বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পঞ্চাশের বাজেটে কত মার্ক পেলেন অর্থমন্ত্রী?

  •    
  • ৫ জুন, ২০২১ ১৩:০৮

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর প্রদানের কথা। সরকারের প্রত্যাশা- ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা’ তাদের মুনাফা থেকে এই কর দেবেন। কিন্তু ‘ধুরন্ধর মালিকরা’ এই করের পুরোটাই ছাত্রছাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট হতে পারেন। নিজেদের পকেটে যাতে সরকারের হাত না পড়ে, সে জন্য ছাত্রছাত্রীদের রাজপথে নামার উসকানি দেয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব। এই ধনবানরা কিন্তু অর্থমন্ত্রীকে নিজেদের লোক মনে করেন।

স্বাধীনতা অর্জনের ৫০তম বছরে অনেক কিছুতেই হাফ সেঞ্চুরি হবে। অর্থমন্ত্রী ৩ জুন বিকেলে জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করলেন, যা বাংলাদেশের ৫০তম। সাধারণত এ ধরনের উপলক্ষ থাকলে তা স্মরণীয় করে রাখার জন্য বিশেষ আয়োজন করা হয়। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বাজেটে তেমন ছাপ রাখার চেষ্টা করেছেন কি?

তিনি প্রায় ৬ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিয়েছেন, যা রেকর্ড। তবে এটা বলা প্রয়োজন, যেকোনো দেশের জাতীয় বাজেটের আকার আগের বছরের চেয়ে বেশি হয়। এটা না ঘটলে বুঝতে হবে অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে, যা নিরাময়ের অযোগ্য।

করোনাকালেও বাংলাদেশে অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য বজায় রাখতে পেরেছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। এ কারণে নতুন বাজেটের আকার ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে কম হওয়ার প্রশ্ন আসেনি।

আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীদের পড়াতে হয় বিজনেস জার্নালিজম। ছাত্রছাত্রীদের বলি, গণমাধ্যম বাজেট নিয়ে রিপোর্ট করার সময় জনতুষ্টির বিষয়টির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে থাকে।

প্রায় তিন দশক আগে লিখেছিলাম- ‘এবারের বাজেটও কি জনগণের কাছে দুর্ভোগ হিসেবে আসবে?’ এর কারণ ছিল- তখন প্রতিবছরের বাজেটে নানা ধরনের শুল্ককর বাড়ানো হতো। ব্যবসায়ীরা বাজেটের আগে এক দফা পণ্যের দাম বাড়াতেন, বাজেটের পর আরেক দফা বাড়ত। যে পণ্যে ট্যাক্স বাড়ানো হতো না, তার দামও বাড়ানো হতো। তবে হাল আমলে অর্থমন্ত্রীরা বুদ্ধিমান হয়েছেন। তারা বাজেটের সময় নয়, বছরজুড়ে অনেক পণ্যের শুল্ক-কর বাড়ান। জনগণকে সহ্য করতে শেখানো হয় এভাবে।

ব্যবসায়ীরা আরও বুদ্ধিমান। তারা খোঁজ রাখেন- কোনো পণ্যে ট্যাক্স বাড়তে পারে, কোনো পণ্যে পারে কমতে। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ‘দামি সিগারেটের’ ওপর আমদানি ট্যাক্স বাড়ানো হতে পারে- এমন ধারণা ছিল। এটা বুঝতে পেরেই একটি প্রতিষ্ঠান ৬০ লাখ শলাকা দামি সিগারেট আমদানির ব্যবস্থা করে। প্রতিষ্ঠানটি ছিল আরেক কাঠি সরস। তারা সিগারেট হিসেবে নয়, চালানটি আনে পোশাক শিল্পে ব্যবহৃৎ হ্যাঙ্গার হিসেবে।

এ ধরনের পণ্যে আমদানি শুল্ক নেই। প্রতিষ্ঠানটি ডাবল লাভ করতে চেয়েছিল। একদিকে শুল্কমুক্ত হিসেবে হ্যাঙ্গারের নামে সিগারেট আমদানি, পাশাপাশি সিগারেটের শুল্ক বাড়লে চড়া দামে বা বাজারে বিক্রি করা যাবে। তবে তাদের নসিব ভালো ছিল না। বাজেট পেশের দিনই কাস্টমস কর্তৃপক্ষ চালানটি ধরে ফেলে এবং বাজেয়াপ্ত করে।

সিগারেটের ওপর শুল্ক বাড়ল, অথচ লাভ ঘরে তোলা গেল না- একটি ফাটকা খেলায় পরাজয়, নিশ্চয়ই বড় হতাশার কারণ। তবে কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন- একটি চালান ধরা পড়েছে, কাস্টমসের চোখ এড়িয়ে কয়টি চালানের সিগারেট চড়া দামে বাজারে পৌঁছেছে?

