বাজেটসহ আমাদের সব ভাবনা ও কর্মকাণ্ডের, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে মূল নির্ভরতার জায়গা হলো ১৯৭২-এর বঙ্গবন্ধুপ্রণীত সংবিধান। এই চিন্তা কি সংসদীয় কর্মকাণ্ডে, কি বিচার-বিভাগের ক্ষেত্রে, কি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমানভাবেই প্রযোজ্য। একটি জাতীয় বাজেট প্রণয়নের মূল দৃষ্টিভঙ্গি ওই সংবিধান থেকেই নিতে হবে- এ নিয়ে কোনো দ্বিমত থাকার অবকাশ নেই।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে দেখেছি পাকিস্তান সরকার আধা-সামন্তবাদী, আধা-পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ওই নীতি প্রত্যাখ্যান করি। বঙ্গবন্ধু প্রবর্তন করলেন সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিসারী এক নতুন অর্থনীতি যা ছিল পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত।
বঙ্গবন্ধু শিল্প কারখানাগুলো ও ব্যাংক বিমা কোম্পানিগুলো জাতীয়করণ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসেন। জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সিলিং নির্ধারণ করে দেন। লক্ষ্য ছিল, ধীরে ধীরে পুঁজিবাদকে সঙ্কুচিত করে সমাজ থেকে শোষণ দূরীভূত করা।
কিন্তু পুঁজির মালিক, জোতদার-জমিদারেরা এই ব্যবস্থা মেনে নেয়নি। মুখে কিছু বলার সাহস না করলেও গোপনে নানাবিধ ষড়যন্ত্র করতে থাকে। সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হয় ১৯৭৫-এর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।
এবারে আবার বাংলাদেশে রাজনীতি অর্থনীতির চাকা বিপরীতমুখী পথে যাত্রা শুরু করল। বাংলাদেশ ফিরে গেল পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রতিক্রিয়াশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়। ব্যবস্থাটি আজও বিদ্যমান। বাহাত্তরের মূল সংবিধানে আমরা আজও ফিরে যেতে পারিনি।
তাই আগের ধ্যান-ধারণার পরিবর্তে ৭৫ পরবর্তী ভাবনাই হয়ে পড়েছে নিয়ন্ত্রক। শিল্প কারখানাগুলো পুনরায় ব্যক্তি মালিকানায় ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে- ফলে মালিকেরা সেগুলো না খুলে দিব্যি মেশিনপত্র, জমি প্রভৃতি তারা জলের দামে বিক্রি করে দিয়ে টাকা পয়সা ভিন্ন ব্যবসায় খাটাতে শুরু করলেন শ্রমিক ছাঁটাই হওয়ার ফলে বেকারদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটল- নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ আজও তৈরি হয়নি।
অপরদিকে বর্তমানে করোনা মহামারি বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বকে সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে মারাত্মক বিপর্য্যয়ের মধ্যে ফেলেছে।
এই পরিস্থিতিতে ৩ জুন অর্থমন্ত্রী ২০২১-২০২২ অর্থ বছরের পূর্ণাঙ্গ বাজেটে আমাদের জাতীয় সংসদে পেশ করলেন। বাজেটের প্রধান প্রধান বিষয় হলো -
বাজেটের আকার ৬,০৩,৬৮১ কোটি ৮৯ হাজার কোটি টাকা, বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। বিদেশি উৎস থেকে ঋণপ্রাপ্তি ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা; অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ ১ লাখ তেরো হাজার পঁয়তাল্লিশ কোটি টাকা।
কালো টাকা বিনিয়োগ করার সুযোগ অব্যাহত থাকবে বলা হয়েছে কিন্তু যারা কালো টাকা পূর্ণাঙ্গ বা আংশিকভাবে বিনিয়োগ না করে গোপনে রেখে দেবেন- তাদের ওই টাকা সাদা করার নির্দিষ্ট মেয়াদ উল্লেখ করা হয়নি।
আকারে এবারে বাজেটের বিরাট উল্লম্ফন ঘটেছে। ২০১৯-২০ সালে বাজেটের আকার ছিল ৫,২৩,১৯০ কোটি টাকা, ২০২০-২১ সালের বাজেটের আকার ছিল ৫,৬৮,০০০ কোটি টাকা সে জায়গায় ২০২১-২২ সালের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৬,০৩,৬৮১ কোটি টাকা।
ঘোষিত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে তিন কোটি পর্যন্ত আয়ে কোনো সারচার্জ দিতে হবে না; ৭০ লাখ টাকার কম আয় হলে নারী উদ্যোক্তাদের কর দিতে হবে না এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে চাকরি দিলে ৫ শতাংশ কর রেয়াত দেয়া হবে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা ১২ হাজার টাকার জায়গায় ২০ হাজার টাকা, করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন তাদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ এবং চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের (যারা করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত) জন্য বিশেষ সম্মানী বাবদ ১০০ কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রণোদনাগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য সুতরাং অভিনন্দনযোগ্য।
কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ রাখা হয়েছে তা প্রতিবারের বাজেটেই করা হয়। কিন্তু এর ইতিবাচক ফল উল্লেখযোগ্যভাবে পাওয়া যায় না বলে অর্থনীতিবিদরা মতপ্রকাশ করেছেন। বাজেটে অবশ্য সুযোগ রাখা হয়েছে কালো টাকা আবাসন খাতে, পুঁজিবাজারে, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপন ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন শিল্প স্থাপনের। এটাও ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা কম।
বরং কালো টাকার মালিকাদেরকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উৎপাদনশীল ও শ্রমবান্ধব খাতে বিনিয়োগে বাধ্য করা প্রয়োজন এবং বলা দরকার যে, তা না করলে তাদের টাকা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটকে জীবন-জীবিকার বাজেট বলে অভিহিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে এটি ৫০তম এবং আওয়ামী লীগ সরকারের ১৩তম বাজেট।
এবারের বাজেট প্রসঙ্গে সরকার বলছে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি ও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, আয়-ব্যয়ের ব্যবধানে ঘাটতি দাড়াচ্ছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। এটি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। ঘাটতি পূরণের জন্য দুটি উৎস প্রধান সহায়ক হিসেবে কাজ করবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। ওই উৎস দুটির একটি হলো বিদেশি এবং অন্যটি অভ্যন্তরীণ। বিদেশি ঋণের প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার ৭৩ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫ কোটি টাকা।
বাজেটের অপর বৈশিষ্ট্য হলো- কোনো রকম কর বৃদ্ধি না করা তবে করের আওতা সম্প্রসারণ করা। বস্তুত, বাংলাদেশে বিত্তশালী মানুষেরাই কর ফাঁকি দিয়ে থাকেন বেশি। অনেকক্ষেত্রে অভিযোগ শোনা যায় কর বিভাগীয় কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ বিত্তশালীদের কর ফাঁকি দেয়ার ক্ষেত্রে সহযোগীর ভূমিকা পালন করে থাকে। একদিকে কর ফাঁকি বন্ধ করা, অপরদিকে অপেক্ষকৃত কম বিত্তশালীদেরকে কম হারে সুদ ধার্য করে করদাতার সংখ্যা দ্বিগুণে পরিণত করা প্রয়োজন।
ব্যক্তিখাতে করের সীমা বহুলাংশে বাড়ানো প্রয়োজন, কারণ দ্রব্যমূল্য হু হু করে বেড়ে যাওয়ায় ম্যধবিত্ত, নিম্নবিত্তদের করদান ক্ষমতা ক্রমশ কমে আসছে। তাই দ্রব্যমূল্য যৌক্তিকভাবে কমানো ও এর অযৌক্তিক বৃদ্ধি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষির প্রসারের ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় বাধা হয়েছে বাংলাদেশের সকল নদী বেদখল হয়ে সরু খালে পরিণত হওয়া এবং এর উভয়পাশে অবৈধ দখলদারদের তৈরি বিশাল স্থাপনা। একটি মহলের সঙ্গে আঁতাত করে নদীর বিশাল অংশ অবৈধ দখলদাররা নিজনামে রেকর্ডও করিয়ে নিয়েছে।
এক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী সি.এস খাতিয়ানকে ভিত্তি করে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, নদীগুলো গভীর ও প্রশস্তকরণের মাধ্যমে দেশে খাদ্য উৎপাদন তিনগুণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে, মৎস্য উৎপাদন দ্বিগুণ বাড়ানো যেতে পারে এবং নৌ চলাচলের সুযোগ ব্যাপকভাবে বাড়ালে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনব্যয় যথেষ্ট কমতে পারে। বড় নদীগুলোর তীরে উপযুক্ত স্থানসমূহে নদীবন্দর স্থাপন করে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। ক্ষরস্রোতা নদীগুলোতে হয়ত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগও সৃষ্টি হতে পারে।
করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে শিগগিরই দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। উদ্যোগটি বিলম্বিত তবুও এর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। এটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার প্রয়োগ শুরু করতে পারলে ভ্যাকসিনপ্রাপ্তির জটিলতামুক্ত হওয়াই শুধু নয়, ওই ভ্যাকসিন বিদেশে রপ্তানি সুযোগও পাওয়া যেতে পারে।
বাজেট ঘোষণাকালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, কর্মস্থংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বক্তব্য গতানুগতিক। দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে যে ব্যাপকভাবে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির প্রয়োজন তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভিন্নমত হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু তার পরেও বলব এ বক্তব্য গতানুগতিক। কারণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কোনো সুনির্দিষ্ট পথ দেখানো হয়নি।
একদিকে নদীগুলো সংস্কার, অপরদিকে ব্যাপকভাবে শিল্পায়ন ও রেলপথের ব্যাপক সম্প্রসারণের মাধ্যমে একমাত্র তা করা সম্ভব হতে পারে। নদী সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনীতি বিকাশের যে বিপুল ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হতে পারে- তা সম্ভবত কখনো ভাবনাতেই নেয়া হয়নি। এখন যত দ্রুত সম্ভব হাইকোর্টের রায়ের ভিত্তিতে তা ব্যাপকভাবে শুরু করা প্রয়োজন।
আর একটি বড় ক্ষেত্র হতে পারে তেল গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার করে তা আহরণ। বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকাজুড়ে তেল, গ্যাসের ব্যাপক মজুদ রয়েছে বলে বহুবার কর্তাব্যক্তিদের বক্তৃতা ভাষণে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু ওই তেল গ্যাসের কূপ খননের কাজ শুরু হওয়ার খবরটুকুও জানা যাচ্ছে না। যা জানা যাচ্ছে তা উৎসাহ সৃষ্টিতে অক্ষম।
তাই অবিলম্বে তেল-গ্যাস আহরণের জন্য কূপ খনন এবং মানসম্পন্ন কয়লা দেশের কাজে ব্যবহার শুরু করে এই গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে বিদেশনির্ভরতা-মুক্ত করতে দ্রুত সচেষ্ট হওয়ার প্রয়োজন। বাজেটে এ ব্যাপারে উপযুক্ত বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন।
লেখক: রাজনীতিক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।