বাজেটকে সাধারণ চোখে মনে হয় আগামী এক বছরের অর্থনেতিক কর্মসূচি বা রূপরেখা। সেভাবেই সকলে বাজেটের হিসাব-নিকাষ করতে অভ্যস্ত। করাও হয় সাধারণত ওইভাবেই। খুব কম ক্ষেত্রেই মনে করা হয়, বাজেট একটি রাজনৈতিক সরকারের আগামী এক বছরের জন্যে নেয়া সকল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বা রূপরেখার দলিল। আর যখন রাজা বা সম্রাট দেশ শাসন করতেন, তখনও তাদের একটা রাজনীতি ছিল। সে সময়ে হয়ত এক অর্থ বছরের বাজেট হতো না। তবে তারপরেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অর্থনীতি পথ চলত। আর এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আসে বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে।
গত এক দশকের বেশি সময়ের মধ্যে এবারই মনে হয় সব থেকে খারাপ সময়ে দেশের জাতীয় বাজেট সংসদে ঘোষণা হয়েছে। কারণ গত বছর যখন করোনার মধ্যে এই বাজেট ঘোষণা করা হয়, তখন অর্থনীতিতে করোনার কোনো ধাক্কা ওইভাবে লাগেনি। তখন দেশ মাত্র তিন মাস করোনায় আক্রান্ত। তাছাড়া ধরে নেয়া হয়েছিল, এই প্রথম ধাক্কা চলে গেলেই করোনা চলে যাবে। তখন সামনে উদাহরণ ছিল চীনের করোনা প্রথম ধাক্কাতেই শেষ হয়ে গেছে। এবং তারা সেটা তাদের একমাত্র প্রদেশে আটকে রাখতে পেরেছে। অন্যদিকে তখন সব দেশেই চলছিল করোনার প্রথম ধাক্কা। তার ওপরে বাংলাদেশের গ্রাম ও জেলা শহরগুলো ভালো থাকাতে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরা সুখের ঢেকুর তুলেছিলেন। তারা বলেছিলেন, ধান ক্ষেতে করোনা নেই, রিকসাওয়ালাদের করোনা নেই। আর এই সব সুখের ঢেকুর থেকে দ্বিতীয় ওয়েভের জন্যে প্রস্তুতিটাও তেমন নেয়া হয়নি।
এর ভেতরই দেশে করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ এসেছে। এবং অর্থমন্ত্রী যেদিন সংসদে বাজেট পেশ করেছেন সেদিন দেশের ভারতীয় সীমান্তবর্তী প্রায় ছয়টির বেশি জেলায় সব থেকে বেশি করোনা সংক্রমণ। আর বাজেট ঘোষণার পরদিন শুক্রবার ভারত সীমান্তবর্তী জেলা রাজশাহীতে করোনায় মৃত্যু একদিনে ১৬ জন। এছাড়া দেশের করোনা রোগিদের শতকরা ৮০ ভাগ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। তাছাড়া নতুন একটি ভ্যারিয়েন্টও পাওয়া গেছে। এছাড়া অর্থমন্ত্রী যে সময় বাজেটে পেশ করছিলেন, ওই সময় অবধি মোটামুটি হিসেবে দেশে আড়াই কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে গেছে। এর পাশাপাশি এই দ্বিতীয় ওয়েভ করোনা কবে যাবে, গোটা দেশের মানুষকে কবে ভ্যাকসিন দেয়া সম্ভব হবে, তাও অনিশ্চিত।
এমন একটি সময়ে বাজেটের সব থেকে বড় দিক ছিল, করোনার ভেতর দিয়ে দেশ ও দেশের অর্থনীতি পার করার জন্যে একটি সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি নেয়া। এই কর্মসূচিই হওয়া উচিত ছিল এ মুহূর্তে এই সরকারের সব থেকে বড় রাজনৈতিক কর্মসূচি। অতীতের যে কোনো মেগা প্রজেক্টের বা অনেকগুলো মেগা প্রজেক্টের থেকে শতগুণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই কর্মসূচি। বাস্তবে এ বিষয়টি বাজেটে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, এবারের বাজেট কি রাজনৈতিক সরকার তার রাজনৈতিক বিবেচনায় না নিয়ে শুধু অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে?
সরকার বলতে পারে তারা সোশ্যাল সিকিউরিটি বাড়িয়েছে। সোশ্যাল সিকিউরিটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে ঠিকই, তবে কখনই কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়ক নয়। দুর্যোগ মোকাবিলার জন্যে মানুষের ভেতর দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়ে যাবার শক্তি জোগাতে হয় বা নতুন কোনো উদ্ভাবনী কর্মসূচি দিতে হয় – তার কোনো নির্দেশনা এবারের বাজেটে নেই। অথচ এটাই সচেতন সকল মানুষ আশা করেছিল। তারা মনে করেছিল, বাজেটে এমন কিছু কর্মসূচি আসবে, যাতে দুর্যোগের ভেতর মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর পথ পাবে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার উল্টো ঘটেছে। বাজেটে ট্রাডিশনাল ব্যবসাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ঠিকই নতুন করে কর বসিয়েছেন অনলাইন ব্যবসার ওপর। অথচ পৃথিবীর দেশে দেশে অনলাইন ব্যবসাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বড় বড় কোম্পানি নেমে পড়ছে তাতে। কাজের সংস্থান হচ্ছে লাখ লাখ মানুষের। আর কাজের সংস্থান ছাড়া কখনই সাধারণ মানুষের সংসারকে সচল করা যায় না। সোশ্যাল সিকিউিরিটি কেবলমাত্র অপুষ্টিজনিত মৃত্যু ও খাদ্যাভাবে মৃত্যু থেকে মানুষকে বাঁচায়।
ঠিক তেমনি এবারের বাজেটে শিক্ষা অর্থাৎ বিশেষ করে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে, অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার একটি আলাদা দিক-নির্দেশনা সকলেই আশা করেছিল। আশা করেছিল তার জন্যে আলাদা বাজেট। কারণ করোনায় সব থেকে বড় ক্ষতি যদি হিসাব করা হয় তাহলে সেটা দেশের শিক্ষার্থীদের ক্ষতি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ছাত্রসমাজ। এবার অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ১৮ মাসেরও বেশি সময় ধরে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাছাড়া খুব শীঘ্রই যে পৃথিবী বা বাংলাদেশ আগের মতো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্থায়ী অনলাইন কাঠামো গড়ে তোলা দরকার।
আর স্বাস্থ্য খাতের দীনতা গত ১৩ মাসে মোটামুটি দেশের মানুষের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। তার সঙ্গে আরেকটি বাস্তবতা এসে দাঁড়িয়েছে, আগামী বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্যে করোনা ভ্যাকসিন, যা কখনই বিদেশ থেকে আমাদানি করে দেয়া সম্ভব নয়। তাই এবারের বাজেটে অন্যতম দিক থাকা উচিত ছিল, দেশে প্রয়োজনীয় করোনা ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা গড়ে তোলার জন্যে দিকনির্দেশনা ও ব্যবস্থা। কিন্তু দেশের মানুষ তা দেখতে পায়নি।
এ কারণে এবারের বাজেটে যারা সুবিধা পাচ্ছেন সেই সকল ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা খুশি হবেন। আর অনান্যবারের মতো দেশের অবকাঠামো বাড়বে। তবে সেখানে একটি বড় প্রশ্ন থেকে যায়: যে বিপুল পরিমাণ অর্থ রাজস্ব খাত থেকে পাওয়া যাবে বলে ধরে নেয়া হয়েছে, এই করোনায় অর্থনীতি যেদিকে যাচ্ছে- তাতে কি সেটা সম্ভব হবে? আর সেটা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অবকাঠামো গঠনেও ধাক্কা লাগবে।
তাই এবারের বাজেট ঘোষণার পরে এখন দেশের প্রধানমন্ত্রীর ওপর নতুন করে কিছু দায় চেপে যাবে। তাকে যে কোন জরুরি সময়ে যেমন একক সিদ্ধান্ত নিতে হয়, এবারেও তা নিতে হবে। অন্তত দেশের অনলাইন ব্যবসা খাতকে করমুক্ত করে বাড়িয়ে তোলা, দেশের জন্যে স্থায়ীভাবে অনলাইন শিক্ষা কাঠামো গড়ে তোলা ও দেশকে করোনার ভ্যাকসিনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ব্যবস্থা তাকে করতে হবে।
বর্তমান বিশ্বে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পরে সব থেকে বেশি পোড় খাওয়া রাজনীতিক সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। তাই বাইডেন যেমন ভ্যাকসিনে সফলতা পাচ্ছেন, সফলতা পেতে চলেছেন অনলাইন শিক্ষা কাঠামোতে, শেখ হাসিনাও তেমনি পাবেন বলে আশা করা যায়।
তাছাড়া এ বাজেট কেবল ঘোষণা হয়েছে। এখনও এ নিয়ে সংসদে আলাপ হবে। প্রধানমন্ত্রী অনেক সিদ্ধান্ত দেবেন। তাই আশা করা যায়, বাজেটের এ দুর্বলতা শেষাবধি কেটে যাবে। তবে এ কথা ঠিক, বর্তমানের দুর্যোগকালে প্রতি মুহূর্তে বাস্তবতা অনুযায়ী দেশের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তই দেশ দাবী করে। আর দাবী করে সব সিদ্ধান্ত হবে ১৭ কোটি মানুষের পক্ষে, কখনই গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর পক্ষে নয়।