‘ঝুঁকি নিতে না পারলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়’– শেখ হাসিনা।
তিনি বার বার ঝুঁকি নিয়েছেন বলেই আজ বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে হাঁটছে। তিনি তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্য সামনে রেখে ঝুঁকি নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। আজ ১১ জুন তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দিন। আজ তার কারামুক্তির দিন।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের এই দিন তাকে সংসদ ভবন চত্বরে স্থাপিত বিশেষ কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল।
এর আগে ২০০৭ সালের ১৩ জুলাই তাকে সেনাসমর্থিত বিশেষ সরকার গ্রেপ্তার করে। তাকে গ্রেপ্তার করে রাজনীতিতে কালো অধ্যায়ের সূচনা করতে চেয়েছিল যারা, তারা শেষপর্যন্ত হেরেছে। তিনি জিতেছেন বলে জিতেছে বাংলাদেশ। কারাগার তাকে অবদমিত করতে পারেনি।
বরং তিনি নিজেকে আরও জনসম্পৃক্ত হওয়ার উপায় খুঁজে পেয়েছেন, নিজেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করার শক্তি-সঞ্চয় করেছেন, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করেছেন।
কারগার পিতার মতো তার জন্যও শিক্ষাগার হয়েছে। স্বল্পকালের কারাবাস তাকে দীর্ঘকালের জন্য পায়ের নিচে শক্ত ভিত তৈরি করে দিয়েছে।
গ্রেপ্তারের আগে এক খোলা চিঠিতে শেখ হাসিনা দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন-
…‘অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। যে যেভাবে আছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। মাথা নত করবেন না। সত্যের জয় হবেই। আমি আছি আপনাদের সঙ্গে, আমৃত্যু থাকবো'।
তিনি তার কথা রেখেছেন। তিনি দেশের মানুষের সঙ্গে আছেন সব বাধা পায়ে দলে।
দেশের মানুষও তার কথায় সাহস পেয়েছিলেন, আস্থা রেখে তার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রতিকূল পরিবেশে, ক্ষমতাসীনদের লালচোখ উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে জনমত প্রবল হয়ে ওঠায় এবং কারাগারে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তখনকার সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য আমেরিকা যান এবং চিকিৎসা শেষে ২০০৮ সালের ৬ নভেম্বর দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর শেখ হাসিনা নির্বাচনি প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠন করে। এরপর আরও দুটি নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনে সক্ষম হয়। শেখ হাসিনা টানা তিন মেয়াদে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। দেশকে এগিয়ে নিয়েছেন নতুন উচ্চতায়।
শেখ হাসিনার রাজনীতিতে আসা এবং পথচলা– কোনোটাই ঝুঁকিমুক্ত নয়। ১৯৭৫ সালে তার বিদেশে অবস্থানকালে তিনি পিতা-মাতা- ভাই-ভাবীসহ স্বজনহারা হন। ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে বাংলাদেশের রাজনীতিকে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত ধারায় চালানোর অপচেষ্টা নেয়া হয়। সামরিকশাসক জিয়াউর রহমান ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য ‘ডিফিকাল্ট' করে তোলার ব্রত নিয়ে সুবিধাবাদী এবং নীতিহীনতার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। জিয়ার রোপিত বিষবৃক্ষ ফল দিয়েছে এবং রাজনীতি এখনও সুস্থধারায় ফিরে আসতে পারছে না।
এক বিশেষ রাজনৈতিক ও দলীয় সংকটের মুহূর্তে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয় শেখ হাসিনাকে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে শেখ হাসিনা পিতার রেখে যাওয়া দল আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। কিন্তু তার পথচলা কণ্টকমুক্ত ছিল না। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তাকে শারীরিকভাবে হত্যার কমপক্ষে ১৯টি অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ২০০৭ সালে তাকে রাজনৈতিকভাবে ‘হত্যার’ চেষ্টাও সফল হয়নি বলে বাংলাদেশ এখন তার সুযোগ্য নেতৃত্বে চলছে।
২০২০ সালের ১০ জুন জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনা বলেছেন-
‘আমি এখানে (বাংলাদেশে) বেঁচে থাকার জন্য আসিনি। জীবনটা বাংলার মানুষের জন্য বিলিয়ে দিতে এসেছি। এখানে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
হ্যাঁ, তিনি নির্ভয়ে তার লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যাচ্ছেন ঘরে-বাইরে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে। বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই অব্যাহত রেখেছেন অনেকটা নিঃসঙ্গ শেরপার মতো।
শেখ হাসিনার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়া, বিএনপির চেয়ারপারসন। আমাদের দেশের রাজনীতির একটি বিশেষ ‘দুষ্টচক্র’ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ‘দুই নেত্রী’ অভিধা চালু করে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে তথা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এক পাল্লায় তুলে রাজনীতির বড় ক্ষতি করেছে।
দুজনের রাজনীতির মত ও পথ এক নয়। যারা বলেন, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি রাজনীতির মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, তারা আসলে অতিসরলীকরণ দোষেদুষ্ট। পানি এবং আলকাতরার তফাৎ বুঝতে না পেরে রাজনীতিকে যারা স্বার্থ হাসিলের উপায় বলে ভেবে মানুষের মধ্যে মুখরোচক শব্দাবলি ছড়িয়ে দিয়ে অহেতুক কৌতূহল ও আশাবাদ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন, তারা রাজনীতির বড় ক্ষতি করেছেন।
হাসিনা-খালেদাকে এক জায়গায় আনার পথে যে ‘গোড়ায় গলদ’ আছে সেটা বুঝতে না পারলে, রাজনীতির মূল বিরোধগুলোর নিষ্পত্তি না করলে নতুন পথের সন্ধান পাওয়া কঠিন। শেখ হাসিনা একা এবং এককভাবে লড়াই করছেন। সাধারণ মানুষকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাছে পাওয়ার জন্য তাকে কিছু অপ্রিয় এবং সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে বলে অনেকেই মনে করেন। তিনি তা করবেন সে বিশ্বাস মানুষের আছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারসহ এমন কিছু কাজ তিনি ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছেন, যা অন্য কারো পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি টানেলসহ এমন সব নির্মাণকাজ সমাপ্তির পথে যেগুলো এক নতুন বাংলাদেশের পরিচয়বাহী। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভ, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ অনেকক্ষেত্রেই যে ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ আজ বিশ্ববাসীর নজর কাড়ছে তা সবই শেখ হাসিনার নেতৃত্বের দূরদর্শী ও সাহসী সিদ্ধান্তের কারণেই সম্ভব হয়েছে।
সে জন্যই এটা বলা যায় যে, শেখ হাসিনার সফলতা আসলে বাংলাদেশেরই সাফল্য। তাই তার সামনে জয়লাভের বিকল্প কিছু নেই। আজকের দিনে তাকে অভিনন্দন! তার সুস্থ দীর্ঘ জীবন কামনা করি।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক