‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ সিনেমাটি যখন হাউজফুল হয়ে সারা দেশের প্রেক্ষাগৃহে মাসের পর মাস ধরে চলছে, তখন আমাদের শিক্ষক ড. সাখাওয়াৎ আলী খান স্যার বলেছিলেন, যোগাযোগের ছাত্রছাত্রী হিসেবে তোমাদের জানা উচিত কেন বেদের মেয়ে জ্যোৎস্নার মতো এরকম একটি ফোক-ফ্যান্টাসি সিনেমা ব্যবসাসফল হলো, কেন দর্শকহৃদয় জয় করল? তিনি এটা আমাদের অ্যাসাইনমেন্টও দিয়েছিলেন।
৭০/৮০ এবং ৯০ দশকের প্রথম ভাগ ছিল আমাদের বাংলা সিনেমার জন্য ভালো সময়। অসংখ্য ভালো সিনেমা তৈরি হয়েছে। সেরকম একটি সময়ে বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না চলচ্চিত্রটি অন্যধরনের সিনেমা ছিল। আমাদের মধ্যবিত্ত মন এই সিনেমাকে খুব একটা গ্রহণ না করলেও বাংলা সিনেমার জগতে এটি হিট হয়েছিল সাধারণ মানুষের ভোটে। সিনেমাটি ভিন্ন মেজাজের হলেও এক ধরনের মজা ছিল। অথচ এখন সেই বাংলা সিনেমার জগতে আকাল নেমে এসেছে। আজেবাজে কাহিনি ও অশ্লীলতায় পূর্ণ সিনেমাগুলো। অল্প কিছু মানসম্মত ও জীবনধর্মী সিনেমা বাজারে টিকে থাকতে গিয়ে খাবি খাচ্ছে। বলা যায় একটা পুরো ইন্ডাস্ট্রি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে।
ফিরে আসি সাখাওয়াৎ স্যারের অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া প্রসঙ্গে। স্যার যদি এসময় এসে তার ছাত্রছাত্রীদের অ্যাসাইনমেন্ট দিতে চান, তাহলে তাকে বলতে হবে, কেন সব বাদ দিয়ে কাকলি ফার্নিচার, হিরো আলম, আরমান আলিফের অপরাধী বা দামান-নাইওর গানটির জনপ্রিয়তার তুঙ্গে?
আমাদের রুচির যে অধঃগতি হচ্ছে, তা রোধ করে কার সাধ্য? পত্রিকায় একটি খবরে দেখলাম, ‘শুক্রবার দুপুরে যখন তিনি বিমান থেকে নামলেন তখন বেসরকারি বিমান সংস্থার কর্মকর্তা থেকে কর্মীরা তাকে ঘিরে ধরে মোবাইলে সেলফি তুলতে শুরু করেন।’ এই তিনিটি হচ্ছেন কোট-স্যুট পরা আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম। হিরো আলম বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন রংপুরের একটি খাতনা অনুষ্ঠানে। তাকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আবার শেষ ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরিয়ে দেয়া হবে।
হিরো আলম কে, কেমন, কী মানের গায়ক বা অভিনেতা সেকথা আমরা আমাদের মতো করে জানি। আমরা অনেকেই হিরো আলমকে নিয়ে হাসাহাসি করি, বিরক্ত হই। অথচ দেশে তার ফলোয়ার ও ইউটিউব ভিউয়ারের সংখ্যা অসংখ্য। এই যে মানুষ তাকে প্লেনে করে অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, এও কি তার মুকুটে একটি পালক যোগ করা হলো না? হ্যাঁ তার মুকুটে পালক যোগ হলো ঠিকই কিন্তু তার এই জনপ্রিয়তা দেখে বাংলাদেশের শ্রোতা-দর্শকের রুচিবোধ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাও স্বাভাবিক নয় কি? তার গানকে সংগীতের কোনো মানেই তাকে ফেলা যায় না। তাহলে সে অসংখ্য মানুষের প্রিয় হয়ে উঠলো কেমন করে?
