সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ছয় ঘণ্টা সচিবালয়ের একটি কক্ষে আটকে রাখা, থানায় পাঠানো, মামলা, থানায় রাত কাটানো, জামিন নিয়ে টালবাহানায় পাঁচদিন কাশিমপুর কারাগারে কাটানোর পর মুক্তি- পুরো ঘটনায় দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে অনেক আলোচনা, বিতর্ক, টক শো, লেখালেখি, আন্দোলন হয়েছে।
রোজিনার মুক্তির পর পুরো বিষয়টি থিতিয়ে এসেছে, সাংবাদিকদের আবেগও অনেকটাই প্রশমিত। এখন সময় এসেছে পুরো বিষয়টি নির্মোহ দৃষ্টিতে মূল্যায়নের, লাভক্ষতির হিসাব মেলানোর।
রোজিনা মুক্তি পেলেও সাংবাদিকরা তার মামলাটি প্রত্যাহারের দাবি করেছেন। তবে আমি এই দাবির সঙ্গে একমত নই। কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না, তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে না, এমনটা আমি মনে করি না। তবে আমি মনে করি, কয়েকজন আমলার গোঁয়ার্তুমি আর ব্যক্তি আক্রোশের কারণে রোজিনার তিল ইস্যুকে তাল বানানো হয়েছে।
সচিবালয়ে ছয় মিনিটে যেটি মিটে যেতে পারত, তা সারাবিশ্ব কাঁপিয়েছে। মূল যে ভোগান্তি, রোজিনা তা সহ্য করেছেন। আমি চাই মামলাটি চলুক। নিরপেক্ষ তদন্ত হোক, রোজিনা ন্যায়বিচার পাক। তাহলে শতবর্ষী অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ব্যাপারে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সীমা সম্পর্কে আদালতের একটা সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আসবে।
যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনায় ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ কমে যাবে। তবে যারা বেআইনিভাবে রোজিনাকে সচিবালয়ে ছয় ঘণ্টা আটকে রাখল, তল্লাশি করল, মোবাইল কেড়ে নিল; রোজিনার পরিবারের অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত। আর যে কর্মকর্তা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নথি তার টেবিলে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখল, সরকারের উচিত খামখেয়ালির দায়ে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া।
এবার আসি লাভক্ষতির কথায়। এই ঘটনায় সরকারের কোনোই লাভ হয়নি, পুরোটাই ক্ষতি। সামান্য একটা ঘটনায় বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। রোজিনার মুক্তিতেও যার রেশ শেষ হবে না। এই একটি ঘটনাই ভবিষ্যতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা-সংক্রান্ত যেকোনো সূচকে বাংলাদেশের অবনমন ঘটাবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী অসহায়ের মতো স্বীকার করেছেন, গুটিকতক লোকের কারণে আন্তর্জাতিক মহলে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা খুব পরিকল্পনা করে ঘটনাটি ঘটিয়েছেন, এমন মনে হয় না। কিন্তু আমলাদের গোঁয়ার্তুমির কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঘটনাটি নিয়ন্ত্রণ করতে দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। সরকারের লাভের খাতা পুরোটাই শূন্য।
এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে ব্যক্তি রোজিনার। ছয় দিনে কষ্ট যা হবার তা হয়ে গেছে। কিন্তু এই ঘটনা জাতীয় পর্যায় তো বটেই রোজিনা ইসলামকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেবে। আর গত কয়েকবছর ধরে দারুণ সব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন রোজিনার পক্ষে কথা বলবে। লাভ হয়েছে প্রথম আলোরও।
নানা কারণে পত্রিকাটি চাপের মুখে ছিল। রোজিনা ইস্যুতে পত্রিকাটি নতুন করে ইতিবাচকভাবে আলোচনায় এসেছে। ‘অভিজাত’ প্রথম আলো সাধারণ সাংবাদিকদের দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে কখনও পাশে না থাকলেও তাদের বিপদে সাধারণ সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ করেছে। আশা করি প্রথম আলোও বিষয়টি উপলব্ধি করবে। সাংবাদিকদের সব ন্যায্য আন্দোলন-সংগ্রামে আশা করি প্রথম আলোকে আমরা পাশে পাব।
