১১ জুন বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি আনন্দঘন স্মরণীয় দিন। ২০০৮ সালে এদিন শেখ হাসিনার মুক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি গণতন্ত্রও মুক্ত হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস। শেখ হাসিনার ইতিহাস, গণতন্ত্র রক্ষার ইতিহাস। স্বাধীনতা অর্জন গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্যই বাংলার মানুষ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল।
২০০৮ সালের ১১ জানুয়ারির পর থেকে বাংলাদেশে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে বিভিন্নমুখী অপতৎপরতা শুরু হয়। সরকারসহ বিভিন্ন মহল দেশের দুরবস্থার জন্য রাজনীতি ও রাজনীতিকদের দায়ী করতে থাকে। ‘মাইনাস-টু ফর্মুলা’র নামে দেশের রাজনীতি থেকে দুই শীর্ষ নেত্রীকে নির্বাসনে ঠেলে দেয়ার পাঁয়তারা শুরু হয়। মাইনাস-টু ফর্মুলার কথা বলা হলেও আসলে মূল টার্গেট ছিল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ।
সাত দশকের ইতিহাসে বার বার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগ এবং দলের নেতৃবৃন্দ। অথচ এই দেশ, এই জাতির সবকিছুর অর্জনের মূলে রয়েছে আওয়ামী লীগ। সেই পাকিস্তান আমল থেকে যখনই দলটির ক্ষমতায় যাওয়ার সময় এসেছে, তখনই ষড়যন্ত্র হয়েছে।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে এবং ’৭০-এর পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে দেয়া হয়নি। ’৮৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে স্বৈরশাসক এরশাদ মিডিয়া ক্যু’র মাধ্যমে পরাজিত দেখায়।
২০০১-এর নির্বাচনেও ষড়যন্ত্রের শিকার হয় আওয়ামী লীগ। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়।
জাতির পিতাকে হত্যার তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে জেলখানার নিরাপদ কক্ষে যুদ্ধকালীন সরকারে নেতৃত্বদানকারী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, মন্ত্রী এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের হত্যার ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার দশকে শেখ হাসিনার প্রথম টার্মের শাসনকাল স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত। ৫টি বছর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। চিরায়ত ঘাটতির বাংলাদেশ খাদ্যে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই হয়নি, উদ্বৃত্তও হয়ে যায়। বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পায়।
এতকিছুর পরেও ২০০১ সালে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় যেতে দেয়নি। ২০০১-২০০৬, খালেদা জিয়া-নিজামীদের নেতৃত্বে ৫ বছরের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দেশটাকে রীতিমতো লুট করা হয়। এমন কোনো নির্যাতন-হয়রানি, কুকর্ম নেই, যা তারা করেনি।
জোটের পাঁচ বছরের অপশাসনের পর ২০০৭ সালে মোটামুটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও বিপুল ভোটাধিক্যে ক্ষমতায় আসত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোট। শুধু শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখার জন্যই খালেদা জিয়া-নিজামীরা সংবিধান লঙ্ঘন করে দলীয় রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টা বানিয়ে তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে।
অন্যায় ও অসংবিধানিকভাবে প্রধান উপদেষ্টার পদ দখলকারী প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন ২০০৭-এর ২২ জানুয়ারি একতরফা, অগণতান্ত্রিক ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে খালেদা জিয়া-নিজামীদের পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার ষড়যন্ত্র করেন।
এ সময় খালেদা-নিজামী-ইয়াজউদ্দিন গং ছাড়া জাতি ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট গঠিত হয়।
ড. কামাল, ডা. বি চৌধুরী, জেনারেল এরশাদ, কর্নেল অলি আহমদরাও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোটে শামিল হন। খালেদা-নিজামীদের প্ররোচনায় নির্বাচনের নামে প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন দেশকে গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান। ওই পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে ড. ইয়াজউদ্দিন অপসারিত হন। দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ক্ষমতায় আসে ফখরুদ্দীন সরকার। নাটের গুরু ড. ইয়াজউদ্দিন এবং তার দোসর খালেদা জিয়া-নিজামীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় জাতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
অসাংবিধানিক হওয়া সত্ত্বেও ফখরুদ্দীন সরকারকে জনগণ বিপুলভাবে অভিনন্দন জানায়। কিন্তু গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্যে দায়ী ড. ইয়াজউদ্দিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় রয়ে গেলেন। অথচ দেশ ও জাতিকে বিপর্যয়ের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য ড. ইয়াজউদ্দিনের বিরুদ্ধেই সর্বপ্রথম ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। কেন এমন হলো? পরবর্তীকালে ইতিহাসবিদরা একদিন তা নিশ্চয়ই খুঁজে বের করবেন।
ফখরুদ্দীন সরকার ক্ষমতায় এসে শুরুতে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। বেশ কটি গণমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করায় সরকার জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়।
মানুষ স্বাভাবিকভাবেই আশা করেছিল, পাঁচ বছরের জোট আমলের সীমাহীন লুটপাট, নির্যাতন-হয়রানি, গ্রেপ্তার, অপশাসন, কুশাসনের জন্য দায়ী ওই সরকার পরিচালনাকারী নেতানেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, মতিউর রহমান নিজামী, তারেক রহমান ও মান্নান ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা বানানোর মূল লক্ষ্যই ছিল পুনরায় অন্যায়ভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা। কারণ, জোটের পাঁচ বছরে তাদের নেতা-কর্মীরা যত লুটপাট ও অপকর্ম করেছে, তা ’৭৫-পরবর্তী সরকার থেকে ’৯০-এর স্বৈরশাসনামলকেও হার মানিয়েছে। ১১ জুন সেনা-সমর্থিত ফখরুদ্দীন সরকার শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১১ মাস আগে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে সেনা-সমর্থিত অসাংবিধানিক সরকার শেরে বাংলা নগরে সংসদ ভবন চত্বরে একটি ভবনকে সাবজেল বানিয়ে আটক রাখে।
শেখ হাসিনার মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে সেদিন গণতন্ত্রও মুক্তি পায়। ক্ষমতাসীনরা শেখ হাসিনাকে দেশের বাইরে রেখে ৫-৭ বছর ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল। শেখ হাসিনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন। সে সময় মিথ্যা মামলা দিয়ে অপমান ও হেনস্তা করা হয়। দেশের স্বার্থে-গণতন্ত্রের স্বার্থে মুজিবকন্যা সব নির্যাতন-অপমান সহ্য করে জেলের জীবনই বেছে নেন। অবশেষে ক্ষমতাসীনরা শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়।
জুনের শুরু থেকেই শেখ হাসিনার মুক্তির প্রত্যাশায় সাবজেলের আশপাশে কয়েক দিন ধরেই হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে। দুপুরে বিশেষ কারাগার থেকে তিনি বের হন। হাজার হাজার উল্লসিত নেতা-কর্মী শেখ হাসিনার গাড়ির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ভবনে আসেন। দীর্ঘ ১১ মাস পর প্রিয় নেত্রীকে কাছে পেয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ অগণিত নেতা-কর্মীর মধ্যে উৎসবের আমেজ লক্ষ করা যায়। উৎসবমুখর জনতায় পরিবেষ্টিত শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে যান সুধা সদনে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক।