিক যেসব পরিবহন আছে, সেগুলো পেতেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। এখানে হাঁটার মতো ফুটপাত নেই। ফুটপাত সব হকার ও ছোট ব্যবসায়ীদের দখলে। ফুটপাত দিয়ে সাইকেল মোটরসাইকেলও দেদার চলাচল করে। হেঁটে চলাটাও এখানে অনেক বিপজ্জনক।
গণপরিবহনে কোনো শৃঙ্খলা নেই। ভাড়া নিয়ে কোনো নিয়মনীতি নেই। যাত্রী তোলা নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকে চালকদের মধ্যে, দক্ষ চালকও নেই। রাস্তায় অনেক বেশি যানবাহন থাকার কারণে সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে বার বার আলোচনা এমনকি বড় ধরনের একটি আন্দোলন হওয়ার পরও এ খাতটিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
ঢাকা শহরে ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মানুষ বসবাস করেন। ফলে নাগরিক সুযোগসুবিধা অপ্রতুল। অনেক এলাকায় সকাল-বিকাল গ্যাস থাকে না বললেই চলে। সেই সঙ্গে নিয়মিত পানি সরবরাহ পাওয়া যায় না।
সারা বছর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সংস্থার নামে উন্নয়ন কাজ চলে। ফলে রাস্তা কাটাকাটি-খোঁড়াখুঁড়িও নিয়মিত দৃশ্য। একেকবার একেক কর্র্তৃপক্ষ এসে রাস্তা কাটে, কখনও বিদ্যুতের জন্য কাটা হচ্ছে, কখনও গ্যাস আবার কখনও ওয়াসা। অর্থাৎ একেকজন একেক সময় রাস্তা কাটে আর মানুষজন চরম দুর্ভোগ পোহায়। কোনো সমন্বয় নেই, পরিকল্পনা নেই, নেই কোনো প্রতিকারও।
ঢাকা শহর থেকে গাছপালা বা সবুজ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। পার্ক-খেলার মাঠ, নদী-খাল বেদখল হয়ে যাচ্ছে। যা দু-চারটা পার্ক আছে তাও ব্যবহার উপযোগী নয়। স্ট্রিট লাইটগুলো ঠিকমতো জ্বলে না। পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট নেই, যেগুলো আছে সেগুলো ব্যবহারোপযোগী নয়।
খেলার মাঠগুলো রাজনৈতিক দলের লোকেরা দখল করে নিচ্ছেন। এদিকে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সহায়-সম্বলহীন দরিদ্র মানুষের ঢাকামুখী স্রোত। কাজের অভাব, জলবায়ুর প্রভাব যেমন ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন এবং কর্মসংস্থানের সন্ধানে মানুষ প্রতিনিয়তই ঢাকামুখী হচ্ছে। এই বাড়তি মানুষের চাপ সামলানোর কোনো উদ্যোগ নেই। এদের গ্রামে পুনর্বাসনেরও কোনো পরিকল্পনা নেই।
ঢাকা শহরে রাস্তাঘাট, ভবন নির্মাণ, যানজট, গণপরিবহন, এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো দেখার জন্য আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কোনো সমন্বয় নেই, নেই তাদের কোনো জবাবদিহি।
আর শুধু প্রশাসনিক দিক থেকেই নয়, এখানকার বাসিন্দাদের মনমানসিকতা, সচেতনতা ইত্যাদি বিবেচনা করলেও ঢাকা শহর ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। এখানকার নাগরিকরা যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে। রাস্তায় রং সাইডে গাড়ি চালায়। ট্রাফিক আইন মানে না। নিজে কোনো দায়িত্ব পালন না করে সব কিছুর জন্য সরকারকে দোষারোপ করে। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ যেভাবে স্বার্থপরতায় মগ্ন, নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়, দেশপ্রেম না থাকা, অসচেতনতার হার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে পুরো দেশটাই অযোগ্য একটা দেশে পরিণত হবে।
ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজন পরিকল্পিত ও সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ। কেবল মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। এর জন্য আরও অনেক কিছু করতে হবে।
ঢাকাকে অত্যাধুনিক এবং পরিবেশবান্ধব শহর হিসেবে গড়তে হলে সবার আগে ঢাকার ভেতর থেকে সচিবালয়, বিদেশি দূতাবাস, বিশ্ববিদ্যালয়, বিমানবন্দর, রেলওয়ে স্টেশন, বিডিআর সদর দপ্তর ও ক্যান্টনমেন্টের মতো বড় স্থাপনাগুলো স্থানান্তর করে রাজধানীর বাইরে শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা যেতে পারে।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব হাইরাইজ ভবন নির্মাণ করলে ঢাকা হবে যানজটমুক্ত একটি আধুনিক শহর। মানুষ ফিরে পাবে সুন্দর জীবনযাপনের একটি নতুন ঠিকানা।
ইকোনমিস্ট-এর এই প্রতিবেদনটিকে হেলাফেলা করে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, এই প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
ফলে, ঢাকা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী একটি নেতিবাচক ধারণাই প্রচার পেয়েছে। যে দেশে সরকারিভাবে সব সময় ‘উন্নয়নের জোয়ার বইছে’ বলে প্রচার করা হয়, সেই দেশের রাজধানীই যদি ‘বসবাসের অনুপযোগী’ তকমা পায়, তাহলে সেটা কীসের উন্নয়ন? যে উন্নয়ন নাগরিকদের জীবনের মান ও বাসযোগ্য পরিবেশ উন্নয়নের নিশ্চয়তা দেয় না, সেটা কীসের উন্নয়ন? আসলে পরিবর্তন আনতে হবে মানুষগুলোর মানসিকতায়। এই মানুষই সিঙ্গাপুর বানায়! আবার এই মানুষই ঢাকা বানায়! সুতরাং দেখতে হবে মানুষগুলো কারা এবং কেমন তাদের মানসিকতা!
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক