বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মহামারি মোকাবিলায় দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

  • হীরেন পণ্ডিত   
  • ৩ জুন, ২০২১ ১৫:১৩

করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা প্রত্যেকের মনে মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে। সংক্রমিত হলে চিকিৎসার সুযোগ মিলবে কি না এটি নিয়েও আতঙ্ক আছে। পরিবারের সদস্যদের সংক্রমিত হওয়ার ভয়, সংক্রমিত হয়ে আইসোলেশনে থাকাকালে একাকিত্ব মনের ওপর চাপ বাড়ায়। এ ছাড়া কাছের মানুষের মৃত্যু মনকে শোকাতুর করে তোলে। ভীতিকর চিত্র বা সংবাদ দেখে আতঙ্কবোধ করে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন- এমন ব্যক্তি যখন দেখেন অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না, তখন তিনি মানসিক চাপ অনুভব করেন। চিকিৎসাসেবা কর্মীরা বাড়তি কাজের চাপের কারণে মানসিক সমস্যায় পড়েন। এ ছাড়া করোনাকালে অর্থনৈতিক সংকট বেড়েছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। এতে করে মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে।

কোভিড-১৯: করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি বর্তমান এক কঠিন বাস্তবতা। সারা বিশ্বে এই মহামারি লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়ে যাচ্ছে এবং আক্রান্ত হচ্ছে অগণিত মানুষ। কবে এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে তা কেউ জানে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, করোনা ভাইরাসের এই মহামারি সহসা দূর হবে না। তারা বলছে, অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় না আনতে পারলে করোনা মহামারির অবসান ঘটানো যাবে না। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকবে না। টিকা প্রদান শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউ যাচ্ছে। জীবন-জীবিকার স্বার্থে চালু করতে হচ্ছে সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, খুলছে অফিস-আদালত।

প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের মহামারির কারণে সারা বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। অগণিত মানুষের প্রাণহানি ছাড়াও এই মহামারি মানুষের জীবন-জীবিকায় চরম আঘাত হেনেছে। লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। হারিয়েছেন তাদের জীবিকার সংস্থান। ফলে তারা অনেকে কষ্টের মাঝে জীবন-যাপন করছেন।

আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, শরীর সুস্থ রাখা এমন বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে। তাহলে মোকাবিলা করা যাবে করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাস যেহেতু খুব সহজে যাচ্ছে না, তাই করোনার সঙ্গে অভিযোজন বা এডাপটেশন করে নেয়াই এখন জরুরি। কোভিড-১৯ মোকাবিলা এটা আপাত নৈরাশ্যজনক মনে হলেও এটা সত্য যে, মানুষের জয় হবেই।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন করোনা মহামারি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, সব দেশের মানুষের মধ্যে একইভাবে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে সংক্রমণভীতির কারণে মানুষ অনেকটাই সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। অনেককে আত্মীয়স্বজন, পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। আবার লকডাউনসহ বিভিন্ন কারণে ঘরবন্দি জীবনযাপনের কারণে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করায় সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। ঝগড়া, মারধর ও বিচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটছে।

অনেকে করোনায় পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন হারিয়েছেন। কারো কারো উপার্জন কমে গেছে। আবার কেউ কেউ চাকরি হারিয়েছেন। আবার কেউবা চাকরি হারানোর ভয়ে আছেন। এসব কারণে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। এতে করে অনেকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষণায়ও এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় ৪৬ শতাংশ মানুষের মধ্যে বিষণ্নতার লক্ষণ পাওয়া গেছে। এছাড়া ৩৩ শতাংশ মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তার লক্ষণ পাওয়া যায়। দুই বছর আগে একই প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় ফলাফল ছিল একবারেই ভিন্নরকম। তখন প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে বিষণ্নতার হার পাওয়া যায় ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। দুশ্চিন্তার সমস্যা ছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষের।

এ চিত্র বিশ্নেষণ করে গবেষকরা দেখিয়েছেন, সাধারণ সময়ের চেয়ে করোনাকালে মানসিক সমস্যা বেড়েছে। গবেষণায় আরও বলা হয়, গত এক বছরে দেশে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে প্রায় ১৪ হাজার। এ সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি। সুনির্দিষ্টভাবে কোভিড নিয়ে কুসংস্কার, ভীতির কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক, চিকিৎসাপ্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা, মৃত্যুভয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও বেকারত্বের কারণে বাড়ছে মানসিক সংকট। করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও মানসিক চাপ বেড়েছে। করোনাকালে বেড়েছে পারিবারিক ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাও। ব্যক্তির মেজাজ খিটখিটে হয়। মানুষ ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়ে।

করোনার প্রভাব শিশু-কিশোর ও তরুণদের ওপরও পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, জীবনযাত্রার রুটিন পরিবর্তনের কারণে তাদের মানসিক সুস্থতা বিঘ্নিত হচ্ছে। অনলাইন আসক্তি আর আচরণজনিত সমস্যা বাড়ছে। ভুলে যাওয়া সমস্যা, মনোযোগের অভাব, খিটখিটে মেজাজ, আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। এ ছাড়া করোনাকালে মাদক সেবনের ঘটনাও বেড়েছে। আগে পরিমাণে কম মাদক নিতেন- এমন ব্যক্তিরা করোনাকালে তা বাড়িয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বলে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যুক্তরাজ্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীদের ৩২ শতাংশ জানিয়েছেন, মহামারির কারণে মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিপর্যস্ত হয়েছে। ইতালি ও স্পেনে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে। কানাডায় ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ২০ শতাংশ বেড়েছে মদ্যপান। মহামারির আগের অবস্থার তুলনায় ইথিওপিয়ার মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা তিনগুণ বেড়েছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটের সম্পাদক ড. রিচার্ড হর্টন এক নিবন্ধে লিখেছেন, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক প্যানডেমিক নয় বরং এটি সিনডেমিক। কমপক্ষে দুই ধরনের রোগ বা সমস্যা যদি মহামারি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে কোনো বিপুলসংখ্যক মানুষের স্বাস্থ্যের (শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্য) ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তাকে সিনডেমিক বলা যায়। মহামারির কারণে আর্থসামাজিক বড় ধরনের পরিবর্তনও সিনডেমিক হতে পারে।

করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা প্রত্যেকের মনে মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে। সংক্রমিত হলে চিকিৎসার সুযোগ মিলবে কি না এটি নিয়েও আতঙ্ক আছে। পরিবারের সদস্যদের সংক্রমিত হওয়ার ভয়, সংক্রমিত হয়ে আইসোলেশনে থাকাকালে একাকিত্ব মনের ওপর চাপ বাড়ায়। এ ছাড়া কাছের মানুষের মৃত্যু মনকে শোকাতুর করে তোলে। ভীতিকর চিত্র বা সংবাদ দেখে আতঙ্কবোধ করে।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন- এমন ব্যক্তি যখন দেখেন অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না, তখন তিনি মানসিক চাপ অনুভব করেন। চিকিৎসাসেবা কর্মীরা বাড়তি কাজের চাপের কারণে মানসিক সমস্যায় পড়েন। এ ছাড়া করোনাকালে অর্থনৈতিক সংকট বেড়েছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। এতে করে মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন খাবার, ঘুম ও ব্যায়ামের সময়সূচি ঠিক রাখতে হবে। ঘরে থাকাকে বন্দি বলে মনে করা যাবে না। গুজবে কান দেয়া যাবে না। করোনাভাইরাসের বাইরেও জীবন আছে- সেটা মাথায় রেখে পড়ালেখা করা, নিজের যত্ন নেয়া, বইপড়া, মুভি দেখা বা ব্যক্তিগত কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে মিলে ঘরের ছোটখাটো কাজ যেমন- রান্নায় সাহায্য করা, ঘর পরিষ্কার করা ইত্যাদিতে অংশ নিতে হবে। বন্ধু ও সহপাঠীদের সঙ্গে সামাজিকভাবে সংযুক্ত থাকতে হবে।

প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল নতুন দরিদ্রতা সাময়িক। কিন্তু মহামারির এক বছর পরও যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গিয়েছিলেন, তারা বের হয়ে আসতে পারেননি। মহামারির প্রথম ঢেউয়ে ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ, অর্থাৎ জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছিলেন। আগে যে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিলেন, তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন নতুন এই ২২ শতাংশ মানুষ।

বর্তমানে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র। অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে পুনরুদ্ধার ও মহামারি মোকাবিলার সামর্থ্য মানুষ হারিয়েছেন। আয় কমে গেলেও তাদের ঋণ বেড়েছে। জনসংখ্যার একটি বড় অংশ জীবনযাপনের জন্য সংগ্রাম করছে। লকডাউনে দরিদ্র জনগোষ্ঠী যে ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হচ্ছে, তা মহামারির ভয়াবহতার চেয়ে কম উদ্বেগজনক নয়।

বিদেশফেরতদের ৮৭ শতাংশ গত বছর বেকার ছিলেন তবে এবার তাদের প্রায় ৫৩ শতাংশ কোনো না কোনো কাজে নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছেন। এর মধ্যে ২৪ দশমিক ১৯ শতাংশ কৃষিকাজে যুক্ত হয়েছেন, ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ দিনমজুর বা এ ধরনের কোনো কাজে যুক্ত হয়েছেন এবং ৩৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ ছোট ব্যবসা শুরু করেছেন।

এছাড়া ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ অন্য কোনো কাজ করছেন। ৪৭ দশমিক ২২ শতাংশ বিদেশফেরত গত এক বছরে কোনো প্রকার কাজ জোগাড় করতে পারেননি। তারা তাদের দৈনন্দিন খরচ চালাতে পরিবারের আয়ের ওপর নির্ভরশীল কিংবা আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে চলছেন।

প্রবাসীদের বর্তমান মানসিক অবস্থাও উঠে এসেছে। তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও ভীতির মধ্যে আছেন। অপর্যাপ্ত আয়, বেকারত্ব, পুনরায় বিদেশ যেতে না পারা, পারিবারিক চাপ ইত্যাদি কারণে চরম উদ্বিগ্নতা এবং মানসিক চাপের মধ্যে আছেন।

বিশেষজ্ঞদেরও মত, আমাদেরও মনে হয় করোনা ভাইরাস খুব শিগগিরই শেষ হচ্ছে না। আবার মনে হতে পারে, এই করোনা ভাইরাস কখনোই যাবে না। হয়তো বা রূপ বদলাবে, প্রকৃতি বদলাবে, পরিস্থিতি বদলাবে, হয়ত এক সময় দুর্বল হয়ে আসবে। কিন্তু মনে হয়, করোনা থাকবে আমাদের চারপাশেই।

সবাইকেই করোনার সঙ্গে অভিযোজন বা এডাপটেশন করে বেঁচে থাকার উপায় বের করতে হবে। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় দৃঢ় মনোবল থাকতে হবে। কিন্তু শুধু দৃঢ় মনোবল দিয়ে কাজ হবে না, শারীরিক ও মানসিক দৃঢ় মনোবল থাকতে হবে। আসলে দৃঢ় মনোবল, শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করাও জরুরি। তবে আমাদেরকে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

আমাদের করোনাপূর্ব বিশ্বে ফিরে যেতে অনেক সময় লাগবে। করোনা পরবর্তী বিশ্ব হবে আসলে এক নতুন বিশ্ব। করোনার কারণে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশও একটু হলেও পাল্টেছে। অফিসে প্রবেশ করা থেকে শুরু করে, সবক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। অফিসে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয়ত বদলে যাবে বসার ব্যবস্থা। সব কিছুতেই অভিযোজন বা এডাপটেশন করতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক

এ বিভাগের আরো খবর