গান, নাচ, নাটক বা চলচ্চিত্র সবই একটা চর্চার বিষয়। সবকিছুরই একটা মানদণ্ড আছে। সুর, লয়, তালহীন কোনো কিছুকে গান বলা যায় না। অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গী করে, উদ্ভট পোশাক পরে, বাজে উচ্চারণে কিছু করাকে কি গান বলা যায়? ফান করে এগুলো শোনা যায়, কিন্তু অর্থহীন এসব ‘গান’ যখন মানুষের কাছে আদৃত হয়, তখন বুঝতে হবে আমাদের দেশের দর্শক-শ্রোতাদের রুচির মান নেমে যাচ্ছে।
এরপর এলো দামান বা নাইওর বিষয়ক একটি গান, অপরাধী নামে আরেকটি গান সেরাদের তালিকায়। মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউজ। বাংলাদেশে ভালো গায়ক-গায়িকার অভাব নেই। লোক সংগীত, বাউল গান, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল বা আধুনিক গানের নতুন-পুরোনো মিলিয়ে অনেক শিল্পী রয়েছেন, যাদের গান হয়ত শ’খানেকও ভিউ হয়নি। তাদের অনেকেরই ভিডিও হিরো আলমের মতো ভাইরাল হয় না বা জনপ্রিয়ও নয়। আমরা জানি যে দেশের সাড়া জাগানো একজন লোকসংগীত গায়িকার যখন ৫/৬ শত সিডি বের হয়ে গেছে বাজারে, তখন কলিম শরাফীর মতো গায়ক ও বিদগ্ধ জনের সিডি বের হয়েছিল মাত্র ৪/৫টি।
দেশে এখন যেসব গান-নাচ চালু হয়েছে, যা ভাইরাল হচ্ছে, টিকটক-লাইকির মতো অ্যাপ ব্যবহার করে তরুণ-তরুণীদের ডিজে পার্টির যে নাচ গান, এর কোনোটাই সুস্থ সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে না। আমরা কি লক্ষ করছি যে, আমাদের উচ্চশিক্ষা বলেন, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, পেশা, নাটক, চলচ্চিত্র সবক্ষেত্রেই চরম নিম্নগামী যাত্রা। প্রযুক্তিতে কিছু ভালো অর্জন থাকলেও, অন্যান্য ক্ষেত্রে দুর্বলতা এই অর্জনকে ঢেকে দিতে বাধ্য। বরং এই প্রযুক্তির অপব্যবহার একটি প্রজন্মকে ভয়াবহ বিপদের মুখে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
কোনো ভিনদেশি মানুষ যদি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগৎ সম্পর্কে জানতে সার্চ ইঞ্জিনে যান, দেখবেন ভেসে উঠেছে হিরো আলম, তুই অপরাধী ঘরানার গান, নাটক ও চলচ্চিত্র। কারণ এগুলোর ভিউ বেশি। ভার্চুয়াল জগতে এভাবেই কোনোকিছুর মূল্য নির্ধারিত হয়। মজা করে হোক কিংবা কারো কারো ভালো লাগে বলেই হোক এভাবেই ধীরে ধীরে আমাদের সংস্কৃতির একটা মান দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য গর্বের নয়। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার আকাল চলছে, তা ক্রমশ বাড়ছে।
আমরা খুব সহজে অনুকরণ করতে পারি। বলতে পারেন আমাদের এই অনুকরণ প্রিয়তার অন্যতম কারণ হচ্ছে পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার। পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে যারা ভোগেন তারা জীবনকে অনুকরণ করেন, তারা কখনও বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিত অর্থ ঠিকমতো বোঝে না, তাদের কগনিটিভ লিমিটেশনের জন্য। কোনো বিষয়ের মূল বিষয় বোঝার ক্ষমতা তাদের কখনই হয় না। যার ফলে তাদের দূরদৃষ্টি থাকে না। এখন যা আছে, তার মধ্যেই সমাধান খুঁজে ফেরে। এই কারণেই অনুকরণ অনুসরণ পর্যন্ত আমরা খুব ভালো পারি এবং তারপরেই সব শেষ। আর তাই প্রতিটি পদক্ষেপেই আমরা ভুল করে যাচ্ছি।
