এ লেখাটির শিরোনাম বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদের একটি বইয়ের নাম থেকে নেয়া, যেখানে তিনি খেদোক্তি প্রকাশ করেছিলেন এ বলে যে, আমরা ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে’ বাস করছি। বইটি ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয়। পশ্চাৎপদতার এ ছায়া আজ ফুলে-ফেঁপে মহিরুহ হয়ে উঠছে। বইটির শিরোনামের উপযুক্ততা জ্বলজ্বল করছে।
এ প্রসঙ্গে যে প্রশ্নটি সামনে এসে যায়, তবে কি সমাজে প্রতিক্রিয়াশীলতা অনিবার্য পরিণতি হয়ে উঠছে? নানা উৎসব-আয়োজন, ব্যক্তিঘটনা ও অনুষঙ্গে এর রূপ কদর্যভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রভাব আজ সর্বক্ষেত্রে যা মুদ্রণে, ভিজুয়্যালে, পরিবার, অফিস ও জনপরিসরে চর্চিত হচ্ছে। কেবল ফিজিক্যাল স্পেসে নয়, এর রমরমা চাষ ভার্চুয়াল জগতেও। ভার্চুয়াল স্পেস হয়ে উঠছে বাঙালির প্রতিক্রিয়াশীলতা স্বরূপ সন্ধানের অনন্য আয়না।
এ লেখায় প্রতিক্রিয়াশীলতা চর্চার ক্ষেত্র হিসেবে বাসা-বাড়ি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করা হবে।
ফিজিক্যাল বা ভার্চুয়াল উভয় স্পেসে ছদ্মবেশী ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। দেখা যাচ্ছে, বহিরঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া আর ভেতরে প্রতিক্রিয়াশীলতার শক্ত বুনন। সাধারণ কথাবার্তায় সহজেই এদের ধরা যায়। একটু গভীরে গেলেই লকলকে বিষাক্ত জিহ্বা দেখা যায়।
আজকের জামানায় কে প্রতিক্রিয়াশীল আর কে প্রগতিশীল তা বোঝাটা বেশ দুরূহ হয়ে পড়েছে। ধর্মবিশ্বাস, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, গায়ের রং, আঞ্চলিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিশীলতাকে ঘিরে এর কর্ষণ চলছে। প্রকাশ ও চর্চায় তা নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে।
প্রতিক্রিয়াশীলরা আধুনিকতার মর্মবাণী গ্রহণ করে না, কিন্তু আধুনিকতার বস্তুগত সব উপাদান তারা ভোগ করে। এদের জীবন আধুনিক উপকরণের বর্ণিল সাজে সজ্জিত। কিন্তু তারা আধুনিক নন। আধুনিকতার ভাবগত দিক তাদের স্পর্শ করে না।
প্রতিক্রিয়াশীলরা মূলত আত্মপ্রবঞ্চক, স্বার্থপর ও হিংস্র। তাদের প্রতিক্রিয়ার পেছনে রয়েছে ভাবগত ও বস্তুগত স্বার্থ। যেমন, অন্যের ধর্মপরিচয় নিয়ে কটাক্ষ করে নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে চায়। এরা ভোগে শ্রেষ্ঠত্বের বিমারিতে। মনে রাখতে হবে, যে শ্রেষ্ঠ তার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রয়োজন পড়ে না।
অধিকাংশ বাসাবাড়ি আজ প্রতিক্রিয়াশীলতা চর্চার অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। প্রতিটি বাসাবাড়ি হয়ে উঠছে অন্ধবিশ্বাসের বোতল, যেখানে কোনো বৈচিত্র্য নেই। মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত বাসা-বাড়িগুলো আজ আধুনিক ইন্টোরিয়র ডিজাইনে ঠাসা। কাচ, প্লাইউড আর লাইটিংয়ের বাহারি বাগান। এসব বাড়ি দেখে চোখ ধাঁধায়, কিন্তু মন ভরে না। এগুলোতে নেই আত্মার খাবার। কাগজ আর প্লাস্টিক শোপিসে ভরা শুষ্ক উদ্যান। কদাচিৎ দুয়েকটি গাছ চোখে পড়ে, কাছে গেলে দেখা যায় সেগুলোও কৃত্রিম। প্রতিক্রিয়াশীল মনের বিছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত প্রকাশ ঘটছে বাসাবাড়িতে। এগুলোর বিষয়বস্তু বড়ই নিরর্থক। এখানে নেই আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোনো উপকরণ। সাধারণত দেখা যায় নানা প্রতিক্রিয়াশীল বই-পুস্তকের সংগ্রহ। আধুনিক ও রুচিশীল ব্যক্তির পক্ষে এসব বাসাবাড়িতে দশ-পনেরো মিনিটের বেশি সময় কাটানো বেশ কঠিন। এদের ড্রয়িংরুমের আলোচনাও অত্যন্ত নিম্নমানের যা মূলত ক্ষমতা, প্রদর্শনবাদ বা বৈষয়িক বিষয়াদিকে ঘিরে আবর্তিত হয়।
প্রতিক্রিয়াশীলদের বাসাবাড়িতে রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, ঘড়ি, মোবাইল আরও কতকিছু ঢুকেছে। আধুনিক এসব উপকরণকে তারা কাজে লাগায় প্রতিক্রিয়াশীলতাকে ঋদ্ধ করতে। আধুনিক জীবনের সঙ্গে এর মিথোজীবী সম্পর্কটি খুবই আগ্রহোদ্দীক। প্রতিক্রিয়াশীলরা আধুনিকতার শরীর নেবে কিন্তু মন নেবে না।
অপরদিকে, বাসাবাড়ি আধুনিকতা চর্চার অনুর্বর ক্ষেত্র। এ চর্চার জন্য যে সহায়ক উপকরণ লাগে, এখানে তা নেই বললেই চলে। আধুনিক বা প্রগতিশীল এমনি এমনি হওয়া যায় না। এটা চর্চা করতে হয়- কনটেস্ট করতে, বোঝা-পড়া লাগে, যুক্তিতর্ক ও সাহস লাগে। প্রক্রিক্রিয়াশীলতা সহজ আরাধ্য। কোনো রকম কসরৎ ছাড়াই তা অর্জন করা যায়। এটি এক প্রশ্নহীন জীবন।
প্রশ্নহীন জীবন মানেই অচলায়তন। ঘাম ঝরানো লাগে না, লাগানো না বিশ্লেষাত্মক বোঝাপড়া। কেবল লাগে অন্ধবিশ্বাস আর শরীরের জোর। এ অন্ধবিশ্বাস এক ধরনের স্থবিরতা, যা জন্ম থেকেই পাকা। একে আর নতুন করে পাকতে হয় না। বিকশিত হতে হয় না, সমৃদ্ধ হতে হয় না।
প্রতিক্রিয়াশীলরা সহজেই অন্যদের তকমা লাগাতে পছন্দ করে। তারা সূক্ষ্ম ও মোটা দুধরনের বিভক্তি রেখা টানতে পছন্দ করে। ঘৃণা উৎপাদন করে। নিজেদের মতো করে স্বস্তিদায়ক আবহ তৈরি করে। তারা যেকোনো আচারসর্বস্ব আনুষ্ঠানিকতায় ব্যাপক আনন্দ উপভোগ করে। তাদের কাছে ভাবগত আনন্দের কোনো মূল্য নেই। তারা স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো কিছু না বুঝে দীর্ঘসময় পড়তে, দেখতে বা শুনতে পারে। এ তাদের এ সীমাহীন সক্ষমতা।
আধুনিকতা দীর্ঘমেয়াদি ডিসকোর্স, দীঘমেয়াদি সাধনা। অনেক ঝক্কি আছে জেনেও অনেকে এর অনুবর্তী হন, জীবনজুড়ে ঝুঁকি বয়ে বেড়ান। কারণ, প্রতিক্রিয়াশীলতা কেবল অন্তরে পুষে রাখা ঘৃণা বা পশ্চাৎপদতা নয়। অনেকসময় রক্ত ঝরিয়ে এর প্রকাশ ঘটে। প্রতিক্রিয়াশীলতার চাপাতির নিচে অনেককে জীবন দিতে হয়েছে। সমাজের অন্তরাত্মাতে নানা ফর্মে প্রতিক্রিয়াশীলতার রমরমা বাজার দেখা যাচ্ছে যা সত্যিই উদ্বেগজনক।
এ ফর্মগুলোর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষত ফেসবুক হয়ে উঠেছে এক শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম। ফেসবুককে বিবেচনা করা হয় এক্সপ্রেশন ম্যানেজমেনট টুলস হিসেবে। যার যা আছে তা নিয়ে ফেসবুকে হাজির হচ্ছে। নিজের প্রতিকৃতি তুলে ধরছে। এ প্রকাশকে কয়েকটি বর্গভাগ করা যায়; ক. ব্যক্তিপ্রকাশ ও সেলফ ইমেজ; খ. সামাজিক প্রকাশ অর্থাৎ সামাজিক নেটওয়ার্ক বা পরিসরের ব্যাপ্তি গ. ক্ষমতাসম্পর্ক- নেতানেত্রী ও সেলিব্রেটিদের সঙ্গে ক্ষমতা নৈকট্যের ছবি; ঘ. নিজস্ব বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির সঞ্চালন। ফেসবুকহীন ব্যক্তির পরিচিতির ব্যাপ্তি সীমিত।
ফেসবুক ব্যক্তির ভার্চুয়াল আইডেন্টিটি নির্মাণ করছে। এ নির্মাণে ব্যক্তির মানসিক যতটুকু সামর্থ্য রয়েছে তা নিয়ে নেমে পড়ছে। ফেসবুক হয়ে উঠছে ব্যক্তির নিজের বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি বিচ্ছুরণের শক্তিশালী মাধ্যম এবং তা ব্যবহৃত হচ্ছে নির্বিচারভাবে। অন্যের বিশ্বাস, চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি, মতবাদ এবং বৈচিত্র্যের প্রতি কোনো ধরনের শ্রদ্ধা ছাড়াই সিংহভাগ ফেসবুক ইউজার অবলীলায় তাদের মতামত তুলে ধরছেন এবং তা ধরছেন বিষাক্তভাবে।
