১৯৮১ সালের ৩০ মে শনিবার ভোরে জিয়া হত্যার দুই দিন পর ১ জুন সোমবার মধ্যরাতে উপর মহলের নির্দেশে ঠান্ডা মাথায় একটিমাত্র বুলেটে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, চট্টগ্রাম সেনানিবাসের তৎকালীন জিওসি জেনারেল আবুল মঞ্জুর বীর উত্তমকে হত্যা করা হয়। জিয়া হত্যার পর বিদ্রোহের দায়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে প্রহসনের গোপন বিচারে ১৩ সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করে ঘাতক সর্দার জেনারেল এরশাদ।
১৯ বছর পর মঞ্জুর হত্যার বিচার চেয়ে তার বড় ভাই ব্যারিস্টার আবুল মনসুর মামলা করেন। বিচারকাজ সম্পন্ন হলেও গত চল্লিশ বছরে শুধু হত্যা-ষড়যন্ত্রের মূল পরিকল্পনাকারীকে বাঁচানোর কু-উদ্দেশ্যে মনজুর হত্যা মামলার রায় হয়নি। ইতিহাস একদিন বলবে একজন ভণ্ড, প্রতারক, পাকিস্তানের চর ও খুনিকে বাঁচানোর জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুর বীর উত্তম হত্যা মামলার বিচারের রায় দেয়া হয়নি।
আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যায় সবচেয়ে লাভবান ব্যক্তি হচ্ছেন জেনারেল জিয়া। স্বাধীনতাবিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের এদেশীয় চর জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যা-ষড়যন্ত্রের প্রধান হোতা। বিদেশি সাংবাদিক লিফশুলৎজ বলেছেন, ‘তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়া মদত না দিলে ফারুক-রশীদরা কোনো দিনই শেখ মুজিবকে হত্যার সাহস পেত না।’
জিয়া-মঞ্জুর হত্যার সবচেয়ে লাভবান ব্যক্তি হচ্ছেন পাকিস্তানের প্রেতাত্মা জেনারেল এরশাদ।
গত ৪০ বছরে জিয়া-মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে বই প্রকাশসহ দেশ-বিদেশে অসংখ্য লেখালেখি হয়েছে। এটা প্রায় শতভাগ প্রমাণিত সত্য যে, জিয়া-মঞ্জুর হত্যার মূল হোতা হচ্ছে তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ। জিয়া ছাড়া যেমন বঙ্গবন্ধু মুজিব হত্যা সম্ভব হতো না, তেমনি এরশাদ ছাড়া জিয়া হত্যাও হতো না।
মঞ্জুর হত্যা মামলার সাক্ষী তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধানের সাক্ষ্য, তৎকালীন আইজিপির বক্তব্য, বিদেশি সাংবাদিক লিফশুলৎজের ধারাবাহিক নিবন্ধ, মঞ্জুর হত্যা মামলার এজাহার ও চার্জশিট এবং মেজর আরেফিনের লেখা ‘জিয়া-মঞ্জুর হত্যা ও তারপর’ গ্রন্থের সারসংক্ষেপ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়- স্বাধীনতাবিরোধীদের চর তৎকালীন সেনাপ্রধানের নির্দেশেই সুপরিকল্পিতভাবে আটক মঞ্জুকে হত্যা করা হয়েছে।
জিয়া হত্যার পর মঞ্জুর জীবিত থাকলে জিয়া হত্যাকারীর মুখোশ যেমন উন্মেচিত হতো, তেমনি এরশাদও রাষ্ট্রপতির গদি দখল করতে পারত না। জিয়া-মঞ্জুর হত্যা একই সূত্রে গাঁথা। যেমনিভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীরাই জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে।
জিয়া হত্যার সময় বিমানবাহিনী প্রধান ছিলেন এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দিন। সদরউদ্দিন মঞ্জুর হত্যা মামলার সাক্ষ্য দেয়ার সময় বলেছেন-
‘১৯৮১ সালের ১ জুন বিকেলে আমি বঙ্গভবনে ছিলাম। এ সময় ফোনে অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, মঞ্জুর ধরা পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতির লাল টেলিফোনে এরশাদ কোনো একজনকে বলেন, “পুলিশের কাছে মনজুর ধরা পড়েছে। তাকে দ্রুততার সঙ্গে নিয়ে এসে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করো।” পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে উত্তেজিত সেনাপ্রধান বলেন, “এয়ার চিফ আপনি কিছুই বোঝেন না?”’ ওই পরিকল্পনার সাদামাটা অর্থ হচ্ছে, ধরা পড়ার পর ঠান্ডা মাথায় জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়। সদরউদ্দিনের কথার প্রমাণ রয়েছে মেজর আরেফিনের লেখা তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থে। আরেফিন লিখেছেন-
‘ঐ রাতে ঢাকার নির্দেশেই সুপরিকল্পিতভাবে মঞজুরকে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রামের তৎকালীন সিও ব্রিগেডিয়ার আজিজুল ইসলাম আরেক ব্রিগেডিয়ার (পরে মেজর জেনারেল) লতিফের সামনে ক্যাপ্টেন এমদাদকে নির্দেশ দেন যে, হাটহাজারী থেকে সেনানিবাসে যাওয়ার সময় মঞ্জুরকে হত্যা করতে হবে।’
জিয়া হত্যার পর ঠান্ডা মাথার খুনি এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেননি। হত্যার পর পর এরশাদ ক্ষমতা নিলে দেশ-বিদেশের সবাই বলত এরশাদই খুনি। যেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আসল খুনি জিয়াকে রাষ্ট্রপতি করা হয়নি। জিয়া হত্যার পর ওই সময় বিচারপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও পরে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি থাকলেও ক্ষমতার দণ্ড ছিল সেনাপ্রধান এরশাদের হাতে।
রাষ্ট্রপতি হত্যার পর ধুরন্ধর এরশাদ তার ক্ষমতা দখলের পথে বাধাগুলো অপসারণ করেন। সেই লক্ষ্যে প্রথমে মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়। এরপর জিয়া হত্যার সময় বিদ্রোহের অভিযোগে সাজানো ও ভুয়া বিচারে ১৩ জনকে ফাঁসি, ৭ জনকে যাবজ্জীবন ও ৬ জনকে ৭ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। সাজা পাওয়া ব্যক্তিদের প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান ছিলেন। ফাঁসিতে হত্যা করা ১৩ জনের মধ্যে অন্তত ১০-১১ জন জিয়া হত্যার বিষয়ে কিছুই জানতেন না।
এরপর পাকিস্তানপন্থি সেনা কর্মকর্তাদের সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়। জিয়া হত্যার ১০ মাস পর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সামরিক আইন জারি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। ক্ষমতা দখলের পর একইভাবে তার গুরু জিয়াকে অনুসরণ করে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন এবং বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা চিরতরে মুছে ফেলার চক্রান্ত করেন এইচএম এরশাদ।
তবে জিয়া হত্যার জন্য এরশাদ গং মঞ্জুরকে দায়ী করলেও মঞ্জুর ওই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। ৩০ মে সকাল ৯টার দিকে চট্টগ্রাম থেকে জুনিয়র অফিসারদের দ্বারা চাপের মধ্যে থাকা মনজুর ফোনে জেনারেল মইনুলকে বলেন, ‘জিয়া হত্যার ব্যাপারে পরে বিস্তারিত জানাবেন। ঢাকায় যেন কোনো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ না হয়। আমি আর বলতে পারছি না।’ (মইনুলের গ্রন্থ, পৃ. ১১০)।
চার দশক পরেও জিয়া হত্যাকে কেন্দ্র করে ১৩ জন সেনা কর্মকর্তাকে ফাঁসি দেয়ার গোপন বিচারটি যদি উচ্চ আদালতে পুনর্বিচার করা হতো, তাহলে বহু ঐতিহাসিক সত্য ও অজানা ষড়যন্ত্রের কথা জানা যেত। শোনা যায়, জে. মঞ্জুর খুবই ঘৃণার চোখে দেখতেন চরম দুর্নীতিবাজ এরশাদকে। মঞ্জুর সেনাপ্রধানের নামটিও উচ্চারণ করতেন না। তাকে বলতেন ‘থিফ’।
জিয়া হত্যা অপারেশনে নেতৃত্ব দেন লে. কর্নেল মতিউর রহমান। প্রকৃতপক্ষে দুই লে. কর্নেল মতিউর ও মাহবুবই ছিলেন জিয়া হত্যা-ষড়যন্ত্রের মূল হোতা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুজনই বেঁচে নেই। জানা যায়, জিয়া হত্যার দুই দিন পর ৩১ মে রাতে সেনানিবাস থেকে অন্যত্র যাবার পথে সরকারি সৈন্যদের দ্বারা তারা আক্রান্ত হন।
এ সময় মতিউর চেঁচিয়ে বলেন, ‘শুট মি মাহবুব শুট মি।’ দুজনের স্টেনগান থেকেই গুলি বের হয় এবং চিরতরে শেষ হয়ে যান ওই দুজন। এই দুজনই ভালোভাবে বলতে পারতেন জিয়া হত্যা-ষড়যন্ত্রের মূল কথা। জিয়া হত্যা-ষড়যন্ত্রে এই দুই হোতা মতি-মাহবুবের রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড নিয়েও তদন্ত হওয়া উচিত।
কোনো কোনো সূত্রমতে, জে. এরশাদের সঙ্গে মতি-মাহবুবের গভীর সখ্য ছিল। তারা দুজন জে. এরশাদের চর হিসেবে তার নির্দেশেই জে. জিয়াকে হত্যা করে থাকলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এদিকে জে. জিয়াকে হত্যার সময় যেসব সেনাসদস্য সার্কিট হাউসে গিয়েছিল, তাদের অনেকেই জানত না যে, রাষ্ট্রপতিকে খুন করা হবে।
সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের লেখা ‘এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ গ্রন্থে জিয়া হত্যার ঘটনাবলি রয়েছে। ঘাতক দলের নেতৃত্বে ছিল লে. কর্নেল মতিউর রহমান। গ্রন্থে বলা হয়, ১৬ অফিসারকে নিয়ে একটি পিকআপে ওঠেন মতি। মতি সঙ্গীদের বলেন, ‘আমরা আজ প্রেসিডেন্টকে হাতের মুঠোয় পাবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছি।’ ঘাতক বাহিনী দুটি দলে বিভক্ত হয়। ৯ নম্বর কক্ষে রাষ্ট্রপতির ওপর আঘাত হানার দায়িত্ব দেয়া হয় লে. কর্নেল ফজলে হোসেনকে। মতি নিজে থাকলেন দ্বিতীয় দলে।
বৃষ্টির মধ্যে কালুরঘাট থেকে রাত সাড়ে ৩টার দিকে রওনা হওয়ার পর লে. রফিক প্রথম দলের পিকআপে বসে ফজলে হোসেনকে কম্পিত স্বরে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনারা কি প্রেসিডেন্টকে খুন করতে যাচ্ছেন?’ কর্নেল ফজলে জানান, ‘না, আমরা কেবলই তাকে তুলে আনতে যাচ্ছি।’
এই নির্দোষ তরুণ যুবক রফিককেও বিশ্ববেহায়া ঘাতক সর্দার ফাঁসিতে হত্যা করে। রফিক মাত্র ১৩ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। চার সদস্যের পেছনের দলে কর্নেল মতিসহ অন্যরা ৯ নম্বর কক্ষ খুঁজতে থাকে। ক্যাপ্টেন সাত্তার লাথি মেরে দরজা ভেঙে ওই কক্ষে ড. আমিনা রহমানকে দেখতে পান। এই হুড়োহুড়ির মধ্যে ৪ নম্বর কক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়া বের হয়ে আসেন।
সাদা পায়জামা পরা উশকোখুশকো চুলে রাষ্ট্রপতি তার হাত দুটি সামনের দিকে সামান্য উঁচিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা কী চাও?’ রাষ্ট্রপতির সবচেয়ে কাছে ছিল মেজর মোজাফফর ও ক্যাপ্টেন মোসলেহ উদ্দিন। মোজাফফর দৃশ্যত ভয়ে কাঁপছিল। মোসলেহ উদ্দিন রাষ্ট্রপতিকে আশ্বস্ত করে বলছিল, ‘স্যার আপনি ঘাবড়াবেন না। এখানে ভয়ের কিছু নেই।’ ওই দুজন অফিসার তখনও বিশ্বাস করছিল, তারা রাষ্ট্রপতিকে উঠিয়ে নিতেই এসেছে, হত্যা করতে নয়। মতি কাছেই ছিল। রাষ্ট্রপতির প্রতি তার বিন্দুমাত্রও দয়ামায়া ছিল না।
রাষ্ট্রপতির প্রতি মোসলেহ উদ্দিনের আশ্বাসের বাণী মিলিয়ে যাবার আগেই ঘাতক মতি তার এসএমজি থেকে গুলি চালিয়ে দেয়। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে জিয়ার শরীর একেবারে ঝাঁজরা করে ফেলে। দরজার কাছেই মেঝেতে রাষ্ট্রপতি জিয়া লুটিয়ে পড়েন। মতি বন্দুকের নল দিয়ে জিয়ার প্রাণহীন দেহ উল্টিয়ে নেয়। এরপর জিয়ার মুখমণ্ডল আর বুকের ওপর মতি এসএমজির ট্রিগার টিপে ম্যাগাজিন খালি করে তার খুনের নেশা মিটিয়ে নেয়।
জিপে চড়ে সেনানিবাসের দিকে যাবার পথে মেজর মোজাফফর ক্ষোভ-দুঃখে কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘আমি জানতাম না, আমরা রাষ্ট্রপতিকে খুন করতে যাচ্ছি।’ জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. কর্নেল মাহতাবুল ইসলাম গুলি থেমে গেলে তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। তার ভাষ্য, ‘আমি দরজার কাছে রাষ্ট্রপতির প্রাণহীন দেহ পড়ে থাকতে দেখি। গুলির আঘাতে তার সমস্ত শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তার একটা চোখ সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে যায়। ঘাড়ের মাংসগুলো কোথাও উড়ে গেছে। তার বুক, পেট আর গায়ে অগণিত গুলির চিহ্ন ফুটে রয়েছে।’
চরম দুঃখজনক ও আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, দুই মেয়াদে খালেদা জিয়া ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলেও স্বামী হত্যার বিচার করেননি। অবশেষে স্বামী হত্যার ৩৩ বছর পর খুনি এরশাদের বিচারের কথা উচ্চারণ করেন খালেদা জিয়া।
২০১৪ সালের ৪ মে ঢাকায় প্রেস ক্লাবে দলের গণ-অনশন কর্মসূচিতে বক্তৃতাকালে বেগম জিয়া আকস্মিকভাবে জিয়া-মঞ্জুর হত্যার জন্য এরশাদকে সরাসরি দায়ী করে বলেন, ‘মঞ্জুর ও জিয়াউর রহমানের খুনি এরশাদ। খুনি এরশাদের বিচার করতে হবে। তার বিচার করা হবে।’
খালেদার অভিযোগের পাঁচ দিন পর ১০ মে এরশাদ দলীয় অনুষ্ঠানে বলেন, ‘জিয়া হত্যা নিয়ে ব্লেম গেম চলছে। উনি (খালেদা জিয়া) বলেন, আমি খুনি। আমি খুনি নই। আমি জানি, জিয়ার খুনি কে।’ এরশাদ তার বক্তব্যে জিয়া হত্যার জন্য বি. চৌধুরীকে দায়ী করেন। এরশাদের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন বি. চৌধুরী। এরশাদকে জিয়া হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত উল্লেখ করে বি. চৌধুরী বলেন, ‘এরশাদ একজন কম্পালসিভ লায়ার’ (সহজাত/স্বভাবজাত মিথ্যাবাদী)।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে সাংবাদিক লিফশুলৎজের লেখা উল্লেখ করে বি. চৌধুরী বলেন, ‘মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের বিবরণীতে স্পষ্ট বোঝা যায়, মঞ্জুরকে যারা হত্যা করেছে, সেই চক্রে প্রথম নাম জে. এরশাদ। একটি মাত্র কারণেই জে. মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছে।
‘আর সেই কারণটি হচ্ছে মঞ্জুর বেঁচে থাকলে জিয়া হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এরশাদের সংশ্লিষ্টতা নগ্নভাবে প্রকাশ হয়ে যেত।’ আর এরশাদের বক্তব্য অনুযায়ী বি. চৌধুরীই যদি খুনি হন, তাহলে নিরপরাধ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের কেন ফাঁসিতে হত্যা করা হলো?
বিএনপি আমলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএসএম মোস্তাফিজুর রহমান ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত তার ‘রণ থেকে জন’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘জে. মঞ্জুর পালাতে চাননি। তাকে পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছে। জিয়া হত্যার নেপথ্য রহস্য উদ্ঘাটনে বাধা প্রদানই ছিল এই হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য।’ জিয়া হত্যা মামলার আসামিদের সাক্ষ্য ও বর্ণনা উল্লেখ করে গ্রন্থে তিনি লিখেছেন-
‘প্রেসিডেন্টকে হত্যা সংক্রান্ত পরিকল্পনার কথা দু-একজন ছাড়া চট্টগ্রাম বিদ্রোহের লোকজনদের কারোই জানা ছিল না। সব মিলিয়ে অনুমিত হয়, মঞ্জুর শেষ পর্যন্ত ঘটনার শিকার হয়েছেন।’ সম্ভবত এরশাদ এবং মতি ও মাহবুবই শুধু জিয়াকে হত্যার বিষয়টি জানতেন।
ধরা পড়ার পর সেনানিবাসে আসার পথে জে. মঞ্জুর বুঝতে পেরেছিলেন, কী হতে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে সেনানিবাসের ফায়ারিং রেঞ্জে ঢুকে জিপ থেকে নামানো হলো জেনারেলকে। শেষ কথাগুলো ক্যাপ্টেন এমদাদ ও জওয়ানদের মঞ্জুর বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে বলবেন আমাকে মাফ করে দিতে। তার জন্য, সন্তানদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারলাম না।’
মেজর এমদাদ ও জওয়ানরা ক্ষমা চাইলেন জেনারেলের কাছে। দোয়া-দরুদ পড়লেন সবাই। হাবিলদার আবদুল মালেক অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে পয়েন্ট ব্লাংক রেঞ্জে মনজুরের মাথায় একটা মাত্র গুলি করে। ১ জুন দিনগত রাত ১২টা বাজতে তখনো কয়েক মিনিট বাকি। (জিয়া-মঞ্জুর হত্যা ও তারপর, পৃ. ২১২)।’
ফাঁসিতে নিহত ব্রিগেডিয়ার মোহসীন ও কর্নেল মাহফুজ দুজনই জিয়া হত্যার জন্য এরশাদকে দায়ী করেছেন। (পৃষ্ঠা ১৫৪) খালেদা জিয়া কী কারণে তার স্বামী জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচার করেননি, কোনো সরকার বিচারটি করলে হয়তো কারণটি বের হয়ে আসত। ইতিহাসে লেখা থাকবে, বঙ্গবন্ধু হত্যা-ষড়যন্ত্রে জিয়া যেমনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, জিয়া হত্যা ষড়যন্ত্রে এরশাদ তার চেয়ে বেশি জড়িত।
জেনারেল মঞ্জুর স্ত্রী-সন্তান ও নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের দোসর, পাকিস্তানের প্রেতাত্মা ও একজন ঘাতক সর্দারকে বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী বীর উত্তম জেনারেল মঞ্জুর হত্যার বিচার না করার দায়ভার কাউকে না কাউকে তো গ্রহণ করতেই হবে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, সিনিয়র সাংবাদিক