এই যে বললাম ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ, এটাই হলো এই ঘটনায় সাংবাদিকদের প্রাপ্তি। অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের সাংবাদিকদের দ্বিধাবিভক্ত। কোনো ইস্যুতেই তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। ফলে সরকার নানাভাবে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করতে পারে। নানা আইন চাপিয়ে দিতে পারে।
বাংলাদেশের অন্য সব খাতের মতো সাংবদিকরাও দুই ভাগে বিভক্ত। মোটা দাগে বিভক্তিটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের তথা আওয়ামীপন্থি, স্বাধীনতার বিপক্ষের তথা বিএনপি-জামায়াতপন্থি। অন্য সব খাতের মতো গত এক দশকে সাংবাদিকদের মধ্যেও আওয়ামীপন্থি তথা সরকারপন্থিদের আধিপত্য। তাই সরকারের নানা অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের যতটা সোচ্চার হওয়ার কথা, ততটা হতে পারেন না।
সাংবাদিকরা সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা পায় বলে শুনি, তবে জানি না। সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টে প্রধানমন্ত্রী মাঝে মাঝে অনুদান দেন বটে, তবে সেটা দুস্থ, বেকার বা অসুস্থ সাংবাদিকদের জন্য।
রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তারের ঘটনা অনেকদিন পর সাংবাদিকদের নানা সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছে। এমনকি সরকারপন্থি সাংবাদিকরাও নানান হিসাব-নিকাশ ভুলে সরকারের একটি মহলের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পেরেছিলেন। এই ঐক্যটা ধরে রাখতে পারলে ভবিষ্যতে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে আরও জোরালো ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।
এই ঘটনায় সাংবাদিকদের প্রাপ্তি যেমন আছে, ঝুঁকিও আছে। রোজিনার ঘটনা বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আরও কঠিন করে দেবে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়। তবে এখন থেকে সাংবাদিকদের গতিবিধি কঠোর নজরদারির মধ্যে থাকবে। আমার আশঙ্কা সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারও আরও সংকুচিত হয়ে যাবে। সাংবাদিকদের দিকে বিভিন্ন অফিসের কর্তাব্যক্তিরা বাঁকা চোখে তাকাবে, এই বুঝি ফাইল চুরি করে নিয়ে গেল!
আগেই বলে রাখি, ফাইল চুরিটা অত বড় অপরাধ না হলেও কোনোভাবেই বৈধও নয়। আমার অফিসে কেউ ঢুকে অনুমতি ছাড়া কাগজপত্র ঘাটলে বা নেয়ার চেষ্টা করলে আমিও বিরক্ত হবো। তাই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার দোহাই দিয়ে ঢালাও ফাইল চুরির বৈধতা দেয়ারও কোনো সুযোগ নেই। তবে আগেই যেমন বলেছি, একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক তথ্য সংগ্রহের জন্য নানান চেষ্টা করবে।
আমলারা চাইবেন তথ্য গোপন করতে, সাংবাদিকরা চাইবেন তা ফাঁস করতে। গোপন ক্যামেরার ব্যবহার, সোর্স মানি দিয়ে তথ্য সংগ্রহ, সৎ আমলার কাছ থেকে তথ্য পাওয়া তো আছেই; প্রয়োজনে জনস্বার্থে তথ্য চুরি করাও যেতে পারে। কিন্তু রোজিনার ঘটনার পর থেকে এই কাজগুলো আরও্র কঠিন হয়ে যাবে। আমলারা নিশ্চয়ই তাদের স্পর্শকাতর ফাইলগুলো টেবিলের ওপর ফেলে না রেখে গোপন ও নিরাপদ স্থানে রাখবেন। সিসিটিভির মনিটরিংও নিশ্চয়ই আরও কঠোর হবে।
সাংবাদিকতাটা কখনই ফুলশয্যা নয়। সৎ ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের পথে পথে কাঁটা বিছানো থাকে, নানা ঝুঁকি থাকে। এই ঝুঁকি নিয়েই সাংবাদিকদের কাজ করতে হয়। ঝুঁকি যত বাড়বে, চ্যালেঞ্জও তত বাড়বে। আর চ্যালেঞ্জে জেতার আনন্দটাও বেশি। তবে ঝুঁকির চেয়ে আমি প্রাপ্তিটাকেই বড় বলে মানি। ন্যায্যতার জন্য সাংবাদিকদের ঐক্যকে শক্তি করেই চ্যালেঞ্জ জেতার পথে এগোতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক-কলাম লেখক।