মাদক এমনই এক নেশা, যার কাছে সংসার-সমাজ, পরিবার-সন্তান এমনকি নিজের জীবনও তুচ্ছ হয়ে যায়। সম্প্রতি ভয়ংকর মাদক এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাই-থ্যালামাইড) গ্রহণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজের মর্মান্তিক মৃত্যু আবারও মাদকের সর্বনাশা কঠিন সত্যটাকে সামনে নিয়ে এসেছে। মাদকের উন্মত্ত নেশায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে একেকটা জীবন, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে একেকটা পরিবার।
মাদকের সহজলভ্যতা আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ই মাদকাসক্ত হওয়ার প্রধান কারণ। তবে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, হতাশা, অসম্মান, প্রত্যাখ্যানের অপমানবোধ, অশিক্ষা, তথাকথিত যোগ্য হয়ে উঠতে না পারা, সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার মতো কারণ যেমন আছে, তেমনি অতিরিক্ত বিত্ত-বৈভব, ক্ষমতা, অসৎসঙ্গ, চারিত্রিক দৃঢ়তা না থাকা, সন্তানের প্রতি অভিভাবকের উদাসীনতা, প্রয়োজনের অধিক অর্থের জোগান দেয়া, ভিনদেশি সংস্কৃতির প্রতি প্রবল ঝোঁকও মাদকাসক্ত হওয়ার জন্য দায়ী। তা ছাড়া নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি তীব্র আগ্রহ থেকেও একজন মানুষ পা বাড়ায় অন্ধকার জগতে। যে অন্ধকারের উৎস হতে সহজে আর আলো উৎসারিত হতে পারে না।পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের চিন্তা-চেতনা ভাবনার জগতে ভিন্নতা রয়েছে। তবে ভাবনায় ভিন্নতা থাকলেও সাধারণভাবে সহজ-সরল স্বাভাবিক জীবনই সবার কাম্য। কে চায় জীবনকে দুর্বোধ্য-দুঃসহ করতে। তবু কিছু মানুষ তাদের জীবনকে জটিল থেকে জটিলতর করে ফেলে। তাদের মনকে হয়তো অন্য কিছু প্রবলভাবে আলোড়িত করে।মানুষের চিন্তায় জটিলতা আছে, হৃদয়ে গভীর গোপন হাহাকার আছে, সীমাহীন শূন্যতার উপাখ্যান আছে। তবে দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-শোক, আনন্দ এসব কিছু ভোগ-উপভোগ, ধারণ বা প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা সবারই একরকম নয়। এই বিষয়গুলোর সঙ্গে বিত্ত-বৈভব বা দরিদ্রতারও খুব একটা প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই। ‘অসীম কালসাগরে ভুবন ভেসে চলেছে। অমৃতভবন কোথা আছে তাহা কে জানে।’
আসলে কেউই বলতে পারে না অমৃতসুখ কোথায় আছে। একজন ব্যক্তিমানুষের কিসে যে অভাব, তা সে নিজেই অনেক সময় জানে না, বুঝতে পারে না। অন্যেরা বুঝবে কী করে?জীবনের নাট্যমঞ্চে প্রতিটি মানুষ নিরন্তর অভিনয় করে যাচ্ছে। ভালো থাকার অভিনয়, ভালো রাখার অভিনয়। তাই হৃদয়ের গহিনের সেই ক্ষরণটা কারও চোখে পড়ে না। কেউ জানে না, মুখোশের অন্তরালের মানুষটার ভেতর কতটা ফাঁকা, কতটা শূন্য। অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রাচুর্যের ভেতরেও কিসের তাড়নায় এমন কাজ করতে পারে!প্রতিনিয়ত কত মানুষ ক্ষয়ে যাচ্ছে, নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি মানুষের জীবন এক একটি আলেখ্য, নিজের কাছে মূল্যবান। দুর্ঘটনা ঘটে গেলে, বলতে শোনা যায়, আহা, হাসিখুশি মানুষটার মনে কিসের এত দুঃখ ছিল? এই প্রশ্নটা যদি সেই মানুষটাকে কেউ জিজ্ঞেস করত! একটু মায়া-মমতা ভালোবাসা নিয়ে মাথায় হাত রাখত! আসলে কেউই জানে না কার ভেতরটা কতটা ফাঁকা।এসব কিছুতে পরিবারের দায় সর্বাগ্রে। সন্তান কী করছে, কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, তার বন্ধু কারা এবং সর্বোপরি তার আচরণগত সমস্যাগুলো পরিবারেরই চোখে পড়ার কথা সবার আগে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে মাদকের ব্যাপকতার রাশটা টেনে ধরা কিছুটা সহজ হয়। কিন্তু সামাজিক নিগ্রহের ভয়ে বেশির ভাগ মানুষই ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেয়। ফলে প্রায়শই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।সামগ্রিকভাবে নিজের দায়িত্বকে এড়িয়ে যেতে পারি কিন্তু নিজেকে আড়াল করার সুযোগ নেই। কারণ এ সমাজের মানুষ হিসেবে সামাজিক অবক্ষয়ের দায় প্রতিটি ব্যক্তিকেই নিতে হবে। সচ্ছল কিংবা অসচ্ছল পরিবারের এই সন্তানগুলোকে কারা কীভাবে মাদকের হাতছানিতে ভুলিয়ে নিয়ে গেল, তাদের রক্ষা করতে না পারার দায় আমাদের নিজেদেরও নিতে হবে।দেশে মাদকদ্রব্যের অবৈধ অর্থনীতির আকার এখন বেশ বড়৷ টাকার অঙ্কে প্রায় এক লাখ কোটি, যা আমাদের জাতীয় বাজেটের এক পঞ্চমাংশ। পাঁচ হাজারের বেশি মাদকের বড় ব্যবসায়ী আছে। সরকারের তালিকায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ১৪১ জন, যাদের প্রায় সবাই প্রভাবশালী। মাদকের ক্যারিয়ার বা খুচরা বিক্রেতা আছে কয়েক হাজার৷ কোনো কোনো মাদকসেবী আবার একই সঙ্গে খুচরা বিক্রেতাও। দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭৫ লাখ পেরিয়ে গেছে এবং সংখ্যাটা ভয়াবহভাবে বাড়ছে।দেশের শহর-বন্দর, নগর-গ্রাম সবখানেই বিস্তার ঘটেছে মাদকের ৷ ঢাকাসহ বড় শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মাদকসেবী এবং ব্যবসায়ীদের বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে৷বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রধান তিনটি কারণে বাংলাদেশে মাদক ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে৷ এক. চাহিদার সঙ্গে পর্যাপ্ত জোগান, দুই. মানসিকভাবে বিষাদগ্রস্ত ও কৌতূহল এবং তিন. হিরোইজম ৷ সব ধরনের অপরাধের উৎসমূল মাদক।মাদকের চাহিদা আছে, তাই সরবরাহও আছে৷ আর এই সরবরাহ বন্ধ করতে না পারলে এর ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না৷ সরবরাহ বন্ধের দায়িত্ব সরকারের। সরকার তার দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে কোনোভাবেই সরবরাহ বন্ধ করতে পারছে না৷ সরবরাহ বন্ধ করা না গেলে, সমাজ ও পরিবার দায়িত্ব পালন করলেও মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার স্বার্থেই এর চাহিদা তৈরির জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তাই করবে৷দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর৷ তাছাড়া পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ড মাদক নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে কাজ করে৷তাদের মতে, মাদকের চাহিদা বন্ধ করা গেলে জোগান থাকলেও কোনো লাভ হবে না। কেউ মাদক না কিনলে সাপ্লাই চেইন এমনিতে ভেঙে যাবে। মাদকের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে না পারলে এর ব্যাপকতা থেকে নিস্তার পাওয়া সহজ হবে না।আমাদের শহরগুলোতে খেলার মাঠ নেই, ফ্ল্যাট বাড়িতে একাকী মোবাইলে বুঁদ হয়ে থাকে আমাদের সন্তানেরা। আগের মতো সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিকাশের জায়গাটা বড়ই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। একাকিত্ব আর নিঃসঙ্গতার ভেতর সময় কাটাতে যেয়ে ছেলেমেয়েরা নানা ধরনের ফ্যান্টাসি আইডিয়া থেকেই মাদকের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলছে। তবে হাফিজের সঙ্গে এসব কোনোকিছুই যায় না। ও সংস্কৃতিবান একজন মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গন তার পদচারণায় মুখরিত ছিল। মূকাভিনয় করত, গান গাইত, খেলাধুলা করত, গিটার বাজাত।
গ্রামের সবুজ প্রকৃতির মাঝে যার বেড়ে ওঠা, তার কেন এলএসডির মতো মাদকের ঘ্রাণ নেবার সাধ হলো? নেহায়েত কৌতূহলের বসেই যদি দুর্ঘটনাটা ঘটে; তাহলে তার মতো আধুনিক শিক্ষিত ছেলে এলএসডি-র মতো মাদকের ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া না জেনেই কী ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলল? এই প্রশ্নের উত্তর কী হতে পারে?মনে হচ্ছে সময়টা ভয়াবহ নৃশংসতার কাল। করোনাভাইরাস প্যানডেমিকে তছনছ হয়ে গেছে পৃথিবী। মৃত্যু আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। অর্থনীতি ধসে পড়ছে। মানুষের মাঝে তীব্র হাহাকার বিরাজমান। চারদিকে অন্ধকার চেপে বসেছে। অনিশ্চিত জীবন আর অন্ধকার ভবিষ্যতে ঘরবন্দি মানুষের নিত্যদিনের আরও নানান জটিলতায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে মানসিক স্বাস্থ্যের।তাই কথা বলতে হবে একে অপরের সঙ্গে, বার বার, অনেকবার। প্রিয়জনের পাশে বা সঙ্গে থাকাই শুধু নয়, যেতে হবে অন্তরের গভীরে। কাছের মানুষটির মন খারাপ থাকলে শুনতে হবে, জানতে হবে সমস্যা কোথায়? জানার চেষ্টা করতে হবে কার মনের নদীতে কী ঢেউ বইছে।
বুকের পাঁজরে জড়িয়ে নিতে হবে শক্ত করে। সাহস, শক্তি আর অভয় দিয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। বোঝাতে হবে, সাফল্য একটি আপেক্ষিক শব্দ। চূড়ান্ত বিচারে নিজের হৃদয়ের অন্তহীন গহ্বরে পরিতৃপ্তির সঙ্গে জীবন কাটানোই সাফল্য; ধন-মান, বিত্ত-বৈভব সেখানে খুবই নগণ্য। নিজের জীবন নিজের। বেঁচে থাকার জন্য কোনোকিছুই অপরিহার্য নয়। সময়ই অতি প্রবল দুঃখ এবং সুখের ওপর প্রলেপ বুলিয়ে দেয়। প্রয়োজন শুধু সেই খারাপ সময়টুকু অতিক্রম করা।যত কষ্টই হোক, মাদক বা মৃত্যুতে কোনো সমাধান নেই। সৃষ্টির অপরূপ নিদর্শন এই জীবন অন্যের কাছে নয়, নিজের কাছেই মহামূল্যবান। তাই নিজের জীবনের আলো দিয়ে মনের অন্ধকার দূর করতে হবে। আঁধারের পাতা উল্টিয়ে নিজেকেই টেনে আনতে হবে আলো ঝলমলে পৃথিবীতে, নিতে হবে আনন্দময় জীবনের স্বাদ।লেখক: প্রাবন্ধিক, শিক্ষক