তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসের একটি চরিত্র নিতাই। নিতাই একসময় প্রেমে পড়েন। পাশের গ্রামেই থাকেন তার মনোজগতের প্রেয়সী। তার গায়ের রং কালো। তিনি অন্যের স্ত্রী। তাকে ঘিরেই নিতাইের মনে ভাবের উদয়। নিতাই গান বাঁধেন- ‘কালো যদি মন্দ তবে, কেশ পাকিলে কান্দ ক্যানে...’। নিতাইয়ের এ হলো এক গভীর দার্শনিকতা।
কালো যদি এতই অপাঙক্তেয় হয় তাহলে চুল পাকলে সবাই পীড়িত হয় কেন? কালো চুল সাদা করতে বিনিয়োগ করে, ছুটোছুটি করে কেন? কারণ, সাধারণ বিশ্বাস কালো তারুণ্যের প্রতীক। কিন্তু তা সবসময় নয়। বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। মানুষের শরীরের কালো রং তৈরি করেছে নির্মম ইতিহাস।
সাদা ও কালোর রাজনীতি নতুন কিছু নয়। এ রাজনীতির কেন্দ্রে রয়েছে সাদারা। কারণ, সাদারাই শাসক। সাদারাই শক্তিশালী। সাদারাই নিয়ন্ত্রক। সাদারই মস্তিষ্ক প্রক্ষালক। সাদারা কালোকে ঘৃণিত ও অসভ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে সাদা রঙের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে। এক রঙের পৃথিবী গড়তে। এ হলো প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতি এক গভীর আস্থাহীনতা। কারণ, প্রকৃতি একরৈখিক নয়। বহুরৈখিক। বহুরঙের সমষ্টি। মানুষ কখনও কখনও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য অস্বীকার করে চলতে চায়। এ হলো এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, বড় করপোরেট হাউস দাঁড়িয়েছে সাদার পক্ষে। আজ বারো বছরের শিশুসন্তান টেলিভিশন দেখে জিজ্ঞেস করে, বাবা টিভিতে তো ব্লাকস্কিনের কাউকে দেখি না। সত্যি তো ফেয়ার স্কিন না হলে কোথাও তা দেখানো যায় না। আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতায় প্রদর্শনবাদের মূল মুখপত্র সাদাস্কিন। বড় সব প্রতিষ্ঠান বিশেষত বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো সাদাকরণের দীক্ষায়ণ দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত তা মস্তিষ্কে গেঁথে দেয়া হচ্ছে জাদুর টোটার মতো।
অধ্যাপক আজফার হোসেন তার দর্শনাখ্যান গ্রন্থে সাবান প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন- একসময় বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপন ছিল ‘সাবানই সভ্যতা’। এর মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক বৈধতা আজও বিরাজমান। তিনি আরও উল্লেখ করেন, সাদা ছাড়া পরিষ্কার ও সুন্দর হওয়া যায় না এমন ধারণা যুক্ত হয়ে আছে। কারণ, সাদাই সুন্দর, সাদাই সভ্যতা ও সাদাই কাঙ্খিত।
ফেয়ার অ্যান্ড লাভলিসহ নানা উৎপাদক যুক্ত হয়েছে এ ধারায়। অনেকে আত্মপরিচয় ভুলে সাদাকরণ প্রকল্পে ঝাঁপ দিচ্ছে। একসময় স্লোগান ছিল ব্লাক বাই ন্যাচার, প্রাইড বাই চয়েস। আজ কম বেশি সবাই তা ভুলতে বসেছে।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এক নিকটজনের শিশু সন্তানের স্কিন হলো কালো। স্কিন কালো হওয়ার কারণে স্কুলে বন্ধুদের বুলিংয়ের শিকার হতে হয় শিশুটিকে। একদিন বাসায় ফিরে শিশুটি বাবা-মাকে চার্জ করছে কোনো আমার স্কিন ব্লাক? উত্তর দাও? অবশেষে শিশুটি বলে এ ব্লাকস্কিন সে রাখবে না। কেবল প্রাপ্তবয়স্করা নয়, কোমলমতি শিশুদের মনে গেঁথে দেয়া হচ্ছে উগ্র সাদাপ্রীতি।
কালো রংকে কেবল ঘৃণা নয়, অপরাধের সমরূপক হিসেবেও দাঁড় করানো হয়েছে। যেমন-কালোটাকা, কালোবাজারি, কালোতালিকা। এগুলো সাদা করলেই শুদ্ধ হয়ে যায়। জাতীয় সংসদে মাশুল দিয়ে কালোকে সাদা বানানোর সুযোগ দেয়া হচ্ছে।
কালোকে দেখা হয় নিন্দাসূচক হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুলেখা কালির বিজ্ঞাপনে লেখেন, এ কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো। অথবা কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক যখন বলেন, ‘রাজশাহী নগরী এখন সাঁওতাল মেয়ে থেকে সুন্দরী রমণীতে’ পরিণত হয়েছে তখন অনেককে প্রতিবাদ করতে হয় একে পুরুষতান্ত্রিক ও বর্ণবাদী মন্তব্য বলে।
সবাই অন্ধকার থেকে আসে এবং অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। অন্ধকার কালোর সমরূপক। অথচ কালো রঙের প্রতি আমাদের কোনো ন্যায়বোধ কাজ করে না। এ রংটি অস্বীকার করি অবলীলায়। মনে রাখতে হবে, মানবসভ্যতার সংরক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে কালো কালির হরফের ওপর। সাদা কাগজের ওপর কালোকালি শাসন চলছে দুর্দান্ত প্রতাপে। কালো কালি দিয়েই লেখা হচ্ছে সাদার ইতিহাস।
এ লেখাটি লেখার আগে একশটি ফুলের রং বিন্যাস বিশ্লেষণ করা হয়েছে। শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ ফুলের কেন্দ্রে দেখা গেছে কালো টিপ। কালোর অবস্থান প্রকৃতির কেন্দ্রে।
মহাত্মা গান্ধী যেমনটি বলেছিলেন, চোখের বদলে চোখ নেয়ার নীতি মানবজাতিকে অন্ধ বানিয়ে ফেলবে। একইভাবে সাদা রঙের প্রতি বিশেষ পক্ষপাত আর কালো রঙের প্রতি প্রত্যাখ্যান মানবিক ফাটলকে বিস্তৃত করছে।
মানুষ যে কালোকে ঘৃণা করতে শিখলাম তার ইতিহাস কিন্তু সাদামাটা নয়। নেলসন ম্যান্ডেলা তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে লং ওয়াক টু ফ্রিডম-এ বলেছেন-ঘৃণা করতেও শিখতে হয়। যদিও ঘৃণা করতে শিখাটা বেশ কঠিন।
অপরদিকে, ভালোবাসতে শেখাটা সহজ যা প্রাকৃতিক উপায়ে মানুষ অনায়াসে রপ্ত করতে পারে।
মানুষ কালো রং ঘৃণা করতে শিখল এবং তা শিখল এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায়। দু শ বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসন এ শিক্ষাকে পোক্ত করল। হৃদয়ের শুভ্রতা মুছে সাদার প্রেমিক হয়ে উঠল। কালোর প্রতি ঘৃণা হয়ে উঠল কঠিন এক সামাজিক প্রপঞ্চ। এ আঘাত পারমাণবিক বোমার আঘাত নয়। কিন্তু এর অভিঘাত তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
সত্নে সাদাকে বুকে ধরে কালোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চাই আমরা। কিন্তু তা তো চাইলেই হবে না। চোখের মধ্যখানে কালো রং যে শেকড় গেড়েছে। কালোকে প্রত্যাখ্যান করতে হলে চোখ তো সরাতে হবে সবার আগে। যে দেখায় তাকে কি অস্বীকার করা যায়?
উপনিবেশিক হেজিমনির উত্তরাধিকার হিসেবে কালোর প্রতি প্রত্যাখ্যান মর্যাদাহীন সমাজের দীর্ঘপ্লট তৈরি করেছে। সাদা মানে সুন্দর আর কালো মানেই কুশ্রী এমন প্রতীতী জেঁকে বসেছে মানসপটে। এ সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যখন পুরুষতন্ত্র এসে যুক্ত হয়েছে, তখন তা হয়ে ওঠে আরও ভয়াবহ। এমন পরিস্থিতিতে গ্রামের একজন দরিদ্র ও বয়স্ক অভিভাবককে বলতে হয়- মেয়েটি গায়ের রং কালো, বাবা তাই বিয়ে-সাদি দেয়া কঠিন হচ্ছে। রং আর পুরুষতন্ত্রের সর্দারির অভিঘাত নারী-পুরুষ ভেদে সমান নয়।
জীবন অভিজ্ঞতায় দেখেছি- গায়ের রং কালো হওয়ার কোনো পাত্র পাওয়া যাচ্ছিল না বিলাসী গ্রামের জরিনা বেগমের। অবশেষ যে পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হলো তিনি ছিলেন সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। এটি ছিল পুরুষটির দ্বিতীয় বিয়ে। পুরুষটির প্রথম বৌ মারা যান দুটি সন্তান রেখে। দুটি সন্তান জন্ম নেয়ার পর ওই পুরুষ জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য ভ্যাসেকটমি করান।
সবাই জানত তিনি ভ্যাসেকটমি করিয়েছেন তারপরও অভিভাবকেরা মেয়েটির সঙ্গে পুরুষটির বিয়ে দেন। মেয়েটিকে পাত্রস্থ করাই অভিভাকদের কাছে ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। গায়ের রং মেয়েটির মা হওয়ার স্বপ্ন ধুলায় মিলিয়ে দেয়। প্রজননের অধিকার নেই জেনেও ঘর বাঁধতে বাধ্য হন। কারণ, তার সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো ক্ষমতা ছিল না।
এ কালো রঙের কারণে নেলসেন ম্যান্ডেলাকে সাতাশ বছর আর আলবার্ট উডফক্স চুয়াল্লিশ বছর বিনা অপরাধে জেল খাটতে হয়েছে। দুজনের আত্মজীবনী হলো বর্ণবাদী নিষ্পেষণের মহাকাব্য। সুখের খবর হলো তারা কেউ ভেঙে পড়েননি। এ নিষ্পেষণ তাদের আরও মহৎ করেছে। তারা বর্ণবাদের চোরাবালিতে আটকে যাননি। মানুষের জয়গান গেয়েছেন।
একইভাবে অ্যালেক্স হেলি তার রুটস্ উপন্যাসে আফ্রিকার কালো মানুষদের ওপর নিপীড়নের করুণ কাহিনি তুলে ধরেছেন। এ কালজয়ী সৃষ্টির বাংলা অনুবাদ করেছেন গীতি সেন। রুটস্ উপন্যাসের শেষের লাইনে অ্যালেক্স হেলি উল্লেখ করেছেন -এ জগতে ইতিহাস রচনার অধিকার একমাত্র বিজয়ীদের নয়। নিপীড়িতজনদের রচিত ইতিহাস কোনো কোনো ক্ষেত্রে মহত্তর হয়ে ওঠে। সত্যি তাই।
মানুষের পরিচয় রঙের ঘেরটোপে আটকে ফেলা যাবে না। মানুষকে দেখতে হবে মানুষ হিসেবে। রং রাজনীতির ঊর্ধ্বে। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার মানুষ জাতি কবিতায় উল্লেখ করেছেন ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবারি সমান রাঙ্গা’।
একই সঙ্গে মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাসকেও স্মরিতে হয়-‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিশ্লেষক