রাজধানীর পল্লবীর ১২ নম্বরে সাহিনুদ্দিন নামে এক যুবককে দিনে দুপুরে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব ও লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়াল গ্রেপ্তার হয়েছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর মতে, জমি দখল করতে না পেরে ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটান এই সাবেক এমপি।
উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪-দলীয় জোটের শরিক হিসেবে তরিকত ফেডারেশন থেকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এম এ আউয়াল। আওয়ামী লীগ এই আসনটি ‘উৎসর্গ’ করেছিল আউয়ালকে।
নানা সমালোচনার কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরিকত ফেডারেশন থেকে মহাজোটের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় দল বদল করে জাকের পার্টির প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে ঋণখেলাপি হওয়ায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। নানা অপকর্মের মাধ্যমে টাকা বানানোর কাজে তিনি আসলে এমপি পদটি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তাই তো তিনি ‘স্বাধীনভাবে’ দলবদল করেছেন। কিন্তু এমপি হতে না পারলেও অবৈধভাবে টাকা বানানোর ফিকির থেকে তিনি সরে আসেননি। আউয়ালের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ।
মিরপুর ১২ নম্বর জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের আবাসন ফ্ল্যাট প্রকল্প স্বপ্ন নগরীর পাশে বাউনিয়া মৌজার জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সরকারি জায়গা দখল করে একটি হাউজিং কোম্পানি গড়ে তোলেন সাবেক এই এমপি। কোম্পানির নামকরণ করেন হ্যাভেলী প্রোপারটিজ ডেভেলপার লিমিটেড। সেই জায়গা প্লট আকারেও তিনি দেদারসে বিক্রি করেন। এক জায়গা কয়েকবারও বিক্রি করেছেন। ওই জায়গা দখল ও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তিনি নাকি একটি সন্ত্রাসী বাহিনীও গঠন করেন। মূলত রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করেই তিনি এই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
এ তো গেল একজন সাবেক এমপির কাহিনি। বর্তমান এমপিরাও অপকর্মে পিছিয়ে নেই। বর্তমান সংসদের একজন এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল সম্প্রতি মানব পাচারের দায়ে কুয়েতের একটি আদালতে দণ্ডিত হয়ে জেলে আছেন। তিনিও অনেক কারসাজি করে মনোনয়ন বাগিয়েছিলেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে দলের তখনকার এমপি মোহাম্মদ নোমানকে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে ‘লাঙল’ প্রতীক বরাদ্দ দেয় জাপা। কার্যত নোমান ছিলেন মহাজোটের প্রার্থী। কিন্তু হঠাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বিজ্ঞপ্তি’ দিয়ে ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি।
তখনই এলাকায় চাউর হয়ে যায় যে, টাকা খেয়ে নোমান পাপুলকে আসনটি ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শুধু তাই নয়, তিনি এমপি হওয়ার কিছুদিনের মাথায় তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামও সংরক্ষিত আসনে এমপি নির্বাচিত হন। এখানেও টাকার খেলা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। আউয়াল এবং পাপুলের ঘটনা দেখিয়ে দেয় আমাদের দেশে এখন কারা রাজনীতি করছেন, কীভাবে মনোনয়ন পাচ্ছেন এবং এমপি হচ্ছেন!
সংবিধান অনুযায়ী এমপিদের ক্ষমতা হচ্ছে আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখা। একটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জাতীয় সংসদের অবস্থান সবচেয়ে উপরে। একজন সংসদ সদস্যের গুরুত্ব ও মর্যাদাও তাই অনেক বেশি। কারণ সাধারণ মানুষ এমপি হিসেবে তাদেরই দেখতে চান, যারা দেশের স্বার্থে আইন প্রণয়ন করবেন; সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য ভূমিকা রাখবেন, কথা বলবেন, বিতর্ক করবেন। কিন্তু আমাদের দেশে এখন এমপি হিসেবে যারা নির্বাচিত হচ্ছেন, অনেক ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে দুর্বৃত্তের কোনো পার্থক্য করা যাচ্ছে না। আউয়াল এবং পাপুল যেন আমাদের দেশের এমপিদের অবক্ষয় ও দৃর্বৃত্তায়নের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত।
আমাদের দেশে এমনিতেই এমপিরা এখন অপ্রতিহত ক্ষমতা ভোগ করেন। তাদের যেটা মুখ্য কাজ অর্থাৎ আইন প্রণয়নে ভূমিকা পালন-এটা ছাড়া তারা অন্য সব ব্যাপারে সীমাহীন মাথা ঘামিয়ে থাকেন। এমপির ভূমিকা এখন অনেকাংশেই প্রশাসনিক এবং নির্বাহী ক্ষমতায় রূপান্তরিত হয়েছে। একজন সংসদ সদস্য তার নির্বাচনি এলাকায় সবচেয়ে ক্ষমতাশালী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
স্থানীয় পর্যায়ে কাজের বিনিময়ে খাদ্য, বয়স্ক ভাতা, নানা ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা-বেষ্টনীসহ প্রায় ৪০ ধরনের প্রকল্প আছে। এসব প্রকল্প থেকে কারা সুবিধা পাবেন সেটি স্থানীয় সংসদ সদস্যের সম্মতির ভিত্তিতে হয়ে থাকে। এছাড়া এলাকার শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসহ নানা ধরনের প্রতিষ্ঠানে সংসদ সদস্যদের সম্পৃক্ততা থাকে। স্থানীয় পর্যায়ে যেকোনো নিয়োগেও এমপিরা এখন একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।
এছাড়া নির্মাণকাজ, নিজের প্রভাবপ্রতিপত্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য অনুগত বাহিনী তৈরি, নিজের ইচ্ছেমতো বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে পছন্দের লোকদের পদায়ন, নামে-বেনামে বিভিন্ন লাভজনক প্রকল্প গ্রহণ, জমি দখল ইত্যাদি নানা ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশের ওপর সংসদ সদস্যদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকে বলে তারা সব ধরনের অপকর্ম করে পার পেয়ে যায়।
বর্তমানে যারা এমপি আছেন, তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে নানা অভিযোগ। অবৈধভাবে টাকা বানানো, জমি, জলাশয়, নদী দখল, ক্ষমতার দাপট দেখানো, হুমকি, ভয় দেখানো, বিরোধিতাকারীকে ভাড়াটে খুনি দিয়ে খুন করানোসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগের কথা শোনা যায়। কিন্তু এসব অভিযোগ কখনও আমলে নেয়া হয় না। পত্রপত্রিকায় এমপিদের অপকীর্তির কাহিনি প্রকাশিত হলে বলা হয়, ‘এটা ষড়যন্ত্রমূলক, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তার ভাবমূর্তি নষ্টের জন্য এ ধরনের ঘৃণ্য অপপ্রচারের খেলায় মেতেছে!’ ব্যস, এ পর্যন্তই।
এমপিদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তেমন কোনো অনুসন্ধান বা তদন্ত হয় না। ফলে তারা অপ্রতিহত গতিতে দুর্বৃত্তায়নের ধারাকেই শাক্তিশালী করে চলেছে। আর আমরা একটু একটু করে উচ্ছন্নের উপত্যকা বরাবর এগিয়ে চলেছি।
বর্তমানে রাজনীতিতে যে দুর্বৃত্তায়নের ধারা চলছে তা থেকে রাজনীতিকে বের করে আনতে না পারলে একদিন বঞ্চিত, অতিষ্ঠ ও ক্ষুব্ধ মানুষ রুখে দাঁড়াতে পারে। সেটা কারো জন্যই শুভ হবে না। আর রাজনৈতিক শুদ্ধতার জন্য এ কাজটা করতে হবে রাজনীতিবিদদেরই।
মনে রাখতে হবে যে, রাজনীতিবিদদের বাদ দিয়ে দেশ নয়। রাজনীতিবিদরাই দেশ পরিচালনা করে। আর আমরা যে একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি, সেটা সম্ভব হয়েছে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের কারণে। বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে সততা ও আদর্শভিত্তিক রাজনীতির হাত ধরে। কিন্তু গত তিন দশকে বাংলাদেশের রাজনীতি তার স্বাভাবিক অবস্থা থেকে সরে এসে বাণিজ্যনির্ভর হয়ে পড়েছে।
সকল পর্যায়ে সুবিধাবাদী সুযোগসন্ধানী নেতাদের দাপট ও খবরদারিতে সামাজিক-রাষ্ট্রীয় শ্লীল-সুন্দর ব্যবস্থায় অশ্লীলতা ভর করে দেশসুদ্ধ জনগণের কাছে ঘৃণা ও বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর থেকে উদ্ধার পাওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। ব্যক্তি, দল নির্বিশেষে শুভচিন্তার উন্মেষের মধ্য দিয়ে যদি আমরা যদি এগোতে না পারি, রাজনীতিতে ইতিবাচক ও সুস্থধারা ফিরিয়ে আনতে না পারি তাহলে রাজনীতির মানুষদের মুখ হয়ে উঠবে পাপুল কিংবা আউয়ালের মুখ। যেটা মোটেও কাম্য নয়।
রাজনীতি আমাদের সবটা নিয়ন্ত্রণ করে। আর চোখে কাপড় বেঁধে আমরা খানিকটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করি রাজনীতিকে। এই পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল একটা ম্যাজিকের মতো। যার কুয়াশা-টানেল আমাদের চোখের ব্যাপ্তিকে কমিয়ে দিয়েছে। দিনে দিনে আরও কমিয়ে দিচ্ছে।
আমরা সাধারণ মানুষ সামগ্রিক সচেতনতার দিকে এগিয়ে না গিয়ে স্রোতে ভাসিয়ে দিচ্ছি নিজেদের। আর চারপাশের ব্যবস্থা বা ‘সিস্টেম’ ক্রমে পরিবর্তন হতে হতে এমন এক পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়াচ্ছে, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের শিকার হলেও আমাদের বিরোধিতার সুর ক্রমে কমে আসছে। যদিও এটাই স্বাভাবিক!
যাচাই করে বাজার করলেও সামাজিক জীবনে, পারিপার্শ্বিকতায় যাচাই করতে ভুলে গিয়েছি আমরা। দুচারটে ব্যতিক্রম সব সময় থাকে। তাদের চেঁচিয়ে ওঠাকে আমরাই ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে দেখতে পছন্দ করি। কিন্তু স্বপ্নেও তাদের পরিস্থিতির মুখোমুখি ভাবতে চাই না নিজেদের।
আর এই উদাসীনতার ফলে, হয়ত এই প্রবণতার ফলে খানিকটা হলেও রাজনীতির পরিসরে অসুস্থ রাজনীতি সহজ হয়ে যাচ্ছে। রণনীতি বদলে যাচ্ছে। উন্নয়নের আগে উঠে আসছে উন্মাদনা। জনকল্যাণের জায়গায় স্থান নিচ্ছে আত্মকল্যাণ। সেটা খুন করে হলেও। চোরাচালান কিংবা মানব পাচার করে হলেও!
যেভাবেই হোক আমাদের দেশের রাজনীতির অভিমুখ বদলাতে হবে। রাজনীতির প্রতিপাদ্য বিষয় হোক সমাজের উন্নয়ন, শিল্পায়ন, সাংস্কৃতিক বিকাশ। সমাজ ও দেশের মানুষ এবং রাষ্ট্রের ভালো করা, যাকে বলা হয় জনকল্যাণ। সেটাই হোক সকলের লক্ষ্য। গ্রামে বা শহরে রাস্তা, বিদ্যুৎ, জল সরবরাহ প্রয়োজন। চাই প্রাথমিক স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা। চাই দারিদ্র্য দূরীকরণও।
রাজনীতি থেকে যেন আর কোনো পাপুল কিংবা আউয়ালের মতো এমপি বের হয়ে না আসে, সেটাই হোক বর্তমান রাজনীতিবিদদের প্রধান অঙ্গীকার।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক।