পাকিস্তানে মুসলিম লীগ সরকার রাজনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল। তারা পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের তারিখ বার বার পিছাতে থাকে। অবশেষে ১৯৫৪ সালের মার্চে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের কথা ঘোষিত হয়। ইতিমধ্যে শাসক দল মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এ দেশের রাজনীতিবিদরা সতর্ক হয়ে যান।
নির্বাচনে মুসলিম লীগের মোকাবিলা করার জন্য সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল মিলে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, কৃষক প্রজা পার্টি, নেজামে ইসলাম ও গণতন্ত্রী দলের সমন্বয়ে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে জনগণকে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে অনুপ্রাণিত করে তোলে। যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনি তৎপরতায় তরুণ শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ছাত্র থাকাকালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এই আন্দোলনের সূত্রে ১৯৪৬ সালে প্রথমে কলকাতা ও পরে বিহার এবং পূর্ববাংলার কয়েকটি স্থানে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। দাঙ্গা প্রতিরোধ এবং আক্রান্ত মুসলমানদের রক্ষা করতে তরুণ শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সময়ই তার রাজনৈতিক জীবনপর্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এসে দাঁড়ায়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান অর্জিত হলে সবচেয়ে খুশি হওয়ার কথা পাকিস্তান আন্দোলনের মাঠের যোদ্ধা পূর্ববাংলার বাঙালির। শুরু থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলিম লীগ নেতাদের হাতে পাকিস্তানি শাসনক্ষমতা চলে গেলেও বাঙালি নেতারা এ নিয়ে আপত্তি তোলেননি। তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের মুসলমান ভাই হিসেবেই মনে করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি নেতাদের মধ্যে এই উদারতা ছিল না।
এ কারণে শাসকদের আচরণে ক্রমে বাঙালি স্বাধীনতার কটু গন্ধ অনুভব করল। ভাষা প্রশ্নে সংকট তৈরি করে ফেলল শাসকগোষ্ঠী। পাকিস্তানি নেতারা জানেন বাঙালি সংস্কৃতির একটি উজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে। এই সাংস্কৃতিক শক্তি তাদের স্বাজাত্যবোধকে শক্তিমান করে তুলবে। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর শোষণ প্রক্রিয়া বজায় রাখা সম্ভব হবে না। তাই বাঙালি প্রজন্মকে সংস্কৃতিবিচ্ছিন্ন করার জন্য সংস্কৃতির বাহন বাংলা ভাষাকে অচেনা করে দিতে চাইল। ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এখানেই রচিত হয়।
আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লড়াকু ছাত্রনেতা শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। যা ভীত করে তুলেছিল পাকিস্তানি শাসক চক্রকে। যে কারণে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের আগেই বঙ্গবন্ধুকে কারারুদ্ধ করা হয়। কারাগারে থেকেও বঙ্গবন্ধু নানাভাবে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন ভাষা আন্দোলনের।
ভাষা আন্দোলন দমনে ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়ে রক্তাক্ত করার পাকিস্তানি নীতিকে স্বাভাবিকভাবেই বাংলার মানুষ গ্রহণ করতে পারেনি। তাই শাসকদের রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের প্রতি বাঙালি নেতারা আস্থা রাখতে পারেননি। এদের অনেকেই ১৯৪৯-এ গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগে যুক্ত হতে থাকেন। আরও রাজনৈতিক দল গঠনেরও সম্ভাবনা তৈরি হয়।
১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা অর্জিত হলেও তা অনেকটা মৌখিক প্রতিশ্রুতি হিসেবে থেকে যায়। তখনও পাকিস্তানের কোনো সংবিধান রচিত না হওয়ায় তা আইনত বিধিবদ্ধ হতে পারেনি। ফলে বাঙালি নেতারা আস্থা রাখতে পারেননি পাকিস্তানি শাসকদের প্রতিশ্রুতিতে।
এমন একটি অবস্থায় পাকিস্তান সরকার ১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। নির্বাচনে মুসলিম লীগকে প্রতিহত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ মোর্চা গঠন করে নির্বাচন করার চিন্তা অনেকেই করছিলেন। এই প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতারা মোটামুটি একমত হয়েছিলেন দলের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র স্পষ্ট করার জন্য ‘মুসলিম’ শব্দটি উঠিয়ে দলের নাম করা হবে আওয়ামী লীগ। কাউন্সিল অধিবেশনে উত্থাপনের আগে থেকেই আওয়ামী লীগ নামটিই ব্যবহৃত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুও তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এ সময়ের কথা বর্ণনাতে ‘আওয়ামী লীগ’ই বলেছেন।
শেরেবাংলা একে ফজলুল হক তখন ঢাকা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি পদত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগ দেন। বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব নেন হক সাহেবকে আওয়ামী লীগে নিয়ে আসার। ফজলুল হক বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দেন। তবে যোগদান তখনও করেননি। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লেখেন- “চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের জনসভায় হক সাহেব বলেন,‘যাঁরা চুরি করবেন তাঁরা মুসলিম লীগে থাকুন, আর যাঁরা ভালো কাজ করতে চান তাঁরা আওয়ামী লীগে যোগদান করুন।”
বঙ্গবন্ধুকে সকলের সামনে উপস্থিত করিয়ে বলেন, “মুজিব যা বলে তা আপনারা শুনুন। আমি বেশি বক্তৃতা করতে পারবো না।”
নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের নেতারা দুই ধরনের মতে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ছোট পক্ষ যুক্তফ্রন্ট গঠন করে ঐক্যবদ্ধ মোর্চায় নির্বাচন করতে চান। অন্যরা মনে করেন আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করবে। শেখ মুজিব ও মওলানা ভাসানী যুক্তফ্রন্টের পক্ষে ছিলেন না। মুসলিম লীগ থেকে যারা আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন তাদের প্রতি খুব ভালো ধারণা ছিল না মওলানা ভাসানীর। হক সাহেব আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট গঠনের পক্ষে যারা তাদের কেউ কেউ হক সাহেবকে বোঝান আওয়ামী লীগে যোগ না দিয়ে আলাদা দল গঠন করে যুক্তফ্রন্টে যোগ দিলে লাভ বেশি হবে।
মওলানা ভাসানীর নির্দেশে শেখ মুজিব ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ডাকেন। এই সম্মেলনে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পক্ষে-বিপক্ষে মতানৈক্য প্রবল হলো। যুক্তফ্রন্ট গঠনের পক্ষের মানুষই ছিলেন বেশি। বাস্তব অবস্থা দেখে বুঝলেন এমন বিভেদ প্রকাশ্যে চলে এলে মানুষ ভাববে আওয়ামী লীগের মধ্যে ঐক্য নেই। যাহোক শেষ পর্যন্ত যুক্তফ্রন্ট গঠনের পক্ষে ঐকমত্যে পৌঁছলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তফ্রন্টের অংশীদার হওয়ার জন্য এ কে ফজলুল হক কৃষক শ্রমিক দল গঠন করলেন।
শেখ মুজিব যুক্তফ্রন্টের পক্ষে গোপালগঞ্জ থেকে নির্বাচন করার জন্য নমিনেশন পান। অর্থশালী মুসলিম লীগের নেতা জনাব ওয়াহিদুজ্জামান শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা তাকে এগিয়ে রাখে। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু প্রায় ১০ হাজার ভোট বেশি পেয়ে জয়লাভ করেন।
যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা ছিল মূলত পূর্ববাংলার জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবি। যে কারণে যুক্তফ্রন্ট তার ২১ দফার প্রতি জনগণের পূর্ণ সমর্থন লাভ করে, যার প্রতিফলন নির্বাচনে লক্ষ করা যায়। ১৯৫৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে এবং যুক্তফ্রন্ট বিপুল সংখ্যাধিক্যে জয়ী হয়। পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদের মোট আসনসংখ্যা ছিল ৩০৯টি। আসনগুলো মুসলিম এবং অমুসলিম এ দুটি পর্যায়ে বিভক্ত ছিল। মুসলিম আসন সংখ্যা ২৩৭ এবং অমুসলিম আসনসংখ্যা ছিল ৭২। মোট আসনের ২৩৬টি আসনই যুক্তফ্রন্ট পায়।
নির্বাচনের ফলাফল বের হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ঢাকায় আসেন। রেলস্টেশনে তাকে বিশাল অভ্যর্থনা জানানো হয়। এরপর যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ এমএলএ বৈঠক করে। এবার মন্ত্রিসভা গঠনের প্রশ্ন আসে। এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে শুরু হয় মন্ত্রিসভা গঠনের প্রক্রিয়া। ফজলুল হক ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। নতুন মন্ত্রিসভার মুখ্যমন্ত্রী হলেন ফজলুল হক। বঙ্গবন্ধু এই মন্ত্রিসভার সদস্য হলেন। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ব্যাপারে চেষ্টা চালাতে থাকেন। এই মন্ত্রিসভা বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা, ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটি ঘোষণা এবং বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমি করার প্রস্তাব গ্রহণ করে।
ফজলুল হক প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিলেন। ১৯৫৪ সালের ৩০ এপ্রিল তিনি আমন্ত্রিত হয়ে কলকাতায় যান। সেখানে বক্তৃতা দেয়ার সময় উল্লেখ করেন যে, ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে দুই বাংলা অভিন্ন।’
এবার মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় নেতারা সুযোগ খুঁজে পেলেন। তারা দেখতে পেলেন এই বক্তৃতার সূত্রে ফজলুল হককে অপসারণ করা যেতে পারে। ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের অজুহাতে তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। প্রচার করা হয় ফজলুল হক ভারতের কাছে পূর্ব পাকিস্তান বিক্রি করে দিতে চান। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের নানা অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো হতে থাকে। আর সব দায় দেয়া হতে থাকে যুক্তফ্রন্ট সরকারের ওপর। অতঃপর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে ১৯৫৪ সালের ৩০ মে ভেঙে দেয়া হয়। অবসান হয় পূর্ববাংলার সংসদীয় গণতন্ত্রের।
পাকিস্তানের প্রাথমিক পর্বে পূর্ববাংলার শাসনক্ষমতায় স্বল্পকাল স্থায়ী বাঙালির শাসনকাঠামোয় বঙ্গবন্ধু ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন। যা পরবর্তী বাঙালির অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তাকে বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেয়।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়