এদেশে মিডিয়া এডুকেশনের অবস্থাটি মোটেও সন্তোষজনক নয়। মিডিয়া একটি পাবলিক প্ল্যাটফর্ম সেখানে অভিব্যক্তি বা মতামত কীভাবে তুলে ধরতে হয় এর সঙ্গে শিক্ষা ও সচেতনতার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ফেসবুকের আইডির মালিকানা শেষ কথা হয়। এ মালিকানার সঙ্গে রয়েছে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। অন্যের বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি, মতামত, জেন্ডার ইত্যাদি ইস্যুতে একজন ফেসবুক ইউজারের সচেতনতা ও সংবেদনশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ফেসবুককে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে হ্যান্ডেল করতে না পারলে কত ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে তার অনেক নজির এদেশ রয়েছে- যেমন কবছর আগে ঘটে যাওয়া রামু ও পাবনার ঘটনা এর মধ্যে অন্যতম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সহনশীলতা, যুক্তি ও দায়িত্বশীলতার কোনো বিকল্প নেই।
সম্প্রতি নাট্যভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী মা দিবসে তার মাকে নিয়ে ফেসবুকে যে স্ট্যাটাস দেন তার প্রতিক্রিয়ায় যে মতামতাগুলো উঠে আসে তা দেখলে প্রতিক্রিয়াশীলতার অন্তর্জগতের কদর্য চেহারা সহজেই বোঝা যায়। ছবিতে চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে মায়ের সিঁদুরপরা ছবি দেখে ফেসবুক ইউজারগণ আহত হয়। তাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। কারণ, এদের সিংহভাগ চঞ্চল চৌধুরী ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে না জেনে নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তারা ভেবেছিল চঞ্চল চৌধুরী মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু মায়ের সঙ্গে সিঁদুরপরা ছবি দেখে তাদের সে ধারণা ভেঙে যায়। তারা কষ্ট পান। তারা ভেতরে ভেতরে সংক্ষুব্ধ হন এবং চূড়ান্তভাবে তা প্রকাশ করেন।
এ অভিব্যক্তিগুলো পর্যালোচনা করলে সমকালীন সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। সহজেই বোঝা যায় বৈচিত্র্য থেকে কতবেশি একরৈখিক প্রবণতার দিকে সমাজটি ধাবিত হচ্ছে। এ একরৈখিকতা মাত্রায় কেবল একবর্গের মানুষ থাকবে, অন্যদের অবস্থান হবে অপ্রণিধানযোগ্য। চঞ্চল চৌধুরীকে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য আহ্বান জানাতেও অনেকে ভোলেনি।
যেকোনো সমাজের মতো বাঙালি সমাজেও রক্ষণশীল, প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আবহমানকাল থেকে। সব রকম সংকীর্ণতামুক্ত খুবই উদার মানুষ যেমন আমাদের সমাজে সব সময় ছিলেন, তেমনি ধর্মীয় ব্যাপারে অতি অসহিষ্ণু ও সংকীর্ণ মানুষও ছিলেন অগণিত। বাঙালি চিরকাল মধ্যপন্থায় বিশ্বাস করে এসেছে। মধ্যপথ পরমতসহিষ্ণু। উগ্র প্রতিক্রিয়াশীলতা বা ধর্মান্ধতা এবং উগ্র প্রগতিশীলতা বাঙালি সমাজ সব সময় প্রত্যাখ্যান করে আসছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কেন্দ্র করে যে ভার্চুয়াল জনমানস তৈরি হচ্ছে তার প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতা হয়ত একটা সময়ের আঘাত। আশা করা যায়, এ জনমানসটি একদিন বিশ্লেষণাত্মক জনমানসে রূপান্তরিত হবে। প্রতিক্রিয়াশীলতার ছায়া মাড়িয়ে প্রগতিশীলতার মসৃণপথ নির্মিত হবে। কারণ, এছাড়া অন্যকোনো বিকল্প নেই। সে আশাটুকু ধরে রাখতে চাই। কারণ, জার্মান কবি গ্যাটে বলেছেন, আশাবাদী মনোভাব হতাশার চেয়ে কল্যাণকর।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিশ্লেষক