জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানের আদলে পরিচালিত করার খলনায়ক যদি কয়েকজন থেকে থাকেন তাহলে তাদের মধ্যে অন্যতম জিয়াউর রহমান।
সুমহান মুক্তিযুদ্ধেও এই জিয়াউর রহমান যে পাকিস্তানিদের দোসর হিসেবে কাজ করেছেন, সেটিও এখন ঐতিহাসিকভাবে, দালিলিকভাবে প্রমাণিত। বাংলাদেশের রাজনীতির খলনায়ক হিসেবেই তিনি বর্তমান প্রজন্মের কাছে পরিচিত।
আজকের এই দিনে জিয়াউর রহমানকে নিয়ে লেখার মূল কারণটা হচ্ছে, বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কলঙ্কিত দিন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির জন্য প্রথম গণনির্বাচন। সেনাবাহিনীর প্রধান পদে থেকেই নির্বাচনে লড়েছিলেন জিয়াউর রহমান।
এই নির্বাচন ছিল বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করারই নির্বাচন। কেননা, দেশের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী সরকারি কোনো পদে থেকে কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। কিন্তু জিয়া ছিলেন কমান্ডার ইন চিফ, চিফ অব স্টাফ এবং চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর পদে আসীন।
১৯৭৫ সালের ১১ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের দেয়া ভাষণের সঙ্গে জেনারেল আইয়ুব খানের ১৯৫৮ সালের ৮ অক্টোবরের ভাষণের অনেক মিল পাওয়া যায়। পাকিস্তানি সামরিক শাসকের মতো তিনি বলেছিলেন-
‘আমি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে দেশে সামরিক আইন জারি আছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় সময়ের অতিরিক্ত সরকার সামরিক আইন বলবৎ না রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।... আমি পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই যে রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নাই এবং আমার সরকার সম্পূর্ণ নির্দলীয় এবং অরাজনৈতিক।’
মেজর জেনারেল জিয়ার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সামরিকতন্ত্রের দীর্ঘ এক অন্ধকার যুগে যাত্রা শুরু করেছিল। এই সময়টা ছিল মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, রাজাকার পুনর্বাসন এবং ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মূলমন্ত্রকে সংবিধান থেকে মুছে ফেলে বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরণের ইতিহাস।
মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন একাধারে প্রেসিডেন্ট, কমান্ডার ইন চিফ, চিফ অব স্টাফ এবং চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। যেকোনো সময় বিচারপতি নিয়োগ ও বরখাস্ত করার ক্ষমতা থেকে শুরু করে উপদেষ্টা কাউন্সিলকে দেয়া তার যেকোনো আদেশ প্রচলিত আইনের বাধ্যবাধকতা মুক্ত ছিল। জিয়ার সিদ্ধান্ত বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও কোনো মামলা করা সম্ভব ছিল না। এককথায় তিনি সব আইনকানুনের ঊর্ধ্বে ছিলেন এবং ভাবতেনও সেটা।
সে সময়টায় দেশে সামরিক আইন জারি থাকার কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মিছিল-সমাবেশসহ সব কর্মসূচির ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে দুঃখ ও অনুতাপের বিষয় এই যে, বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপিসংশ্লিষ্ট সবার মুখে বারবার শুনে আসছি ‘জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা’। কেমন ছিল ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের’ নির্বাচনগুলো? কেমন ছিল ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের’ সেই দিনগুলো?
১৯৭৮ সালের ২১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। প্রায় ৪০ দিন পর জুনের ৩ তারিখে নির্বাচন। নির্বাচনকে সামনে রেখে ওই বছরের ১ মার্চ থেকে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়। সেদিন জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলসহ (জাগদল) ৬টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠিত হয়।
মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টপ্রার্থী। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ৫টি দলের সমন্বয়ে গঠিত গণঐক্য জোটের প্রার্থী জেনারেল (অব.) এম এ জি ওসমানী। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও নির্বাচন কমিশন থেকে ভোটার তালিকা বিক্রি হচ্ছিল ৬০ হাজার মার্কিন ডলারে।
মাত্র ৪০ দিনের মধ্যে জেনারেল ওসমানীর পক্ষে নির্বাচনি তহবিল সংগ্রহ করে পোস্টার ছাপানো কিংবা ভোটার তালিকা কেনার সামর্থ্য ছিল না। নির্বাচনি প্রচারণার শুরু থেকেই জেনারেল ওসমানী বিভিন্ন অনিয়মের কথা বলছিলেন।
সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে ছাপানো জিয়ার নির্বাচনি পোস্টারে পুরো দেশ ছেয়ে যায়। সরকারি গণমাধ্যমে ঢাকঢোল পিটিয়ে তার নির্বাচনি সমাবেশের খবর প্রচারিত হয়। এমনকি দেশের জেলা প্রশাসনগুলো নিজেরাই জিয়ার সমাবেশের লিফলেট ছাপিয়ে জনগণের মধ্যে বিতরণের দায়িত্ব নিয়েছিল। ওসমানী অভিযোগ করেন গণমাধ্যমে তার বক্তব্য বিকৃতভাবে প্রচার হচ্ছে। এমনকি সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকায় তাকে নিয়ে একের পর এক ভিত্তিহীন রিপোর্ট প্রকাশিত হতে থাকে।
এই কলঙ্কিত নির্বাচন নিয়ে আরেকটা বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে, সাধারণত বাংলাদেশে বর্ষা শুরু হয় জুনে। এটা নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপযুক্ত সময় নয়। জিয়ার এতে কোনো সমস্যা হয়নি, তিনি সরকারি হেলিকপ্টারে চড়ে পুরো দেশে জনসমাবেশ করতে থাকেন। অপরদিকে জেনারেল ওসমানী জিপে চড়ে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। প্রবল বৃষ্টির কারণে তার পক্ষে গ্রামাঞ্চলে প্রচারণা চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল।
এই অবস্থায় গণঐক্য জোটের ৯০ দিনের জন্য নির্বাচন পেছানোর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয় । নির্বাচন কাভার করতে আসা নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক উইলিয়াম বর্ডার ১৯৭৮ সালের ৪ জুন প্রকাশিত রিপোর্টে প্রচুর জাল ভোট আর প্রতিপক্ষ এজেন্টদের নির্বাচনি কেন্দ্র থেকে বের করে দেবার কথা লেখেন। এই নির্বাচনে গণঐক্য জোটের ৪০ কর্মী নিহত হন। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা হামলা করে ২০০টির অধিক কেন্দ্র থেকে পোলিং এজেন্ট আর নির্বাচনি পর্যবেক্ষকদের বের করে দেয়।
ওই নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট থেকে জিয়াউর রহমান ভোট পেয়েছিলেন ১৫,৭৩৩,৮০৭টি। যা মোট প্রাপ্ত ভোটের ৭৬.৬ শতাংশ। গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের প্রার্থী মোহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী প্রাপ্ত ভোটের ২১ দশমিক ৭ শতাংশে মোট ভোট পেয়েছিলেন ৪,৪৫৫,২০০টি। অন্য আট প্রার্থী ভোট পেয়েছিলেন ৩,৪২,৫৫৪, অবৈধ এবং খালি ভোটের সংখ্যা ছিল ৩,৫৪,০১০টি। প্রহসনের ওই নির্বাচনে মোট ভোট পড়েছিল ২০,৮৮৫,৫৭১টি।
স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৭৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হয়। ইতিপূর্বে এ নির্বাচনকে সামনে রেখে ঢাকার রমনা ময়দানে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়।
আবদুল মালেক উকিলের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছিল নির্বাচনে বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসা অনেকে বিপুল ভোট জালিয়াতি সত্ত্বেও বিএনপির ভোটের পরিমাণ কম দেখে (৪১.২%) অবাক হয়েছিলেন।
নির্বাচনি অনিয়মের উদাহরণ হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানের কথা বলা যায়। তিনি নিজের আসনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ১২০০ ভোট বেশি পেয়ে জয়লাভ করেন। অথচ নির্বাচনের দুই দিন পর তাকে ২০০ ভোটে পরাজিত ঘোষণা করা হয়। মেজর খলিল ভোট পুনর্গণনার ব্যাপারটা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। নির্বাচনের পর বিএনপি জোটের অন্যতম শরিক মুসলিম লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট মুখ ফসকে সাংবাদিককে বলে ফেলেছিলেন, অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত। এই ছিল কথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের অবস্থা!
সময়টা তখন এমনই ছিল, জিয়াউর রহমান একদিকে কথিত গণতন্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা (!) চালিয়ে যাচ্ছিলেন, অপরদিকে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ধরে দেশের জেলখানাগুলো ভরে ফেলেছিলেন।
১৯৭৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, দেশের বিভিন্ন জেলে বন্দির সংখ্যা ৩৬,৬৮৫ জন। স্বাভাবিক অবস্থা থেকে অতিরিক্ত বন্দিতে কারাগারগুলোয় তিল ধারণের জায়গা ছিল না। বন্দিদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল। একই বছর নভেম্বরে গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছিল ৫৩ হাজার। জিয়াউর রহমানকে নিয়ে মাসকারেনহাস লিখেছিলেন-
‘সামরিক বাহিনীর লোকদের হত্যার হিসেবে জিয়াউর রহমান উপমহাদেশের যেকোনো জেনারেলকে ছাড়িয়ে গেছেন। আর যারা বেসামরিক সাধারণ মানুষ...! সে পরিসংখ্যান কি কারো জানা আছে?’
বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার খলনায়ক জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি, যেটি আদর্শিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী এবং পাকিস্তানের ভাবধারায় পরিচালিত তাদের বর্তমান অবস্থা সবাই জানেন। তারা নির্বাচনে বিশ্বাস করে না।
২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ষড়যন্ত্র করেই ক্ষমতায় আসার স্বপ্নে এখনও বিভোর আছে। তবে আমরা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারাই, বিএনপি নামক দলকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করতে পেরেছি। আমরা চাই না, আর কোনোদিন বাংলাদেশে সামরিক শাসন আসুক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজগুলো তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই হবে, এই বিশ্বাস আছে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু! বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।