বহু বছর বাজেট পেশের পর মিছিল-সমাবেশে স্লোগান উঠত- গরিব মারার বাজেট মানি না। ৩ জুন বাজেট পেশের পর তেমনটি দেখা যায়নি। তবে গণমাধ্যম জনতুষ্টির প্রতি নজর রেখেছে। একটি ‘বড়’ পত্রিকা কোন কোন পণ্যের দাম বাড়তে পারে, সে তালিকা ছেপেছে লাল কালিতে ওপরে, আর নিচে ছেপেছে কালো কালিতে দাম কমার তালিকা।

দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে বিদেশি মাংস, ফিচার ফোন, দামি সিগারেট, বিদেশি বিস্কুট ও গাজর-টমেটো এবং মদ। এ সব পণ্যের দাম বাড়লে বেশিরভাগ মানুষের অখুশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ওই যে অভ্যাস, দাম বাড়বে যেসব পণ্যের তা সামনে আনতে হবে।

যেসব পণ্যের দাম কমবে সে তালিকা পত্রিকাটি দিয়েছে এভাবে- স্যানিটারি ন্যাপকিন, দেশি গৃহস্থালি সরঞ্জাম যেমন- ওয়াশিং মেসিন, মাইক্রোওভেন, ব্লেন্ডার, প্রেসার কুকার; ক্যানসারের ওষুধ, দেশি রাউটার হেডফোন, কি-বোর্ড ও পেনড্রাইভসহ অনেক ধরনের কম্পিউটার সামগ্রী; ইস্পাত ও অন্যান্য সামগ্রী।

এ ধরনের শুল্ক ছাড়ের কারণে দেশীয় শিল্প উৎসাহিত হবে। তাতে উদ্যোক্তাদের লাভ, নতুন শিল্প গড়ে উঠলে কাজের সুযোগও বাড়বে। কিন্তু আমাদের অনেক গণমাধ্যমে কেবল ‘জনতুষ্টি’। আমদানি করা মাংস বা মদের দাম বাড়লে পাবলিকের কী ক্ষতি, সেটা কিন্তু অনেকের কাছে বোধগম্য হবে না।

একটি পত্রিকায় বাজেট সংবাদের শিরোনাম- ব্যবসায়ীরা খুশি, হতাশ মধ্যবিত্ত। ব্যবসায়ীরা মুনাফা বাড়ার সুযোগ দেখলে খুশি হবে। আবার শিল্প-কারখানা বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলেও অনেক উদ্যোক্তা খুশি হবেন। করপোরেট কর কমানো হয়েছে কয়েকটি ক্ষেত্রে।

এতে শেয়ার বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। শিল্প-ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কর কমলে শেয়ার হোল্ডারদের বাড়তি মুনাফা দেয়া যায়। এটা ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু কোম্পানির পরিচালকরা বড় বড় শেয়ার হোল্ডারদের স্বার্থে ব্যালান্সশিটে কারচুপি করলে সাধারণ শেয়ার হোল্ডারদের কোনো লাভ হবে না। অর্থমন্ত্রী কি এ দিকে নজর দেবেন?

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর প্রদানের কথা। সরকারের প্রত্যাশা- ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা’ তাদের মুনাফা থেকে এই কর দেবেন। কিন্তু ‘ধুরন্ধর মালিকরা’ এই করের পুরোটাই ছাত্রছাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট হতে পারেন। নিজেদের পকেটে যাতে সরকারের হাত না পড়ে, সে জন্য ছাত্রছাত্রীদের রাজপথে নামার উস্কানি দেয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব। এই ধনবানরা কিন্তু অর্থমন্ত্রীকে নিজেদের লোক মনে করেন।

বাজেট প্রদানের পর একদল অর্থনীতিবিদ বলেছেন- বাজেট বাস্তবায়নের রূপরেখা অস্পষ্ট। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন- এটা ভাওতাবাজির বাজেট, দুর্নীতির শ্বেতপত্র। তার বিবেচনায়- দুর্নীতির ধারাবাহিকতার এ বাজেটে জনগণের ওপর বিদেশি ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এবং জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের জীবন চূড়ান্তভাবে থমকে গেছে। স্বাস্থ্য খাতে সরকার চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। বাজেট হওয়া উচিত ছিল অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বাজেট, যেদিকে অর্থমন্ত্রী যাননি। বড় বড় প্রকল্পে লুটপাটের সুযোগ বেশি, তাই সরকার গরিবদের প্রণোদনায় আগ্রহ দেখায় না।

বিএনপি বড় দল, সন্দেহ নেই। পার্লামেন্টে তাদের কণ্ঠ ক্ষীণ। সংসদের বাইরে এ দলের অনেক সাবেক মন্ত্রী-এমপি রয়েছেন। অনেক ব্যবসায়ী ও সাবেক আমলাও বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল। অর্থমন্ত্রী নিশ্চয়ই তাদের মতো বিবেচনায় নেবেন।

বাজেটের পর একটি পত্রিকা শিরোনাম দিয়েছে- মানি ইজ নো প্রব্লেম। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এ বাক্যটি খুব ব্যবহার করতেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- মানি কোথায় ব্যবহার করবেন? স্বাস্থ্য খাতে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। চলতি বছর বরাদ্দ ছিল ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। করোনাকালেও বাজেট তেমন বাড়েনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে- জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকা উচিত স্বাস্থ্য খাতে। কিন্তু বাংলাদেশে বরাদ্দ ১ শতাংশেরও কম। জনগণ যদি সুস্থ ও সবল থাকে- তারা পড়াশোনায় ভালো করবে, কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা দেখাবে। এ কারণেই স্বাস্থ্য খাতে বেশি ব্যয় চাই। কেউ বলবেন, উন্নত দেশগুলো প্রচুর ব্যয় করেছে এ খাতে। কিন্তু করোনা সেখানেই বেশি হানা দিয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার আরও বলবে- আমরা করোনার প্রকোপ সীমিত রাখতে পেরেছি বলেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলছেন- আমেরিকার হাতে যে বাড়তি টিকা আছে তার ভাগ বাংলাদেশ পাবে না। কারণ তাদের চেয়ে আরও অনেক দেশ আছে যেখানে করোনা পরিস্থিতি খারাপ।

গত দেড় বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের যে দুবর্লতা দেখা গেছে, সেটা কোনোভাবেই চাপা দিয়ে রাখা যাবে না। একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির খবর সংবাদপত্রে এসেছে, অর্থমন্ত্রী সেটা স্বীকার করেননি। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে তো এ সব তেমন গুরুত্বই পায় না।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চার কোটির বেশি ছাত্রছাত্রী। পড়াশোনা প্রায় শিকেয় উঠছে। এর অবসানে সম্মিলিত প্রয়াস চাই, আন্তরিক উদ্যোগ চাই। বিশেষ বরাদ্দ চাই বাজেটেও। এ বিষয়টি আদৌ গুরুত্ব পায়নি বাজেট ভাষণ ও বরাদ্দে। দেখা যাক, শিক্ষামন্ত্রী দিপু মণি বাজেট আলোচনার পর্যায়ে কী বলেন!

দুই যুগেরও বেশি আগে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছিলেন- বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেটে যা বরাদ্দ হয় তার অর্ধেক বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনকি তিন ভাগের এক ভাগ বরাদ্দ দিয়েও বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে একটিই শর্ত পূরণ করতে হবে- দক্ষতার সঙ্গে, দুর্নীতি সম্পূর্ণ বন্ধ না হোক অন্তত যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রকল্পের বাস্তবায়ন করতে হবে।

তিনি বিএনপি-জাতীয় পার্টির ২১ বছরের শাসনের সময় বিবেচনা করে এ অভিমত দিয়েছিলেন ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়। এখন কি তিনি মত বদলাতে পারেন, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে? অর্থমন্ত্রী কী বলেন? যদি পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি ঘটেছে বলেও তিনি প্রমাণ দিতে পারেন- ৫০তম বাজেটের জন্য তাকে একশতে একশ’ নম্বর দিতে রাজি আছি।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।

এ বিভাগের আরো খবর