কথা প্রসঙ্গে মনে পড়ল কাকলি ফার্নিচারের বিজ্ঞাপনের কথা। শোনা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বাজার কাঁপিয়ে দিয়েছে কাকলি ফার্নিচারের বিজ্ঞাপন। ফেসবুকে কাকলি ফার্নিচারের কথা শুনতে শুনতে মনে হলো একবার বিজ্ঞাপনটা দেখা দরকার। দেখে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, এত সস্তা ও অরুচিকর একটি বিজ্ঞাপন কেন পশ্চিমবঙ্গ মাতাবে, তা বোঝা খুব কঠিন। কাকলি ফার্নিচারের এই বিজ্ঞাপনের চেহারা, ছবি, মেকিং, সংলাপ সবই কুরুচিকর ও স্থূল। এর চেয়ে অনেক ভালো ভালো বিজ্ঞাপন কি আমরা তৈরি করিনি? করেছি। কিন্তু ভাইরাল হলো এই বাজে বিজ্ঞাপনটি! এর মানে ভার্চুয়াল মিডিয়ায় টিকে গেল এই কাকলি ফার্নিচার। বাইরের মানুষ জানবে কাকলি ফার্নিচারই বাংলাদেশের ব্র্যান্ড।
আমাদের সংস্কৃতিতে এই বিপর্যয় একদিনে হয়নি। আগে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় ছোটখাট লাইব্রেরি ছিল, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের বইয়ের গাড়ি আসত পাড়ায় পাড়ায়, খেলাঘর, চাঁদের হাট, কচিকাঁচার আসর, গার্লস গাইড, বয়েজ স্কাউটের মতো শিশু সংগঠনগুলো শিশু- কিশোরদের সুস্থ সংস্কৃতির ধারণা দিত। ক্রমশ সব হারিয়ে গেল। সেখানে উঠে এলো ভিন্ন সংস্কৃতির আগ্রাসন। আমরা ভিনদেশি সংস্কৃতির মধ্যে থেকে ভালো-মন্দের বিচার করতে পারলাম না। ফলে অদ্ভুত একটা জগাখিচুড়ি মার্কা সাংস্কৃতিক জগতে এসে পড়লাম।
শিক্ষা-সংস্কৃতি এমন একটি জায়গা, যেখানে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অনুদান লাগে, সহায়তা ও অনুপ্রেরণা লাগে। শিশুকাল থেকেই এই সহযোগিতা প্রয়োজন। তা না হলে, এই খাত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে পারে কিন্তু বিকশিত হয় না। বাংলাদেশে পরিবারগুলো হয়ে পড়েছে হিন্দি কালচার-নির্ভর, সমাজ হয়ে যাচ্ছে টিকটক ও লাইকি-নির্ভর, আর সরকার মনে করে সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য ভবন নির্মাণ করে দিলেই হয়। দেশব্যাপী সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে হয় না কোনো কবিতা উৎসব, নেই কোনো নাট্য উৎসব, চলচ্চিত্র আয়োজন, শিশু-কিশোর মেলা। যা কিছু হয়, সব লোক দেখানো। আমাদের ভালো নাটক, সিনেমা, নতুন কুঁড়ি ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা সব কোথায় হারিয়ে গেল?
অবশ্য এদেশে শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্রম নিম্নগামী তা এই খাতে সরকারের বাজেট বরাদ্দ দেখলেই বোঝা যায়। এক দশক ধরে সংস্কৃতিকর্মীদের চাওয়া, দেশের মোট বাজেটের ১ শতাংশ হোক সংস্কৃতির। সেই চাওয়া আজও পূরণ হয়নি। আমরা ভুলে যাচ্ছি একটি দেশের অন্যতম বড় পরিচয় সে দেশের সংস্কৃতি। আরেকটা কথা হচ্ছে, আমরা যদি দেশব্যাপী সংস্কৃতির জাগরণ চাই, শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক উৎসব দিয়ে হবে না। তৃণমূলে যেসব সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ক্লাব আছে, ওদেরও প্রণোদনা দিতে হবে। যাতে তারা নিজেদের মতো করে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারে। নতুবা দেশের সাংস্কৃতিক পরিচিত হবে কিশোর গ্যাং, টিকটক হৃদয়, আমি অপরাধী, হিরো আলম, কাকলি ফার্নিচার দিয়ে।
লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন