বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক সংগঠন নয় কেন

  •    
  • ১২ জুন, ২০২১ ১৩:১৭

ইসলাম হেফাজতের নাম করে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের একটি অংশ ১১ বছর ধরে যেভাবে চলছে, সেটি কতটা ধর্মের পবিত্রতাকে রক্ষা করার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়, কিংবা শিক্ষকদের কারও কারও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধন, কিংবা ব্যক্তিগত সুযোগসুবিধা লাভ, বেপরোয়া হয়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করে সেটি এখন গভীরভাবে চিন্তা করার বিষয়। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের অনেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শুধু যুক্তই নন, অনেকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীনও আছেন।

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে কওমি মাদ্রাসা। দেশে মোট কতটি কওমি মাদ্রাসা রয়েছে, কত শিক্ষক আছেন, ছাত্রসংখ্যা কত, এর পরিচালনা পরিষদ কীভাবে গঠিত হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কাদের অনুমোদনে প্রতিষ্ঠিত হয়, এর নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান কোনটি- এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর বাইরের কারও জানা নেই।

কওমি মাদ্রাসার অভ্যন্তরে যারা আছেন তারাও কতটা জানেন-সেটিও কারও জানা নেই। অথচ কওমি মাদ্রাসা দেশের শিক্ষাব্যবস্থারই অন্যতম একটি ধারা। আলিয়া মাদ্রাসাও একটি শিক্ষার ধারা। দেশে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম প্রধান শিক্ষার ধারা।

এগুলোর বাইরেও ভোকেশনাল, টেকনিক্যাল, কৃষি, পলিটেকনিক্যাল, বেসরকারি কেজি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কেজি স্কুলের অনুমোদনকারী ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম খুব একটা জানা যায় না। তবে কওমি মাদ্রাসা ছাড়া অন্য সব ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজস্ব সংগঠন বা সমিতি রয়েছে। বেসরকারি কেজি স্কুল এবং কলেজের মালিকদের সমিতি রয়েছে।

বেসরকারি কেজি স্কুল ও কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের কোনো সমিতির নাম শোনা যায় না। সাধারণত সরকারি-বেসরকারি সব ধরন ও স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের নিজস্ব পেশাগত সুযোগসুবিধা আদায় এবং বাস্তবায়নের জন্য নিজস্ব সমিতি রয়েছে। অনেক সময় একই স্তরে একাধিক সমিতিও কার্যকর থাকতে দেখা যাচ্ছে। একসময় শিক্ষক সমিতিগুলোকে নিজেদের পেশাগত সুযোগসুবিধা লাভের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে দেখা গেছে। সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করে শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া আদায় করে নিয়েছে।

বর্তমানে আমরা প্রায় ৩০ হাজারের কাছাকাছি বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, বেসরকারি কলেজ ও মাদ্রাসাকে দেখছি। এগুলো আগে সরকারি অনুদান খুব একটা পেত না। বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে কিছু অনুদান সরকার থেকে দেয়া হতো। তাতে বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বলতে যা বুঝায় তার অনেকটাই অনুপস্থিত ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্রবেতন সংগ্রহ করে তা থেকে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যা দিতে পারত তাই তাদের বেতন হিসেবে ধরে নেয়া হতো। তারা কোনো জাতীয় স্কেল অনুযায়ী বেতন পেতেন না।

যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয় ভালো ছিল, সেখানকার শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অপেক্ষাকৃত অন্য সমগোত্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কিছুটা ভালো অবস্থানে ছিল। বেশির ভাগ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনদানে খুব একটা সক্ষম ছিল না। অথচ শিক্ষা ও মাদ্রাসা বোর্ড থেকে এগুলোর অনুমোদন দেয়া হতো। কিন্তু শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনের বিষয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এর ফলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেধাবীরা শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদ যাদের নিয়োগ দিতেন তাদের বেশির ভাগই এই পেশায় যুক্ত হয়েছেন ভালো কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারার কারণে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়-উন্নতি ভালো ছিল সেখানে অপেক্ষাকৃত মেধাবীদের সংযুক্তি ঘটেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেও এই ধারা কিছুটা ছিল। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।

শিক্ষাবোর্ডের অনুমোদনপ্রাপ্ত বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা নিজেদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে সমিতি গঠন করতে থাকে । সমিতির নেতৃত্বে শিক্ষক কর্মচারীরা দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য আন্দোলন সংগ্রামও করতে থাকেন। একপর্যায়ে প্রায় সব সমিতিই আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এমপিওভুক্ত করাতে সক্ষম হয়। এতে শুরুর দিকে সরকার মূল বেতনের একটি অংশ প্রদান শুরু করে। এভাবেই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতনভাতা বিভিন্ন সরকার বৃদ্ধি করতে থাকে। বেশ কয়েক বছর আগেই সরকার এমপিওভুক্ত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতনের শতভাগ, আংশিক বাড়িভাড়া ও চিকিৎসাভাতা জাতীয় স্কেল অনুযায়ী প্রদান করতে শুরু করেছে। এর বাইরে বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির ব্যানারে রেজিস্টার্ড-ননরেজিস্টার্ড ইত্যাদি নামে প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ আন্দোলন-সংগ্রাম করে নিজেদের জাতীয়করণ করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে।

২৬ হাজারের মতো প্রাথমিক বিদ্যালয় নতুনভাবে সরকারি বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়। এর আগে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু প্রায় ৩৮ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারীকরণ করেন। এর সঙ্গে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে ২৬,১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন এবং ১ লাখের বেশি শিক্ষক সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো সমান সুযোগ লাভ করেন।

এখনও মাঝেমধ্যে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কিছু শিক্ষক সমিতির ব্যানারে প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণ এবং বেসরকারি স্কুল-কলেজের এমপিওভুক্ত করার দাবি জানিয়ে অনেককে আন্দোলন করতে দেখা যায়। এভাবে এমপিওভুক্ত ও জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার মান খুব একটা বৃদ্ধি পায় বলে মনে হয় না। অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে। কম দক্ষ, অনভিজ্ঞ ও দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি লাভ করে অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী এবং জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা শেষবিচারে মানের সংকট থেকে এখনও বের হতে পারেনি।

এ ব্যাপারে শিক্ষকদের সংগঠনগুলো খুব একটা সোচ্চার নয়। দেশে এখন আগের মতো বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক সমিতির নামধাম ততটা শোনা যায় না। যদিও উপজেলাগুলোতে বিভিন্ন সমিতির অফিস ও কার্যক্রম দৃশ্যমান আছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সমিতির কথা সকলেই অবগত আছেন। অন্যান্য স্তরেও শিক্ষকদের সংগঠন রয়েছে। কিন্তু কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকরা কোনো সমিতির পতাকাতলে আছেন কি না সেটি খুব একটা জানা যায় না। তবে ২০১০ সাল থেকে কওমি মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠন দেশব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠে।

গত ১১ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে হেফাজতে ইসলাম ‘অরাজনৈতিক ধর্মীয় সামাজিক’ সংগঠন নামে নিজেদের পরিচয় প্রদান করলেও এর কার্যক্রম, দাবিনামা, অংশগ্রহণ ইত্যাদি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশে কোনো স্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ছাত্রছাত্রীরা এ ধরনের কোনো সংগঠনে অতীত বা বর্তমানে একসঙ্গে যুক্ত হয়েছে-এমন কোনো নজির নেই। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম যেকোনো কর্মসূচি প্রদানে যে নজির স্থাপন করে তাতে শিক্ষক ও ছাত্রদের নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে।

২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল এবং ৫ মে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্ররা ঢাকা অবরোধ, সরকার উৎখাত ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করে। এ বছর ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে মাদ্রাসার শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, সরকারি স্থাপনা ধ্বংসের কাজে একসঙ্গে যেভাবে অংশগ্রহণ করেছে সেটি বাংলাদেশের অন্য কোনো স্তরের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যৌথভাবে করার মতো কল্পনা কেউ করতে পারছে না। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তা করেছে।

এটি কতটা আইনসিদ্ধ, নীতিনৈতিকতার মধ্যে পড়ে সেটিও বিবেচ্য বিষয়। ইসলাম হেফাজতের নাম করে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের একটি অংশ ১১ বছর ধরে যেভাবে চলছে, সেটি কতটা ধর্মের পবিত্রতাকে রক্ষা করার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়, কিংবা শিক্ষকদের কারও কারও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন, কিংবা ব্যক্তিগত সুযোগসুবিধা লাভ, বেপরোয়া হয়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করে সেটি এখন গভীরভাবে চিন্তা করার বিষয়। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শুধু যুক্তই নন, অনেকেই দলের গুরত্বপূর্ণ পদে আসীনও আছেন।

রাজনীতি করার অধিকার বাংলাদেশে যেকোনো মানুষের আছে। কিন্তু সেটি করতে হলে দলের কাজেই নিজেকে যুক্ত রাখা নিয়মসিদ্ধ। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে যারা বিভিন্ন মাদ্রাসায় যুক্ত আছে, তাদের প্রধান কাজ শিক্ষকতা করা, শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে শিক্ষা দেয়া, ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করা। কিন্তু যিনি কোনো একটি মাদ্রাসার শিক্ষকতার একটি পদ অলংকৃত করছেন, তিনি একই সঙ্গে একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, আবার হেফাজতে ইসলাম সংগঠনেরও নেতৃত্ব কিংবা কর্মকাণ্ডে ভীষণভাবে জড়িয়ে পড়ছেন যা তার মহৎ শিক্ষকতা পেশার দায়িত্ব পালনে মোটেও সহায়ক নয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এ ধরনের শিক্ষকদের ইতিবাচক প্রভাবের চাইতে নেতিবাচক প্রভাবই বেশি পড়ে।

বাংলাদেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষকই কর্মরত আছেন, যাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক দলের সদস্য কিংবা কর্মী-সমর্থক বলে পরিচিত। তবে ওইসব শিক্ষক তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অন্য শিক্ষক কর্মচারী কিংবা শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচিতে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ বা বাধ্য করে থাকেন এমনটি শোনা যায় না। বাস্তবেও এটি সম্ভব নয়। কিন্তু কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষকরা তাদের পেশাগত কোনো সমিতি গঠন না করে হেফাজতে ইসলাম নামে যে সংগঠনটি দাঁড় করিয়েছেন এবং গত ১১ বছর যাবৎ দেশে সবচাইতে আলোচিত, সমালোচিত সংগঠন হিসেবে নিজেদের তুলে ধরেছেন সেটি মোটেও কওমি মাদ্রাসার জন্য ভালো কোনো বার্তা বয়ে আনেনি। ২০১৩ সালেও ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের অগ্নিকাণ্ড, বায়তুল মোকাররমের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের লাইব্রেরি পোড়ানো, মতিঝিলে ভাঙচুর, তাণ্ডব, শিশু-কিশোরদের দেশের আনাচকানাচ থেকে নিয়ে আসা, সরকার উৎখাতে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা, একইভাবে ২৬-২৮ মার্চে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক জায়গায় যা করা হয়েছে- তা মোটেও কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাজ হতে পারে না। শিক্ষকরা নিজেরাও যেমন এ ধরনের কাজে অংশ নিতে পারেন না, শিক্ষার্থীদেরও তারা এসব কাজে ব্যবহার করতে পারেন না। এটি ধর্মীয় বা সাধারণ কোনো শিক্ষায়ই সমর্থন করে বলে মনে করার কোনো ভিত্তি নেই।

হেফাজতে ইসলামের নেতৃরা মূলতই কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক। তাদের কাছ থেকে সবাই শিক্ষার নানা দিক লাভ করার আশা করেন। কিন্তু যখন তারা কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার কার্যক্রম ছেড়ে বাইরের জগতে আইনকানুন ভেঙে নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের পথে পা বাড়ান, জড়িয়ে পড়েন, তখন তাদের পেশাগত সীমানা ও মর্যাদা লঙ্ঘিত হয়। তারাও নিজেদের মহৎ শিক্ষকের মর্যাদার আসনে ধরে রাখতে পারেন না। এমনটির প্রমাণ এখন আমরা কিছুটা দেখতে পাচ্ছি। তবে পত্রপত্রিকায় কওমি মাদ্রাসার অভ্যন্তরের শিক্ষার্থীদের জীবনাচরণের সীমাবদ্ধতা, নানা ধরনের অন্যায়-অনিয়ম, অনাচারের খবর উঠে আসছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনায় আর্থিক অনিয়ম, ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ, দেশি ও বিদেশি ব্যক্তি বা সংস্থা থেকে অর্থ-অনুদান লাভ এবং তা নানাভাবে আত্মসাৎ, অবৈধ সম্পদ অর্জন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতার স্বার্থে ব্যবহার করা ইত্যাদি অভিযোগ এখন মিডিয়া ও মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত বিষয়।

এর ফলে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের সরল বিশ্বাস অনেকটাই হোঁচট খেয়েছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে অরাজনৈতিক পরিচয়ে যে সংগঠনটি তারা গত ১১ বছর ধরে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেটি বাস্তবেই একটি নিয়ন্ত্রণহীন রাজনৈতিক দলের চরিত্রের ফাঁদে আটকে পড়েছে। সংগঠনের নেতাদের মধ্যে নানা ধরনের উচ্চাভিলাষ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা থেকে কারও পদস্খলনও ঘটেছে। তাদের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির মৃত্যুর আগে হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে যে ধরনের বিভাজন ও হাঙ্গামা প্রদর্শিত হয়েছে তা ভাবতেও কষ্ট হয়।

তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে তার পেছনে ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিসহ নানা ধরনের অপরাধ প্রবণতা; যা থেকে মুক্ত হতে পারেননি এই মাদ্রাসার অনেক নামীদামি শিক্ষকও।

এরপর তড়িঘড়ি করে সংগঠনের কমিটি গঠন, অন্যদেরকে বাইরে রাখা, এ নিয়ে পালটাপালটি অভিযোগ, আবার নতুন করে কমিটি গঠন, এর বিপরীতে নতুন কমিটি গঠন- এ এক দীর্ঘ বিতর্ক লড়াইয়ে হেফাজতের নেতৃত্ব এখন দেশে বিতর্কের এমন এক জায়গায় চলে গেছে যেখান থেকে বের হওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়।

যদি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের পেশাগত কিংবা শিক্ষার সুযোগসুবিধা সৃষ্টি করার জন্য একটি পেশাজীবী সংগঠন তথা কওমি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি গঠন করতেন, সেটিকে অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনের গঠনতন্ত্র মোতাবেক পরিচালিত করার উদ্যোগ নিতেন, তাহলে তাদের কওমি মাদ্রাসাগুলো প্রতিষ্ঠানগতভাবে যেমন লাভবান হতো, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে কিংবা পড়াশোনা করে দেশ ও জাতির কাজে আত্মনিয়োগ করতে সক্ষম হতেন।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি ধারাসমূহ যেভাবে নানা সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে এখন সম্মুখের দিকে অগ্রসর হওয়ার মতো একটি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে কিংবা হচ্ছে, কওমি মাদ্রাসাও সে ধরনের পেশাজীবী সংগঠনের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য স্তরে উন্নীত হওয়ার সুযোগ পেত। শিক্ষাব্যবস্থার যেকোনো ধারাই শিক্ষার নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলায় পরিচালিত হতে হয়। কওমি মাদ্রাসার হেফাজতে জড়িয়ে লাভের চাইতে ক্ষতি বেশি হয়েছে। এই আত্মোপলব্ধি তাদেরকে এখন বিশেষভাবে করা উচিত। কোনটি তাদের পথ? সমিতি, নাকি ‘অরাজনীতির নামে রাজনৈতিক সংগঠন’?

লেখক: গবেষক, অধ্যাপক।

এ বিভাগের আরো খবর