প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় ডাক বিভাগের নতুন প্রধান কার্যালয় উদ্বোধন করেছেন সম্প্রতি। তাই ডাক পরিষেবা নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করছিলেন। ডাকঘর, পোস্টমাস্টার, ডাক হরকরা, ডাকপিওন, লাল রঙের লেটার বক্স পোস্টকার্ড, খাম, ডাকটিকিট, মানি অর্ডার এসবের কথা দেশের মানুষ একরকম ভুলেই গেছে। আমি নিজেও তাই।
আমার ছোটবেলায়, যখন পাবনা জেলার সাবেক সাঁথিয়া থানার (হালের আতাইকুলা) ভুলবাড়িয়া গ্রামে বাস করতাম, শৈশবে দেখতাম খাম, পোস্টকার্ড, পিওন, পোস্টমাস্টারের কী অপরিসীম প্রয়োজনীয়তা। মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জীবনের নির্ভরযোগ্য সাথি ছিল এ যোগাযোগ মাধ্যমটি।
দেশ-বিদেশ থেকে চিঠি আসত খামে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে। তখন বিমান সার্ভিস এ দেশে (গোটা ভারতবর্ষেও) চালু হয়নি। তাই চিঠিপত্র আসত ট্রেন ও বাসে।
রেল ও সড়কপথও তখন ছিল নামমাত্র। তবু সেগুলোর ওপর নির্ভর করা ছাড়া ভিন্ন অন্য কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু দেখা যেত রেলগাড়ি যেখানে এসে থামত, সেখান থেকে ডেলিভারি নিয়ে বাসে চাপানো হতো ডাকসামগ্রী ভর্তি হলুদ রঙের ছোট-বড় ব্যাগগুলো।
বাসের চলাচল পথও তখনকার দিনে অত্যন্ত সীমিত থাকায় বাস যেখানে থামত, নিকটবর্তী ডাকঘর থেকে লোক এসে তা নিয়ে যেত। আর বাসস্ট্যান্ড থেকে ডাকঘর যদি কয়েক মাইল দূরে অবস্থান করত তবে রানার এসে ওই ব্যাগগুলো কাঁধে নিয়ে এক হাতে লাঠি (শরীরের ভারসাম্য রাখার জন্য) নিয়ে গুনগুন করে এক ধরনের শব্দ করতে করতে ছুটতেন, দীর্ঘপথ পেরিয়ে ক্লান্ত দেহে সংশ্লিষ্ট ডাকঘরে পৌঁছাতেন।
‘রানার’ নামক বিখ্যাত কবিতায় সুকান্ত ভট্টাচার্য রানার বা ডাক হরকরাদের শ্রম ও জীবনের চিত্র অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। রানার কবিতার কিছু অংশ উদ্ধৃতি দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না-
রানার ছুটেছে তাই ঝুম্ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতেরানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,রানার চলেছে, রানার !রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার ।দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার-কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।রানার! রানার!জানা-অজানারবোঝা আজ তার কাঁধে,বোঝাই জাহাজ রানার চলেছে চিঠি আর সংবাদে;রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়,আরো জোরে, আরো জোরে হে রানার দু্র্বার দুর্জয়।তার জীবনের স্বপ্নের মতো পিছে সরে যায় বন,আরো পথ, আরো পথ – বুঝি লাল হয় ও পূর্ব কোণ ।অবাক রাতের তারারা, আকাশে মিট্মিট্ করে চায়;কেমন করে এ রানার সবেগে হরিণের মতো যায়!কত গ্রাম, কত পথ যায় স’রে স’রে –শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে;হাতে লন্ঠন করে ঠন্ঠন্, জোনাকিরা দেয় আলোমাভৈঃ রানার ! এখনো রাতের কালো।এমনি ক’রেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে,পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে ‘মেলে’।ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামেজীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে,ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।রানার! রানার!এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?
যা হোক, এসবই ভুলে যাওয়া ইতিহাস। তখন আই ফোন, স্মার্ট ফোন তো দূরের কথা, সাধারণ মোবাইল ফোনও ছিল না। শহর এলকায় অত্যন্ত ধনী ও বড় সরকারি কর্মকর্তাদের বাড়িতে ছিল ল্যান্ডফোন। সামর্থ্য অভাবে তখন মধ্যবিত্ত নিম্ন-মধ্যবিত্তরাও ওই ফোন নিতে পারত না।
কুরিয়ার সার্ভিসও তখন চালু হয়নি। ফলে কারও সঙ্গে তা তিনি ৫/৭ মাইলই হোক বা দেশ-বিদেশের দূরবর্তী এলকায় অবস্থান করা প্রিয়জনদের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ডাক বিভাগ।
কুরিয়ার সার্ভিস তো মাত্র সেদিন চালু হলো- কিন্তু কেন? ডাক বিভাগের দুর্বলতা- যা ষাটের দশকের শেষ থেকে শুরু হয়ে তা দিনে দিনে অবহেলা অযত্নে নষ্ট হয়ে যায়।
বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী মারাত্মকভাবে কাজে ফাঁকি দেয়া শুরু করেন। প্রাপকের বাড়িতে গিয়ে চিঠি বিলি করার নিয়ম থাকলেও হাটেবাজারে প্রাপক প্রাপিকার গ্রামের বা প্রতিবেশীদের হাতে দিয়েই পিওন দায়িত্ব শেষ করত। ফলে বহু চিঠিপত্র প্রাপকের হাত পর্যন্ত পৌঁছাতই না। রেজিস্টার্ড চিঠির ক্ষেত্রে এমন দায়িত্বহীনতার অভিযোগ নেহাত কম ছিল না।
ভুয়া স্বাক্ষরের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে মনি-অর্ডারের টাকা ডাক পিওন বা ডাক-বিভাগীয় কর্মকর্তারা আত্মসাৎ করেছেন- অনেক ক্ষেত্রে এমন অভিযোগও পাওয়া যেত।
শেষে ডাক বিভাগ ‘Express Delivery’ নামে একটি পদ্ধতি চালু করেন-যার ফলে ওই পদ্ধতিতে ন্যূনতম ১০ টাকা (ওজন ভিত্তিতে) গিয়ে যে সকল ডাকঘরে (নিকটবর্তী বা দূরবর্তী এলাকায়) চালু হয়েছে সেখানে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রেজিস্টার্ড খামের মতো পৌঁছে দেয়া হতো। এই সুযোগ প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যে কদাপি জোটেনি, আজও জুটছে না।
ফলে ধীরে ধীরে কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবসায় প্রসার ঘটতে থাকল আজও কেউ কুরিয়ার ছাড়া ভাবেন না। কারণ কুরিয়ার সার্ভিস প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে; তাদের সার্ভিসও মানুষের আস্থা বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে। ফলে চিঠিপত্র, টাকার ব্যাংক চেক, বই-পুস্তক এমনকি অপরাপর পণ্যও লোকে নির্দ্বিধায় বুক্ড করে দেন, প্রাপকের হাতেও তা ঠিকমতোই পৌঁছে যায়।
অবশ্য স্মার্ট ফোন, আই ফোনের কল্যাণে এখন চিঠিপত্রের আদান-প্রদান মারাত্মকভাবে কমে গেছে। ইন্টারনেট আবিষ্কৃত হওয়ায় দূর দেশেও প্রয়োজনে কথাবার্তা বলার ও ভাববিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ভিডিও কল করে উভয়পক্ষ চাক্ষুষ কথাবার্তা বলাও ব্যাপকভাবে চালু হয়েছে।
এ ছাড়াও ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও ব্যবহৃত হয় খবর, ছবি আদান-প্রদান, এমনকি গানের অডিও ভিডিও পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়াও সম্ভব। ফলে ফোনে দিনরাতে ইচ্ছেমতো অনেক গান শোনাও সম্ভব হচ্ছে।
ডাক বিভাগের অপমৃত্যু শুধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের অবহেলার কারণেই যে ডাক ব্যবস্থা এমন দুর্দিনের মুখোমুখি হয়েছে তা নয়। ডাকঘরের কয়েকটি স্তর আছে।
ঢাকার জেনারেল পোস্ট অফিস, জেলাগুলোতে ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেলা অফিস ও জেলা ডাকঘর, উপজেলা পর্যায়েও উন্নত ডাকঘর অবশ্য সব থানা এলাকায় নয়, গ্রামাঞ্চলে সম্ভবত ইউনিয়নভিত্তিক ডাকঘর। এই শেষোক্ত স্তরে ডাকঘরগুলোর পোস্টমাস্টার বেতন পান না, পান কিছু ভাতা। তিনি তার বাড়ির একটি ঘরেই ডাকঘরের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেন-জোগাড় করেন একটি টেবিল ও চেয়ার এবং বড়জোর ছোটখাটো একটা আলমারি। ওই আলমারিতে ফাইলপত্র থাকে যার ব্যবহার কখনোই নিয়মিত নয়।
ওই গ্রামীণ বা ইউনিয়ন ডাকঘরের যিনি বা যারা পিওন তারা সরকারি স্কেল অনুযায়ী বেতন পান। ফলে পোস্টমাস্টার থাকেন ক্ষুব্ধ। ওই পোস্টমাস্টার মারা গেলে বা চাকরি ছেড়ে দিলে আর একজনকে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
এই পোস্টমাস্টার হয়তো অন্য কোনো গ্রামের তাই পোস্ট অফিসটাও স্থানান্তরিত হয়। সে ক্ষেত্রে পিওনদের হয় নানা অসুবিধা। সামগ্রিক বিবেচনায় ডাক সার্ভিস মানুষের সেবা দিতে ব্যর্থ হলো। ওপরের স্তরের ডাকঘরগুলোতে অবশ্যই সরকার নির্মিত ডাকঘর এবং পোস্টমাস্টারসহ অপরাপর কর্মচারী সবাই সরকারি বেতনভুক্ত। কিন্তু আধুনিকায়ন না হওয়াতে ডাকসেবা দিনে দিনে অর্থহীন হয়ে পড়ল। আজও তা অব্যাহত আছে।
বিগত ২৭ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি ঢাকার আগারগাঁওয়ে প্রায় শত কোটি টাকা ব্যয়ে সকল আধুনিক ব্যবস্থাদি সম্পন্ন দৃষ্টিনন্দন ডাকঘরের নতুন প্রধান কার্যালয় উদ্বোধন করেন এবং কর্মকর্তা কর্মচারীদের আধুনিক ব্যবস্থাধীনে জনগণের সেবা দিতে বলেন।
ভাবছি এই উদ্যোগ কি সফল হবে? সফল করতে হলে
এক. নিষ্ক্রিয়তা ও অবহেলায় অভ্যস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তি দিতে হবে;
দুই. যারা উৎসাহ ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করবেন- তাদেরকে নানাভাবে উৎসাহিত করতে হবে;
তিন. দ্রুত ডাক ও পণ্য পরিবহনের জন্য সকল জেলা-উপজেলায় কমপক্ষে দুটি করে পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে;
চার. ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল পদ অপ্রয়োজনীয় এবং মাথাভারী শাসন ব্যবস্থার প্রতীক। তাই ডিপিএমজি পদ ও তার অফিস তুলে দিতে হবে- কর্মচারীদের অন্যত্র পদায়ন করতে হবে।
পাঁচ. ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসের সংখ্যা তিন গুণ বাড়াতে হবে।
ছয়. প্রতি জেলা শহরে ও থানায় নিরাপদ স্থান দেখে কমপক্ষে ১০০টি করে লেটার বক্স স্থাপন করতে হবে;
সাত. পার্শ্বেল চিঠিপত্র, রেজিস্টার্ড ডাকসুলভ এবং তার হার কমাতে হবে;
আট. দ্রুত প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত মনি অর্ডার পৌঁছানোর ব্যবস্থা ও সকল স্তরের ডাকঘর সকাল নয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত;
নয়. পোস্টাল সঞ্চয় ব্যবস্থায় অ্যাকাউন্ট ডেলিভারদের সুদহার বাড়াতে হবে।
লেখক: রাজনীতিক, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।