আমাদের দেশে বাজেট আসলে সংখ্যার খেলা। সংখ্যা বা ডিজিট দিয়ে বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের অঙ্ক মিলিয়ে দেয়া হয়। মেলানোটাও সহজ। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য না হলে ঘাটতি রেখে দেয়া হয়। বলা হয়, এগুলো ঋণ-অনুদান দিয়ে পূরণ করা হবে। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। করোনা মহামারি ও লকডাউনের ধাক্কায় সরকারের নিজেরই সংসার চলছে ধারদেনা করে। তার ফলে বাজেটে যে গরিব, মধ্যবিত্ত ও বেসরকারি চাকরিজীবীর জন্য বিশেষ আয়কর ছাড় মিলবে না, তা জানেই ছিল। ঘটেছেও তাই। অপরিবর্তিত কর কাঠামো রেখেই এবারের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে।
আমাদের দেশে সরকারের আয় কম, ব্যয় বেশি। ফলে এবারও বেশি ঋণ ধরে বিশাল ঘাটতি বাজেট তৈরি করতে হয়েছে। এবারের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে (আয় ও ব্যয়ের পার্থক্য) ১ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ছয় শতাংশের কাছাকাছি। রাষ্ট্রের ব্যয় মেটানোর জন্য সরকারকে রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি ঋণ নিতে হয়৷ আবার এই ঋণের জন্য সুদও দিতে হয়৷ প্রস্তাবিত বাজেটে সুদ পরিশোধবাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।
বাজেটে মোট ব্যয়ের ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ খরচ হবে সুদ পরিশোধে। যা গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৪ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা বেশি। সুদ পরিশোধের জন্য সরকারকে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে, তা দিয়ে মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির পাঁচ ভাগের দুই ভাগ ব্যয় মেটানো সম্ভব৷ বিদেশি উৎসের তুলনায় অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বেশি। কিন্তু সরকার বিদেশি উৎস থেকে আশানুরূপ ঋণ না পাওয়ায় বেশি সুদ দিয়ে অভ্যন্তরীণ ঋণেই বেশি ভরসা রাখতে হচ্ছে।
যেহেতু ঋণ কমানো যাবে না, অপরদিকে সুদের ব্যয়ও বাড়বে, সেক্ষেত্রে সরকারের হাতে উপায় হলো প্রশাসন পরিচালনার ব্যয় কাটছাঁট করা। বিশেষ করে অপচয়গুলো বন্ধ করা। কিন্তু এ ব্যাপারে তেমন কোনো অঙ্গীকার বাজেট বক্তৃতায় লক্ষ করা যায়নি।
করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের অগ্রাধিকারগুলো বদলে গেছে। এসব বিষয়ে বাজেটে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। ব্যবসায়ীরা নানাভাবে ছাড় পেলেও গরিব ও মধ্যবিত্তদের জন্য গতানুগতিকতার বাইরে তেমন বিশেষ কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। অথচ করোনাকালে গরিব ও মধ্যবিত্তরাই সবচেয়ে বেশি সংকটে আছে। স্বাস্থ্য খাত, সামাজিক বেষ্টনী খাত এবং দুর্যোগ ব্যবস্থা খাতে আরও বরাদ্দের প্রয়োজন থাকলেও তা দেয়া হয়নি।
২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার পরিচালন বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ৬১ শতাংশ। ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট থেকে ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬০৩ কোটি টাকার খরচ হবে সরকার পরিচালনবাবদ। এই টাকার প্রায় অর্ধেক (১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা) ব্যয় হবে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা, পেনশন ও সুদ মেটাতে।
‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামের এবারের বাজেট ‘উন্নয়নমুখী’ বাজেট বলা হলেও বোঝা যায় না, কাদের উন্নতির কথা বলা হচ্ছে। নতুন একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে, ‘আত্মনির্ভরতা’। আত্মনির্ভরতার মানে হচ্ছে, সরকার দরিদ্রকে ভর্তুকি দিতে আর রাজি নয়। নিজেদেরটা নিজেদেরই বুঝে নিতে হবে।
অর্থনীতির গাড়িটা যে ঠিকঠাক চলছে না, সে কথা অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় একবারের জন্যও স্বীকার করলেন না। কোভিডসহ নানা কারণে আর্থিক বৃদ্ধির গতিভঙ্গ হয়েছে।
জাতীয় আয় প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়েনি। জাতীয় আয় ঠিক রপ্তানির ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে নেট রপ্তানি, অর্থাৎ রপ্তানি থেকে আমদানি বাদ দিলে যে অঙ্কটা পাওয়া যায়, তার ওপর। জন্মলগ্ন থেকেই আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিশাল ঘাটতি, মানে আমদানির তুলনায় রপ্তানি অনেক কম। এই ঘাটতি কমলে জাতীয় আয় বাড়ার কথা। তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায়নি।
করের আওতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে সেটা করা হবে তা বলা হয়নি। এবারের বাজেট শুনে সম্ভবত সবচেয়ে হতাশ ও ব্যথিত হয়েছেন আয়করদাতারা! কারণ, বাজেটে না আয়কর ছাড়ের সীমা বাড়ানো হয়েছে, না আয়করের স্ল্যাবের কোনো পরিবর্তন করা হয়েছে।
আরও আছে। গরিব দিনমজুরদের দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির কথা বলা হয়নি। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার ব্যাপারেও কিছু বলা হয়নি। কুটিরশিল্প, হস্তশিল্পসহ ছোট ও মাঝারি শিল্পকে চাঙা করার ব্যাপারেও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়নি। নতুন কোনো ভারী শিল্প বিকাশের কথাও নেই। প্রশ্ন তোলা যায়, এ কার বাজেট?
অর্থমন্ত্রী বড়ই নির্দয়! পেট্রোল ও ডিজেলের ওপর শুল্ক কমানোর কথাও বলা হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমই বলা যায়। সুতরাং, ধরেই নেয়া যায় যে, বাজারদর দিন দিন আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে। শিক্ষাখাতেও বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা আইআইটি গঠন কিংবা নির্মাণের ব্যাপারেও কিছু বলা হয় না। নতুন ও আশাব্যঞ্জক কোনো প্রকল্পের কথাও নেই বাজেটে।
বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞরা যখন জলবায়ু পরিবর্তনকে মহাবিপদ বলে অভিহিত করছেন, তখন বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাজেট বরাদ্দে মোট বাজেটের অংশ না বাড়িয়ে বরং আরও কমানো হয়েছে। এটি দেশের পরিবেশ রক্ষায় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলবে। টেকসই বন ব্যবস্থাপনা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জলাভূমি-নদী ও সাগরের বাস্তুসংস্থানের টেকসই ব্যবস্থাপনায় বরাদ্দ কমেছে, যা হতাশাব্যঞ্জক।
২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা অর্জন করতে হলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। কোভিডের বাস্তবতায় এটা কীভাবে সম্ভব, তার রূপরেখা বাজেটে নেই।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট ভাষণে যা আছে, তা সব বাজেট ভাষণেই থাকে। তবে এই বাজেট ভাষণে অনেক কিছুই নেই। যেমন, অর্থমন্ত্রীর ভাষণে কর্মসংস্থান বাড়ানোর কথা নেই। দেশে প্রকৃত বেকার কত, গত দেড় বছরে তা আরও কী পরিমাণ বেড়েছে, তাদের চাকরির সুযোগ বাড়াবার জন্য কী উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, সে তথ্য নেই। অর্থমন্ত্রীর পক্ষে বেকারদের দিশা দেখানোর সামর্থ্য নেই, সেই কারণেই কি? কোভিডের কারণে যারা কাজ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে, সেই রকম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কত? এমন দরিদ্র মানুষের হাতে নগদ টাকা পৌঁছে দেয়ার কোনো পথের হদিসের কথা দূরে থাকুক, সরকার আদৌ সেই প্রয়োজন অনুভব করে কি না, অর্থমন্ত্রী তাও বলেননি।
দেশে আর্থিক অসাম্য প্রবল হারে বাড়ছে— তার উল্লেখও বাজেটে নেই। ব্যাংক থেকে কে কত কোটি টাকা মেরে দিয়েছে, সেই টাকা উদ্ধারে সরকার যে কিছুই করতে পারছে না, সেই অসহায়তার কথাও বলা হয়নি। বলা হয়নি কোন কৌশলে কারা দেশের কত কোটি টাকা পাচার করে অর্থনীতিকে দুর্বল বানিয়ে দিচ্ছে-সেই কথা। সবার জন্য পেনশন ও স্বাস্থ্যবিমার ব্যাপারটিও উপেক্ষিতই থেকেছে।
উপেক্ষা দেখানো হয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারেও। এই না বলা কথাগুলো বাজেটের আসল কথা। যা বলা হয়েছে, তা গতানুগতিক। যা বলা হয়নি, সেটাও ঐতিহ্য। তবে অনুল্লেখ্যগুলোর গুরুত্ব অনেক বেশি।
দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্যোদ্ধার করতে, এবং সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর সুরাহা করতে অর্থমন্ত্রীর পক্ষে কী করা সম্ভব ছিল, বাজেট অনুমোদনের দিনে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।
প্রথম কথা হলো, তিনি এমন কিছু ক্ষেত্রে খরচের পরিমাণ বাড়াতে পারতেন, যাতে একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের উন্নয়নের কাজও হয়, আবার আর্থিক বৃদ্ধির হারেও তার প্রভাব পড়ে। উদাহরণ হিসেবে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্রের কথাই বলা যেতে পারে। শিক্ষার অধিকার আইনকে যদি ঠিকভাবে কার্যকর করা হয়, তাহলে দেশজুড়ে কয়েক লাখ শিক্ষকের প্রয়োজন হবে।
একইভাবে, উচ্চশিক্ষাকে সর্বজনীন অধিকার হিসেবে গণ্য করলে আরও অনেক কলেজ তৈরি করার প্রয়োজন হবে, এবং তাতে বহু উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ের কর্মসংস্থান হবে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও যদি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়, যদি সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপর জোর দেয়া হয়, তাহলে সুচিকিৎসা যেমন সবার নাগালে আসবে, তেমনই অসংখ্য স্বাস্থ্যকর্মীর কর্মসংস্থান হবে।
দেশের মানুষের জীবনের উন্নতিসাধনের চেষ্টা করতে, তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিপুল রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন, সে কথা বোধ হয় আলাদা করে না বললেও চলে। কিন্তু, সরকারের মনজুড়ে যদি শুধু বাজার থাকে, তবে সেই সরকার নাগরিকদের জন্য প্রকৃত অর্থে সুদিন আনার চেষ্টা করবে, এমন আশা না করাই ভালো।
কাজেই এবারের বাজেট সরকারের গতানুগতিক বাজেট। ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’—এই স্লোগানকে কেবলই কথার কথাই মনে হয়েছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক।