বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভার্চুয়াল-জগৎ: চেনা পৃথিবীকে করছে অচেনা

  • লাভা মাহমুদা   
  • ১০ জুন, ২০২১ ১৫:৪৮

সবার আলাদা ভার্চ্যুয়াল-জগৎ; সে জগতে ঠাঁই হয় না স্বজন প্রিয়জন বা আপনজনদের। হারিয়ে গেছে মনোযোগ দিয়ে গল্প শোনার আনন্দ, পাশাপাশি বসে আড্ডা দেবার চমৎকার অনুভূতি, রাতের ঘুম, কাজের প্রতি গভীর মনোযোগ, মেধার বিকাশ হওয়ার ক্ষমতা, অনেক কিছু। আস্তে আস্তে নিঃসঙ্গতা গ্রাস করছে। ঝুঁকে পড়ছে মাদকের ভয়ঙ্কর নেশার দিকে। তৈরি হচ্ছে ভয়ানক জটিল সব মানসিক সমস্যা। এভাবেই আমাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তি, মনোযোগ, সময়, স্মৃতি, মনে রাখার ক্ষমতা...সব বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ক্লান্ত হয়ে কমিয়ে দিচ্ছে মস্তিষ্কের নিরঙ্কুশ কার্যকারিতা।

ডুয়ার্সের জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ের অংশবিশেষ, ক্রমান্বয়ে ঢালু হয়ে সমতল হওয়া গাছগাছালি ঘেরা, ঝোপজঙ্গলে ভরপুর কাঠের তৈরি বাড়িঘর আর সোঁদা মাটির গন্ধে ভরা উত্তরের সেই নিভৃত পল্লিতে বেড়ে ওঠার কালে আমার কাছে পৃথিবী বলতেই বাড়ির কাছের খেলার মাঠ, স্কুল, ধরলা নদীর ওপার আর কিছুটা দূরের রেললাইন, যার ওপর দিয়ে দিনেরাতে দুই কি তিনবার ট্রেন যাওয়া আসা করে। সেই পৃথিবীতে আমার মা বাবা, আত্মীয়-স্বজন, স্কুলের বন্ধুরাই ছিল আমার আপনজন, যারা আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখত। ঠিক যেন বিভূতিভূষণের অপু-দুর্গা।কিছুটা বড় হওয়ার পর পৃথিবীটাও বড় হতে থাকল, দৃষ্টি খানিকটা প্রসারিত হতে থাকল। দেখতে পেলাম সেই ছোট্ট জনপদের বাইরেও পৃথিবী আছে, সে পৃথিবী এত বড় যে, কোনো কূল কিনারার নাগাল পেতাম না।

সেসময় মানুষে মানুষে নৈকট্য দেখেছি, আন্তরিকতা দেখেছি। প্রায় বাড়িতে টিভি ছিল না। পুরো পাড়া বা গ্রামের মানুষ মিলেমিশে একসঙ্গে বসে হয়তোবা একটাই টিভি দেখত বা টিভি দেখার নামে আড্ডা দিত, কুশল বিনিময় করত।

প্রযুক্তির সহজলভ্যতার আগে মানুষ সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে একে অন্যের পাশে দাঁড়াত, ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তখন কেউই এতটা স্বার্থপর আর আত্মকেন্দ্রিক ছিল না । কারো প্রতি অন্যায় আচরণের আগে দশবার ভাবত। সবাই মিলেমিশে এক সমাজের বাসিন্দা হয়েই থাকত।এরপর এলো নব্বইয়ের দশক। সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বিপ্লবের যুগান্তকারী কারিগর মুঠোফোনের দশক। প্রযুক্তিকে নিজের পকেটে ঢোকানোর দশক। সেই শুরু। আর পেছনে হাঁটেনি মানুষ। আবারও ছোট হয়ে গেল পৃথিবী, তবে এবার ঠিক আগের মতো নয়। আগে জানার সীমাবদ্ধতার কারণে, আর এবার জানার অবাধ সুযোগের কারণে।গতির নিরন্তর ধারাবাহিকতায় সেই শিল্প বিপ্লবের কাল থেকেই এই রোবটিক যুগ পর্যন্ত মানুষের জানার আকাঙ্ক্ষার কোনো কমতি ছিল না। প্রযুক্তি দূরকে এনেছে নিকটে, অজানাকে বন্ধনীর ভেতর টেনে এনে গণ্ডিবদ্ধ করেছে। মানুষ চাইলেই এখন সবকিছু নিজের আয়ত্তে নিতে পারে।যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন আবিষ্কারের ফলে মানুষের চিন্তা-চেতনা ধীরে ধীরে উন্নত হতে থাকল; বেড়ে যেতে থাকল জীবনের গতিও। সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের বিলাসী দ্রব্যগুলো নিজের অধীনে নিতে শুরু করল। নিজের সুখ ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে ভুলেই গেল।

এখন কারো কাছেই দুদণ্ড সময় বা ইচ্ছে নেই, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কিংবা বসে দুটো মনের কথা বলার। সবাই ছুটছে অর্থ, ক্ষমতা, আরও প্রভাব প্রতিপত্তি বা অন্যকিছুর পেছনে। এই নিরন্তর চলায় নেই কোনো ক্লান্তি বা সন্তুষ্টি। উত্তরের সেই নিভৃত পল্লিতে আজ আর সোঁদা মাটির গন্ধ নেই, বুনো ফুলের তীব্র ঝাঁঝালো ঘ্রাণ নেই, আছে পাকা রাস্তা, উন্নয়নের চমক আর বৈদ্যুতিক বাতির ঝলমলে আলো।

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে আমাদের মধ্যকার যে রৈখিক দূরত্ব তা চোখের পলকে অতিক্রম করে প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলতে পারি, দেখতে পারি। দূরদেশে থাকা স্বজনরা আর এখন দূরে নয়, প্রতিমুহূর্তে সংযোগ রাখা যায়, ভালোমন্দের খবর জানা যায়। কী খাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে, আনন্দ-বেদনার সব খবরের সঙ্গী হওয়া যায়। পৃথিবীর বাইরে আর কোথায় বসতি গড়ে উঠতে পারে, মঙ্গলের মাটির রং কেমন, তা-ও ঘরে বসে জানা যায়।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাগলামি, বৃদ্ধ বাইডেনের তরুণ হয়ে ওঠার দৃশ্য... যা কল্প কাহিনিকেও হার মানায়, ভারতীয় কমলা হ্যারিসের বিশ্বের এক নাম্বার দেশের দ্বিতীয় ব্যক্তি হয়ে ওঠার গল্পও আর অজানা নয়।

জলবায়ু পরিবর্তনে আবহাওয়ার নেতিবাচক আচরণের তথ্যও মুহূর্তে জানা যায় যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে।অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছি আমরা। পঁয়তাল্লিশ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ, সাত শতাংশ জিডিপি, দুই হাজার ডলারের বেশি মাথাপিছু আয় নিয়ে ভারতকে পেছনে ফেলে তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে লাফিয়ে বাড়ছে প্রবৃদ্ধি, গর্বে বুক ভরে ওঠে।

প্রযুক্তির উৎকর্ষতা বাড়ার ফলে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি কমছে। আগাম সতর্কতার কারণে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রাণহানি কমছে। প্রযুক্তিই এক ফসলি জমিকে তিন বা চার ফসলিতে রূপান্তর করেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এনেছে আশাতীত সাফল্য। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ে মহামারির টিকা আবিষ্কার প্রযুক্তির প্রশ্নাতীত সাফল্য।তাই প্রযুক্তির সাফল্যগাথা নিয়ে নেই কোনো প্রশ্ন, সংশয় কিংবা অভিযোগ। বরং প্রযুক্তির কল্যাণেই এখন অসম্ভবের পাতাটি ছোট হয়ে আসছে। তবে আলোকের উলটো পিঠে যেমন অন্ধকার আছে, তেমনি প্রযুক্তির সাফল্যে আনন্দ অবগাহনের অপর দিকটিতেও আছে কষ্টকর অনুভূতি, ব্যথা, বেদনার উপাখ্যান। প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় আমাদের অনুভূতি হয়েছে ভোঁতা, ক্ষণস্থায়ী, অতিমাত্রায় সাজানো, লৌকিক।

আবেগের জায়গাটি খুব নড়বড়ে হয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধু-বান্ধব, প্রিয়জনের জন্মদিনে ফেসবুকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, মোহনীয় শব্দের ঝঙ্কার তুলছি। তেমনি মৃত্যু সংবাদে শোক সাগরে অন্যদের ভাসিয়ে নিজেও ভেসে যাচ্ছি। কারো সাফল্যে আনন্দের হিল্লোল বইয়ে দিচ্ছি। এই অনুভূতিগুলো খুব সীমিত সময়ের জন্য, তাৎক্ষণিক। কিছুক্ষণের ভেতর সবই ভুলে যাচ্ছি। অন্তত গোল্ডফিশ মেমোরির চেয়েও কম সময় আমাদের হৃদয়কে আলোড়িত করে। আনন্দ-বেদনা, কষ্ট-দুঃখ, বিস্ময়-ভয় ঘৃণা... সবকিছুই তাৎক্ষণিক।রাত জেগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কখন যে ভোর গড়িয়ে সকাল হয়ে দিনের অর্ধেকটাই চলে যায়, সেটা ভাবতেই আবার সন্ধ্যা চলে আসে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি রাতজাগার ক্লান্তিতে একসময় মস্তিষ্কও স্মৃতিশক্তির কার্যক্ষমতাকে ধরে রাখতে পারে না।প্রযুক্তির কারণে আমরা কাগজে ছাপানো বই পড়তে ভুলেই গিয়েছি। এখন পাতা উলটে পড়ার চেয়ে ই-বুক বা পিডিএফয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পাই। আগে একটা ভালো বই বা পত্রিকার জন্য তীর্থের কাকের মতো প্রতীক্ষা করতাম, এখন স্মার্টফোনের বাটনে চাপ দিলেই চলে আসে, সেই আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের দৈত্যের মতো। যেন যা হুকুম করব, তাৎক্ষণিকভাবে তা-ই এসে হাজির হবে। এখন আমাদের আর অপেক্ষা নেই, প্রতীক্ষা নেই।

তথ্য পাওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা নেই। তাই মনে রাখার বা আত্মস্থ করার তাগিদও নেই। আছে তীব্র নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্বের জীবনচিত্র। এখন আর পরিবারের সবার একসঙ্গে বসে খাওয়া, টিভি দেখা বা আড্ডা দেয়ার সময় হয় না।একই বাড়িতে একই পরিবারের সদস্যদের দেখা হয়, কথা হয় কালেভদ্রে। যদিও কখনও একসঙ্গে হয়, সবার হাতে থাকে ডিজিটাল ডিভাইস... ডুবে আছে নিজের জগতে। সবার আলাদা ভার্চ্যুয়াল-জগৎ; সে জগতে ঠাঁই হয় না স্বজন প্রিয়জন বা আপনজনদের।হারিয়ে গেছে মনোযোগ দিয়ে গল্প শোনার আনন্দ, পাশাপাশি বসে আড্ডা দেবার চমৎকার অনুভূতি, রাতের ঘুম, কাজের প্রতি গভীর মনোযোগ, মেধার বিকাশ হওয়ার ক্ষমতা, অনেক কিছু। আস্তে আস্তে নিঃসঙ্গতা গ্রাস করছে। ঝুঁকে পড়ছে মাদকের ভয়ঙ্কর নেশার দিকে।

তৈরি হচ্ছে ভয়ানক জটিল সব মানসিক সমস্যা। এভাবেই আমাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তি,মনোযোগ, সময়, স্মৃতি, মনে রাখার ক্ষমতা...সব বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ক্লান্ত হয়ে কমিয়ে দিচ্ছে মস্তিষ্কের নিরঙ্কুশ কার্যকারিতা। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, ডেটা, ওয়াইফাই, সার্চ ইঞ্জিন অর্থাৎ বিজ্ঞানের বেগের কাছে বন্ধক রেখেছি আমাদের সত্তা, আবেগ আর জীবনবোধের তীব্রতর অনুভূতিগুলোকে। হারিয়ে গেছে হাতে লেখা কাগজের চিঠি আর ডাকহরকরা।

যে চিঠির জন্য হরকরার ডাক শুনতে উৎকীর্ণ হয়ে থাকত প্রিয়তমা স্ত্রী, মা-বাবা আর সবাই। যে চিঠি ছুঁলেই ছুঁতে পারত হৃদয়, বুকের গভীরে মিশিয়ে নিতে পারত গলার ভেতরে দলা পাকানো মুষ্টিবদ্ধ আবেগকে। লোক দেখানো ভালোবাসা নয়, মায়া মমতার প্রগাঢ় বন্ধনে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আত্মাটাকে অন্তরের গোপন কুঠুরিতে সযত্নে রাখতে পারত সেই প্রিয়জনকে, যার দেখা পাওয়া গেল অনেকদিন পর।প্রযুক্তির কৃত্রিমতা বিনাশ করছে আবহমানকালের মায়া মমতা প্রেম ভালোবাসাকে। ভেতরে ভেতরে উইপোকায় খেয়ে ফেলেছে আমাদের সব সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জ্ঞান ও মূল্যবোধের চর্চার বিপরীতে জিপিএ পাঁচকেই মানুষ গড়ার কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে। এখন আমাদের অনেককিছু আছে, কেবল ভালো থাকার বোধটুকুই নেই। সংকুচিত হয়ে পড়েছে জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো।

আহ! আবার যদি ফেরত আসত ‘সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি’।

লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক

এ বিভাগের আরো খবর