কোয়াড ইস্যুতে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতের ভুল(!) বাংলাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এক শীতল বাক্যবিনিময় হয়ে গেছে দেশটির। আর সেই সম্পর্ক উষ্ণ করতেই বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা থেকে ৫ ডলার কম মূল্যে ১০ ডলারে সিনোফার্মের টিকা বিক্রির প্রস্তাবে রাজি হয় চীন। কিন্তু সম্প্রতি টিকার মূল্য প্রকাশিত হওয়ার পর আবারও সম্পর্কে ভাটা পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে চীন-বাংলাদেশের।
শ্রীলঙ্কার বিরোধীদলীয় নেতা ড. হারসা দে সিলভা বলেছেন, বাংলাদেশের তুলনায় শ্রীরঙ্কা যে মূল্যে চীন থেকে টিকা নিচ্ছে, তাতে আমাদের ১৪ বিলিয়ন ডলার বেশি খরচ হবে। ‘আমাদের বন্ধু হিসেবে চীন পরবর্তী চালানে টিকার মূল্য কমাতে পারে না?’- এমন প্রশ্ন করেছেন তিনি টুইটারে।
তিনি আরও লিখেছেন, শ্রীলঙ্কার সরকার বলছে বাংলাদেশ ১০ ডলারে চীনের টিকা কেনেনি। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে জানানো হয়েছে, ১৯ মে ১০ ডলারে চীনের সিনোফার্মের ১৫ মিলিয়ন টিকা কেনার অনুমোদন প্রদান করা হয়েছে। এ বিষয়ে তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পরও শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকার চীনের পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা করেছে।
রাজাপাকসের সরকার দাবি করেছে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের এমন কোনো চুক্তিই হয়নি, যার প্রেক্ষাপটে ঢাকা ১০ ডলারে টিকা পাবে। এ বিষয়ক চুক্তি এখনও সম্পন্ন হয়নি, বরং সম্পন্ন হওয়ার পথে রয়েছে। তারা সেটাই বলেছে যা কলম্বোর চীন অ্যাম্বাসি থেকে বলা হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বিষয় নিয়ে দারুণ ঝড় উঠেছে। দাবি করা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার বন্ধু চীন এতদিন যাবৎ যা অর্থ সহায়তা করেছে তা বেশি দামে টিকা সরবরাহের মাধ্যমে উশুল করে নিচ্ছে। এর আগে বেইজিং শ্রীলঙ্কায় নিজেদের কর্তৃত্বমূলক আচরণ বজায় রাখতে ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন সিনোফার্মের ডোজ সরবরাহ করেছে। এর মাধ্যমে দেশটির উত্তর প্রদেশে উইন্ডমিল প্রকল্প নিজেদের করে নিতে চায় চীন, যা তাদের না দেয়ার বিষয়ে অনুরোধ করে আসছে ভারত।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, চীনের সিনোফার্মের টিকার মূল্য ভারতের অ্যাস্ট্রাজেনেকার (কোভিশিল্ড) টিকার থেকে বেশি। যার প্রতিটি ডোজের মূল্য ৫ দশমিক ৫ ডলার। সেই সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সিনোফার্মের টিকার থেকে অনেক বেশি কার্যকর। মধ্যপ্রাচ্যে সিনোফার্মের টিকার তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপ পর্যন্ত ব্যবহার করতে হচ্ছে, যেখানে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দুই ডোজেই কাজ করছে। এ অবস্থায় সিনোফার্মের টিকার প্রকৃত ব্যয় কয়েক গুণ হতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকে। সেই সঙ্গে তাদের টিকার ওপর নির্ভর করেও থাকতে হতে পারে।
প্রাথমিকভাবে কলম্বোর চায়না অ্যাম্বাসি ঢাকার কাছে ১০ ডলারে টিকা বিক্রির বিষয়টিকে ‘ভুয়া খবর’ বলে চালিয়েছে। কিন্তু এখন বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন যে, চীন এই তথ্য প্রকাশে বিরাগভাজন হয়েছে। বাংলাদেশে এই টিকার মূল্য প্রকাশে কোনো ভুল দেখছি না আমি। কেননা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে যে, এই টিকার মূল্য তারা কাউকে জানাবে না। কিন্তু এ তথ্য প্রকাশ করেছে একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন জাতীয় দৈনিক। আমার কাছে যে বিষয়টি আশ্চর্যজনক মনে হচ্ছে, তা হলো কোন প্রক্রিয়ায় চীন তার ভ্যাকসিনের মূল্য নির্ধারণ করেছে!
এ বিষয়ে খবর প্রকাশের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানান, সিনোফার্মের টিকার মূল্য প্রকাশ হওয়া কিছুটা অখুশি চীন। ঢাকার ইংরেজি এক জাতীয় দৈনিকে বলা হয়, ঢাকার সঙ্গে চীনের চুক্তি অনুসারে ‘টিকার মূল্য প্রকাশ করা যাবে না’। বেসরকারি টেলিভিশনে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘এই তথ্য প্রকাশিত হওয়ায় আমরা দুঃখিত।’
তিনি বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার করতে আরও স্পষ্ট করে জানান, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আর এই মূল্যে টিকা পাবে না চীনের কাছ থেকে। চীন বাংলাদেশকে এমন এক তথ্য গোপন রাখতে বলেছে, যা গোপন রাখা সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক এক দেশের পক্ষে কষ্টকর। আর সে কারণেই এই শর্তের মাধ্যমে আসলে বাংলাদেশের সঙ্গে একধরনের ছলনার আশ্রয় নিয়েছে চীন।
চীন শ্রীলঙ্কাকে ঋণ, ব্যবসায়িক সুবিধা এবং উপহার প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছে। আর বিনিময়ে দেশটির একটি বন্দরকে ৯৯ বছরের জন্য নিজেদের করে নিয়েছে। সেই সঙ্গে হাম্বানতোতা বন্দরও তারা নিজেদের করে নিয়েছে যখন শ্রীলঙ্কা তাদের ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হয়।
এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় এক বড় ধরনের ভূ-রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে শ্রীলঙ্কা। যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ার ‘শিকারি’ রাষ্ট্র চীন, যারা এই অঞ্চলের সব উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে যেই ভূ-রাজনৈতিক সংকট শ্রীলঙ্কা তাদের জন্য তৈরি করেছে তা বিশ্বের কাছে অজানা নয় এবং এ বিষয়ে বেশ সচেতনভাবেই নিজ পথ বেছে নিয়েছে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গঠিত (আরও অনেক দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে) কোয়াড নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তায় রয়েছে চীন। আর সে কারণেই তার সঙ্গে উন্নয়ন কার্যক্রমে জড়িত দেশগুলোকে কোয়াডে যোগ না দেয়ার জন্য বলছে দেশটি। এমনকি কোয়াডে যোগ দিলে চীনের সঙ্গে অপর দেশের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি হতে পারে বলেও জানানো হচ্ছে।
চীন তার ‘পার্ল ট্রেড’ নীতি নেপাল থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। মধ্যখানে থেকে বাদ থাকছে ভারত। আর তাদের এই নীতিমালায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। কেননা এখন থেকে আরব সাগর পর্যন্ত যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু ক্ষেত্রে দ্বিমত থাকলেও দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক বেশ আন্তরিক।
চলতি বছরের ১০ মে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং কূটনৈতিক প্রতিবেদকদের সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বাংলাদেশকে কোয়াডে যোগ দেয়ার বিষয়ে সাবধান করেছেন, যা ঢাকা-সিনো সম্পর্কের অবনতির কারণ হতে পারে।
দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী উই ফ্যাঙ্গে একই মাসে ঢাকা সফরের পর এই সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন লি জিমিং। উই ফ্যাঙ্গে তার সফরে ভিন্ন অঞ্চলের সামরিক বাহিনীকে এই অঞ্চলে প্রবেশের বিষয়ে নিরুৎসাহিত করার জন্যই আলোচনা করেছেন। এই আলোচনা তিনি শ্রীলঙ্কা ও নেপালেও করেছেন।
চীনের থেকে ঋণ নিতে রাজি না হওয়ার পরও বিগত এক বছরে বাংলাদেশকে ১০ হাজার টেস্টিং কিট, ১০ হাজার সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) এবং ১ হাজার থার্মাল স্ক্যানার প্রদান করেছে চীন। বাংলাদেশ কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় এই উপহার গ্রহণ করলেও বেশ কৌশলে চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পকে নাকচ করেছে।
বাংলাদেশে দৃঢ় নেতৃত্বের অধিকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াকে সংযুক্ত করে এমন এক বড় প্রকল্পে নিজেদের যুক্ত রাখতে চান, যা চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের মাধ্যমে সম্ভব নয়। আর সে কারণেই চীনের আর্থিক সহায়তা প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করেনি বাংলাদেশ।
নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপ চীনের যেই নীতির শিকারে পরিণত হয়েছে, তা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতেই চীনের কাছ থেকে দ্রব্যসামগ্রী বা প্রযুক্তিগত সহায়তা নিলেও আর্থিক কোনো সহায়তা নিতে রাজি হয়নি বাংলাদেশ। বরং বাংলাদেশ তার নিজস্ব অর্থায়নে কাজগুলো সম্পাদন করছে। এ জন্য বাংলাদেশ বেছে নিয়েছে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কার্যক্রম।
২০১৬ সালে বাংলাদেশে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের সময় বেশ কিছু সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু চীন থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ সাবধান থেকেছে। সেই সঙ্গে চীনের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাতিলের পাশাপাশি চীনের বেশ কিছু ফার্মকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে, যার খবর দেশের জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
লি জিমিং তার সাবধান বাণীতে বলেছিল, ‘কোয়াডের মতো ছোট একটি সংগঠনে সদস্য বাংলাদেশের হওয়া উচিত হবে না, কেননা এটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতির কারণ হতে পারে।’ কিন্তু বাংলাদেশ বর্তমানে তার শক্তি সম্পর্কে জানে এবং এ কারণেই চীনের রাষ্ট্রদূতের এমন মন্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘সার্বভৌম একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তার নিজ দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য পররাষ্ট্রনীতি নিজেই ঠিক করবে।’ সেই সঙ্গে বাংলাদেশে থাকা বিদেশি কূটনীতিকদের ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও আচরণের মধ্যে থাকা’ এবং ‘বিষয়গুলো বিবেচনা করে মন্তব্য করার’ আহ্বান জানান তিনি।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হু চুনইয়াং ‘কোয়াড’ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্কশ উক্তি প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা মনে করি এটি চীনের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চীনবিরোধী মনোভাব তৈরির একটি অপচেষ্টার ফসল। সুতরাং আমরা আশা করছি, আমাদের অবস্থান বেশ স্পষ্ট সবার কাছে।’ তিনি আরও জানান, চীন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কখনোই হস্তক্ষেপ করে না। তারা অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে বিশ্বাসী।
কোয়াড বিষয়ে আমাদের থেকেও ভালো জানে ভারত, আর কোয়াড গঠনের মূল উদ্দেশ্য কী সেটাও জানে ভারত। এখানে কি শুধু চীনকে বাদ রাখা হচ্ছে, নাকি চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য এটি গঠিত হচ্ছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে এ বিষয়ে বক্তব্য দেয়া কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ নয়। এটি মূলত কোয়াডের বিরোধিতা করা এবং এ বিষয়ে সবাইকে জানানো ও সাবধান করা।
বিপদগ্রস্ত দেশগুলোর সঙ্গে চীনের ‘ভ্যাকসিন কূটনীতি’ যেভাবে কাজ করেছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। বাংলাদেশ বাস্তবিক অবস্থা অনুসারে নীতিনির্ধারণের মাধ্যমে এবং নিরপেক্ষ অবস্থানের মাধ্যমে এতদিন পরিচালিত হয়েছে, যার সুফলও ভোগ করেছে দেশটি। ঢাকা শ্রীলঙ্কাকে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিচ্ছে, যা স্পষ্টতই বলছে যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এবং চার বছর আগেই জিডিপিতে শ্রীলঙ্কাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়েছি আমরা। ঢাকার জিডিপি বর্তমানে ৮৫ বিলিয়ন, যেখানে কলম্বোর বর্তমান জিডিপি মাত্র ৩ বিলিয়ন।
শ্রীলঙ্কা চীনের এই প্রকল্প থেকে যখন মুক্তি পাবে, ততদিনে বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়ে যাবে। কারণ ঢাকা তার পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবতার নিরিখে তৈরি করে এগিয়ে গেছে। ঢাকা জানে, কোনো দেশের মুঠোর মধ্যে না থেকেও উন্নয়ন করা সম্ভব। বরং শ্রীলঙ্কার এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের থেকে কিছু শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক।