বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার বিগত একযুগ ধরে যেভাবে একের পর এক বিশাল আকৃতির বাজেট দিয়ে আসছেন তাতে একটি বিষয় পরিষ্কার যে স্বাধীনতার ৫০ বছর বিভিন্ন দল ও সরকার দেশ পরিচালনা করতে যেয়ে প্রতিবছর বাজেট পেশ করলেও সেই বাজেটের আকার সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি যতটা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের দুই মেয়াদের বিএনপির শাসনামলে বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেয়েছিল যথাক্রমে ৩৫% এবং ৩৬%। অথচ ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেয়েছিল ৫৭%।
আবারও ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০-১১ সালের জন্য বাজেট দিয়েছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকার যার আকার বর্তমান ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে এসে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের একযুগ শাসনামলে বাজেটের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৫৭%।
যাহোক আগামী বেশ কদিন এই বাজেট নিয়ে দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞগণ বাজেটের নানাদিক নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করবেন এবং তাদের মতামত প্রদান করবেন। সেসঙ্গে বিভিন্ন মহলে এই বাজেটের পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকবে। আর এটাই স্বাভাবিক। কেননা একেকজন একেক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেন বিধায় বিশ্বের কোনো বাজেটই আলোচনা-সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। সবচেয়ে বড় কথা সরকার বিগত বছরের বাজেটের ধারাবাহিকতা এই করোনাকালে জরুরি এবং অনিশ্চিত সময়ের বাজেটেও বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
তবে বাজেটে ছোট্ট একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যা সরকারের এই বিশাল আকৃতির বাজেট প্রণয়নের প্রশংসনীয় উদ্যোগ ও সাহসী পদক্ষেপ সমালোচিত হতে পারে। এবারের বাজেটে এই মর্মে প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে যে, এখন থেকে দুই লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে হলে টিআইএন (ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর) বাধ্যতামূলক। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের ফলে সাধারণ মানুষ যে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হবে তা মোটামুটি নিশ্চিত। অসংখ্য সাধারণ মানুষ, এমনকি দরিদ্র জনগোষ্ঠীরও একটি বৃহৎ অংশ সঞ্চয়পত্রে অর্থ জমা রেখে সেখান থেকে যে উপার্জন হয়, তা দিয়ে তাদের সংসার চালান। এক মাসের সঞ্চয়পত্রের সুদ পেতে দেরি হলে সাংসারিক খরচ চালানোর ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েন।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তের কারণে যাদের টিআইএন নেই তারা যে শুধু নতুন সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারবেন না তাই নয়, তারা হয়ত আগে ক্রয় করা সঞ্চয়পত্র নবায়নের সময়েও যথেষ্ট সমস্যায় পড়বেন। কারণ নির্দেশনাটি কীভাবে জারি হবে সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। তবে যেভাবেই জারি হোক না কেন সেই সিদ্ধান্ত মাঠপর্যায়ে যারা প্রয়োগ করার দায়িত্বে থাকবেন তারা যেকোনো সহজ ও সাধারণ সিদ্ধান্তও ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলতে যথেষ্ট দক্ষ। একটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট বোঝা যাবে যে আমাদের দেশের সরকারি অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারি নির্দেশনা প্রয়োগে কতটা জটিল অবস্থার সৃষ্টি করে।
সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়ে দেয়। সরকারের বর্তমান নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মকর্তা অবসরে যেয়ে পেনশন পেতে হলে তাকে অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সঙ্গে তার সর্বশেষ কর্মস্থল থেকে প্রাপ্ত রিলিজ অর্ডার বা অবসরে যাবার সনদপত্র জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা আছে এবং এটি থাকাই সাভাবিক। কিন্তু সেই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা প্রয়াত হলে তার সহধর্মিণী যখন প্রাপ্য অনুযায়ী তার প্রয়াত স্বামীর অবর্তমানে তার নিজের নামে পেনসন প্রদানের জন্য আবেদন করেন তখনও সেই পেনশন বা এজি অফিসের কর্মকর্তারা তার স্বামীর শেষ কর্মস্থলের রিলিজ অর্ডার দাবি করে বসে। প্রথমত স্বামীর ক্ষেত্রে এই কাগজ প্রয়োজনীয় দলিল হলেও স্বামীর উত্তরাধিকার হিসেবে পেনশন পাবার ক্ষেত্রে তার কোনো প্রয়োজন থাকা উচিত নয়।
দ্বিতীয়ত, এই রিলিজ অর্ডারের কপি তো তার স্বামীর পেনশন নথিতেই আছে এবং সেখান থেকে খুব সহজেই সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু সরকারি অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্মচারী সেসব বিচার বিবেচনার ধার না ধেরে সরকারি নির্দেশনা দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানির মধ্যে ফেলে দেয়। কিছু দিন আগে আমার এক নিকট আত্মীয়ের ক্ষেত্রেই এরকম সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং পেনশনের অর্থ পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিল। অবশেষে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় থাকার সুবাদে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টির সমাধান করা গেছে। আমাদের পরিচয় ছিল বলে আমরা পেরেছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই সরকারি নির্দেশনার ভুল বা অপব্যাখ্যার কারণে প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
এটি যে পেনশন বা এজি অফিসের কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা তা মোটেই নয়, বরং অধিকাংশ সরকারি অফিসের অবস্থা এই একই রকম। এই যেখানে সরকারি নির্দেশনা পালনের অবস্থা, সেখানে অহেতুক সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে টিআইএন প্রদান বাধ্যতামূলক করে সঞ্চয়পত্রে পুরাতন এবং নতুনভাবে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী মানুষকে উটকো ঝামেলার মধ্যে ফেলে দেয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।
বর্তমান বাজেট যেভাবে পেশ করা হয়েছে তাতে সঞ্চয়পত্র ক্রয়কে নিরুৎসাহিত করার মতো টিআইএন প্রদান বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। প্রথমত, সরকার করযোগ্য আয়ের সীমা তিন লাখ টাকা অপরিবর্তিত রেখেছে। তাহলে মাত্র দুই লাখের উপরে সঞ্চয়পত্র ক্রয় করার ক্ষেত্রে টিআইএন প্রদান বাধ্যতামূলক হবে কোন যুক্তিতে।
দ্বিতীয়ত, উন্নয়ন বাজেটের কারণে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৩৭ হাজার ১ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে সঞ্চয়পত্র বিক্রয় করে। অর্থাৎ বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে সঞ্চয়পত্র বিক্রয় উৎসাহিত করতে হবে যার সঙ্গে টিআইএন প্রদান বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই সহায়ক নয়। সবচেয়ে বড় কথা দেশে আয়কর রিটার্ন দাখিল করে হাতেগোনা কিছু মানুষ। মোট জনগোষ্ঠীর খুব সামান্য সংখ্যকই টিআইএন সংগ্রহ করেছে।
আর সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছে আপামর জনসাধারণ। এমনিতেই আমাদের দেশে লাভজনক বিনিয়োগ সুবিধা নেই বললেই চলে। একসময় মানুষ ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে অর্থ জমা রাখত। এখন সেখানে সুদের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় মানুষ সঞ্চয়পত্রের দিকেই ঝুকেছিল। এখন যদি হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলে এক ধরনের সামাজিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে এবং অনেক মানুষ জাল জালিয়াতির শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হতে পারে। কেননা, এই সুযোগে গ্রামেগঞ্জে, এমনকি মফস্বল শহরে গড়ে উঠতে পারে নানান ভুঁইফোঁড় বা অনিবন্ধিত এনজিও যারা উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করে জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করতে পারে।
মনে রাখতে হবে প্রয়োজন কখনই নিয়ম মানে না। যখন মানুষ বিকল্প লাভজনক বিনিয়োগের সুযোগ পাবে না, আবার টিআইএনের অভাবে সঞ্চয়পত্রও ক্রয় বা নবায়ন করতে পারবে না তখন তারা একরকম নিরুপায় হয়ে পরিণতির কথা চিন্তা না করেই সেসব ভুঁইফোঁড় অনিবন্ধিত এনজিওতে অর্থ জমা রেখে সর্বস্বান্ত হতে পারে। আর এরকম ঘটনা ঘটলে তখন দায়-দায়িত্ব সরকারের উপরই এসে বর্তাবে। তাছাড়া এই ধরনের সিদ্ধান্ত বাজেটের মাধ্যমে পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া হঠাৎ করে গ্রহণ করার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না।
যদি সত্যিকার অর্থেই সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে টিআইএন প্রদান বাধ্যতামূলক করতে হয় তাহলে সেটি করতে হবে যথেষ্ট সময় দিয়ে যাতে করে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা সবকিছু গুছিয়ে নিতে পারে। যেমন আগে থেকেই ঘোষণা দেয়া যেতে পারে যে, আগামী ২০২৫ সাল থেকে সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে হলে টিআইএন প্রদান বাধ্যতামূলক হবে। সেই সঙ্গে এনবিআর থেকে মানুষকে সহজে এই টিআইএন প্রদানের ব্যাবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে এই সময়ের মধ্যে যারা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী তারা তাদের টিআইএন সংগ্রহ করে নিতে পারবেন।
মূলকথা, এই বাজেটের নেতিবাচক দিক হচ্ছে দুই লাখ টাকার উপরে সঞ্চয়পত্র ক্রয় করার ক্ষেত্রে টিআইএন বাধ্যতামূলক করা। বাজেটের এই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষকে সত্যিকার অর্থেই মারত্মক এক সমস্যায় ফেলবে।
যারা সঞ্চয়পত্রে অর্থ জমা রেখে সেই উপার্জন দিয়ে সংসার চালান তারা মারাত্মক এক বিপদের সম্মুখীন হবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাজেটের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছায় অনেক দেরিতে এবং পরোক্ষভাবে।
অথচ এই সিদ্ধান্তের কারণে জনগণ তাৎক্ষণিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন, ফলে সরকারের প্রশংসনীয় এই বিশাল বাজেটের সুনামের চেয়ে দুর্নামই বেশি হবে শুধু এই সিদ্ধান্তের কারণে। প্রত্যেক জনগণের জন্য টিআইএন সংগ্রহ সহজলভ্য এবং তা প্রাপ্তি নিশ্চিত না করে বাজেটের মাধ্যমে এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। আশা করব অর্থমন্ত্রী বিষয়টির ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেবেন।
লেখক: ব্যাংকার