বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সন্তানকে নীতি-নৈতিকতায় আবদ্ধ করা জরুরি

  •    
  • ৯ জুন, ২০২১ ১৩:১৩

সন্তানকে আপনি যত বেশি স্বাধীনতা দেবেন, সে আপনার কাছ থেকে তত দূরে সরে যাবে। আপনি তার উপর যত বেশি নিয়ন্ত্রণ হারাবেন, সে তত বেশি বখে যাবে। আপনি জানবেনও না সে কাদের সঙ্গে মেশে, কী করে, কী দেখে, কী করতে চায়। তার ভেতরে ভেতরে কী পরিবর্তন হয়ে গেছে, সেটি আপনি টেরও পাবেন না। সুতরাং, সন্তানকে স্বাধীনতা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবক যদি তার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ হন, তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে; হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান। ২০১৫-১৬ সেশনের ছাত্র সংস্কৃতি অঙ্গনেরও পরিচিত মুখ ছিলেন। মূকাভিনয় করতেন। তিনি টিএসসি-ভিত্তিক সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইম অ্যাকশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন।

তিনি গ্রামের ছেলে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার খাড়েরা গ্রামের সন্তান। ভর্তি হয়েছিলেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন মানে তিনি মেধাবী ছিলেন। নিশ্চয়ই একটি বড় স্বপ্ন সঙ্গে নিয়ে দূর মফস্বল থেকে আলোঝলমলে রাজধানীতে এসেছিলেন এই তরুণ। আমরা জানি না তিনি কী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভালো ফলাফল করে বেরিয়ে গেলে তার সামনে নিশ্চয়ই একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছিল। যেহেতু মুকাভিনয়ের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, ফলে এই পরিচয়টিও তার ক্যারিয়ার গড়তে হয়ত সহায়তা করত। কিন্তু কিছুই হলো না। বিকশিত হবার কালেই ঝরে গেল একটি ফুল।

ঈদের পরদিন জরুরি কাজের কথা বলে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন হাফিজুর। এরপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে কসবা থানায় একটি জিডি করা হয়। ৮ দিন পর ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে হাফিজুরের লাশ শনাক্ত করেন তার বড় ভাই। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাই-ইথ্যালামাইড) সেবন করেছিলেন এই তরুণ। আর তারপরই বিভ্রম ঘটায় নিজের গলায় ধারাল দা দিয়ে আঘাত করেন। এতে তার মৃত্যু হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে শাহবাগ থানার ওসি সাংবাদিকদের বলেছেন, ১৫ মে রাত পৌনে ৮টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলা নিজেই কাটতে থাকেন হাফিজুর। আর বলছিলেন ‘আমাকে মাফ করে দাও’। হাফিজুর কার কাছে মাফ চাইলেন? কেন মাফ চাইলেন? তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে? আমরা কি তাকে মাফ করতে পেরেছি?

হাফিজুরের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে গিয়ে গোয়েন্দারা যে তথ্য পেয়েছেন, সেটি আমাদের অনেকগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। যেসব প্রশ্নের সুরাহা করা না গেলে আমরা হাফিজুরকে ক্ষমা করলেও হাফিজুরের আত্মা হয়ত আমাদের মাফ করবে না। আমরা দায়ী থাকব তার মতো অসংখ্য তরুণের কাছে। আমরা দায়ী থাকব এই সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে। আমরা দায়ী থাকব এই সময়ের কাছে।

মৃত্যুর আটদিন পরে ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে হাফিজুরের পরিচয় শনাক্ত হয়। এর পর এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ খুঁজতে নেমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।

এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে হাফিজুরের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সঙ্গে এলএসডির যোগসূত্র খুঁজে পাওয়ার কথা জানায় ডিবি। এর আগে নানারকম মাদকের ছোবল, বিশেষ করে ইয়াবার ভয়াবহতার কথা মানুষ জেনেছে। কিন্তু এলএসডির খবর সেভাবে জানা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলএসডি এক ধরনের বিভ্রম তৈরি করে।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, এলএসডি গ্রহণের পর বন্ধুদের একজন হাফিজুরকে বলেছিলেন, ‘মামা তুমি কাজটা ভালো করনি’। এরপর হাফিজুর কার্জন হলের মাঠ থেকে ছুটে বেরিয়ে যান। বন্ধুরা একবার সেখান থেকে ধরে এনেছিলেন।

এরপর তিনি আবার বেরিয়ে যান। কয়েকজন রিকশাচালকের পা চেপে ধরে বলেন, ‘আমাকে মাফ করে দাও’। এরপরই তিনি ডাবওয়ালার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলায় কোপ দেন। হাফিজুরের অবস্থা দেখে ভয়ে কাউকে কিছু না বলে বন্ধুরা পালিয়ে যান।

প্রশ্ন হলো, এলএসডির মতো এই ভয়াবহ মাদক কী করে দেশে ঢুকল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেহেতু এই মাদক গ্রহণ ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে অনেককে গ্রেপ্তার করেছে, ফলে বোঝাই যাচ্ছে অনেক দিন ধরেই এই মাদক দেশে আসছে।

ঠিক কত তরুণ ও যুবক এরইমধ্যে এই মাদকে আসক্ত হয়েছেন, সেই তথ্য জানা খুব কঠিন। যেহেতু এই মাদক বিদেশ থেকে আসে, সুতরাং এর সঙ্গে নিশ্চয়ই বিশাল চক্র আছে এবং সেই চক্রে হয়ত প্রভাবশালী কোনো গোষ্ঠীও জড়িত। এই চক্রকে ধরতে না পারলে এরকম আরও অনেককে হাফিজুরের পরিণতি ভোগ করতে হবে। অনেক স্বপ্নের অপমৃত্যু হবে। অনেক বাবাকে তার সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়ে করবস্থানে যেতে হবে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভেতরে কী হচ্ছে, কী রকম গ্যাং ও গ্রুপ তৈরি হচ্ছে, এলএসডির মতো ভয়াবহ মাদক কী করে সেখানে থাবা বসাচ্ছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কি এর দায় এড়াতে পারে? বিশ্ববিদ্যালয় শুধু পড়া মুখস্থ করা এবং তারপর একটি সার্টিফিকেট প্রদানের জায়গা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একজন তরুণের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।

তার জীবনবোধ গড়ে তোলাই শিক্ষকদের প্রধান কাজ। যদি সত্যিই শিক্ষকরা তাদের সেই দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তাহলে হাফিজুরের মতো তরুণরা কি এলএসডির মতো ভয়াবহ মাদকে আসক্ত হতে পারতেন? ফলে আমরা যখন হাফিজুরের মৃত্যু নিয়ে কথা বলি, তখন এসব প্রশ্নও সামনে আনতে হবে।

তৃতীয় প্রশ্ন হলো, হাফিজুরের মতো যে মেধাবী তরুণরা মফস্বল থেকে ঢাকায় এসেছেন নিজের জীবন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে অথবা যে তরুণরা ঢাকায়ই বেড়ে উঠেছেন এবং তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, তারা কোথায় যায়, কী করে, কাদের সঙ্গে মেশে— সেই খবর কি পরিবারগুলো ঠিকমতো রাখছে বা রেখেছে? এখানে অভিভাবকরা কি তাদের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন? শুধু সন্তান জন্ম দেয়াই কি অভিভাবকের কাজ?

অস্বীকার করার উপায় নেই, সন্তানকে আপনি যত বেশি স্বাধীনতা দেবেন, সে আপনার কাছ থেকে তত দূরে সরে যাবে। আপনি তার উপর যত বেশি নিয়ন্ত্রণ হারাবেন, সে তত বেশি বখে যাবে। আপনি জানবেনও না সে কাদের সঙ্গে মেশে, কী করে, কী দেখে, কী করতে চায়। তার ভেতরে ভেতরে কী পরিবর্তন হয়ে গেছে, সেটি আপনি টেরও পাবেন না। সুতরাং, সন্তানকে স্বাধীনতা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবক যদি তার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ হন, তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে; হচ্ছে।

স্মরণ করা যেতে পারে, রাজধানীর বনানীতে দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় সাফাত আহমেদ নামে যে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেছিলেন, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যে অপরাধ, তা তিনি জানেন না। তার ভাষ্য, তারা ‘মেয়ে বন্ধুদের’ সঙ্গে প্রায়ই পার্টিতে ‘এমনটা’ করে থাকে। জিজ্ঞাসাবাদে উপস্থিত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা এতে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাদের ভাষ্য, ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হিসেবে সাফাত উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন করত। অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে তার স্বাভাবিক বলেই মনে হতো।

প্রশ্ন হলো, কী ধরনের সমাজ আমরা নির্মাণ করেছি এই তরুণদের জন্য? কী ধরনের পারিবারিক কাঠামোর ভেতরে তারা বেড়ে উঠেছে? কী ধরনের মূল্যবোধ তারা পরিবার থেকে শিখেছে? সুতরাং সাফাত যে কথা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, এই অপরাধে কেবল তার একার নয়, তার অভিভাবকদেরও কি শাস্তির আওতায় আনা উচিত নয়? যারা ধর্ষণের মতো একটা গুরুতর অপরাধকেও অপরাধ বলে তাদের সন্তানদের শেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন?

আমরা মনে করতে পারি ফরিদপুরের স্কুলছাত্র ফারদিন হুদা মুগ্ধর কথা, নতুন মোটরসাইকেল না পেয়ে যে তার বাবাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। আমরা স্মরণ করতে পারি, ভোগবিলাস আর প্রাচুর্যের ভেতরে বেড়ে ওঠা পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমানের মেয়ে ঐশীর কথা, যে তার বাবা মাকে হত্যা করেছিল।

রাজধানীর এজিবি কলোনির বাসিন্দা গণপূর্ত বিভাগের হিসাব সহকারী রুনা আক্তারের কথাও আমরা ভুলিনি, যিনি স্থানীয় কিছু বখাটে যারা মোটরসাইকেল নিয়ে ওই এলাকার বাইকসন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছিলেন। এরকম আরও বহু ঘটনা আছে শুধু রাজধানীতেই। এসব তারুণ্যের বখে যাওয়ার পেছনে প্রথমত রয়েছে তাদের অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন, নৈতিক মূল্যবোধ না শেখানো এবং সন্তানের উপর নজরদারি রাখতে অভিভাবকের ব্যর্থতা।

অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে এসব তরুণের অভিভাকের অনেকেই ব্যক্তিজীবনে অসৎ। অবৈধ আয়ে সন্তানদের বড় করেছেন। সুতরাং তাদের আয়ের উৎস চিহ্নিত করে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে না পারলে সামাজিক চাপে এরকম দুচারজন সাফাতের হয়ত বিচার হবে কিংবা উপযুক্ত নজরদারির অভাবে হাফিজুরের মতো অনেক তরুণ হয়ত বিকশিত হবার কালেই নিজের গলায় ডাব কাটার ধারাল দা দিয়ে নিজের গলায় কোপ দিয়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে; কিন্তু পৃথিবীর যে গভীরতর অসুখ—সেটি সারবে না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর