অভ্যন্তরীণ ও বহুজাতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ অবস্থা নিরসনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের যাত্রা শুরু। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বর্তমানে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সেনা প্রেরণকারী দেশ। পেশাগত দক্ষতা-নিরপেক্ষতা, নেতৃত্ব-মেধা, সততা ও মানবিক আচরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের নারী ও পুরুষ সদস্যরা শান্তিরক্ষী মিশনে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে বিশ্বের অন্যতম রোল মডেলে পরিণত হয়েছে, উজ্জ্বল করেছে দেশের ভাবমূর্তি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও বাংলাদেশের অভাবনীয় সাফল্য সম্পর্কেও প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। জাতিসংঘসহ বিশ্বমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সংগঠন-সংস্থা ও স্বনামধন্য নেতৃত্ব-ব্যক্তিত্ব শেখ হাসিনার মানবিকতা ও মানবিক বাংলাদেশের প্রশংসা করছে।
আজকের গর্বিত বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনা ও দেশের জনগণের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে একদল সামরিক-বেসামরিক ঘাতকচক্র শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সবান্ধব-সপরিপারে নির্মমভাবে হত্যা করেনি, এ হত্যার মাধ্যমে সারা দেশে তারা কায়েম করেছিল ত্রাসের রাজত্ব। বাংলাদেশকে নতুন পাকিস্তান বানাতে খুন-ধর্ষণ, লুটতরাজ-অগ্নিসংযোগ, জেল-জুলুম কিছুই বাদ দেয়নি তারা।
সে সময়ে তাদের প্রধান টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। মুজিবপ্রেমী জনগণ। বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়স্বজনও ছিল তাদের টার্গেট। তারা নিষিদ্ধ করেছিল জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ পর্যন্ত।
দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এমনি বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে দেশে পা রেখেছিলেন।
প্রিয় মুজিব ভাইকে হারিয়ে যে কান্না কাঁদতে পারেননি এতদিন বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীগণ, সোনার বাংলার স্বপ্ন-সারথিরা, সেদিন তারা সেই কান্না কেঁদেছিলেন মুজিবকন্যাকে পেয়ে। ডা. দীপু মনির ভাষায়-
‘...নেত্রী প্রতিকূল আবহাওয়ায় প্রকৃতির কান্নাকে ছাপিয়ে তাঁর কান্না ভেজা বক্তব্য রাখলেন। সারা বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবী যেন কাঁদছিল। অঝোর ধারায়।’…
প্রায় সাড়ে ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিক রাজনীতিতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
সেই কঠিন ও বন্ধুর পথে ঘরে ঘরে শান্তি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে শেখ হাসিনা ফেরি করে বেড়িয়েছেন বাংলার পথে-প্রান্তরে, ফসলের মাঠে, কৃষক-শ্রমিক এবং মা-বোনের কাছে। তিনি অতিক্রম করেছেন অজস্র দুর্লঙ্ঘ্য বাধা, বার বার তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র। তিনি জেল খেটেছেন, বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন- স্বপ্ন দেখিয়েছেন, বাংলার দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি মানবিক ও জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। দেশের ইতিহাসে প্রথম ‘বয়স্ক ভাতা’, ‘বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত মহিলা ভাতা’, ‘অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ভাতা’, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’, ‘গৃহায়ন’, ‘আদর্শ গ্রাম’, ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ কর্মসূচিসহ অনেক মানবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি করে সেখানকার সংঘাত থামিয়েছেন। এ চুক্তির ফলে ১৯৯৮ সালে তিনি অর্জন করেছেন ইউনেস্কোর ‘হুপে-বোয়ানি শান্তি’ পুরস্কার। ২০০১ সালে আবার বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে তিনি রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি মানবিক ও জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন এবং মানবিক উন্নয়নমূলক নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের মানবিক ও সামাজিক উন্নয়নে এসেছে যুগান্তকারী সাফল্য। তার নেতৃত্বের ১২ বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে, জনগণের জীবন মান, মাথাপিছু আয় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে এবং দেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের কাতারে উন্নীত হয়েছে।
২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হয়েছে ২২২৭ মার্কিন ডলারে। যা ভারতের চেয়ে বেশি এবং পাকিস্তানের প্রায় দ্বিগুণ।
অমর্ত্য সেনের মতে-
‘বিপুল জনপ্রিয় নেত্রী হলেও শেখ হাসিনা আসলে সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র মানুষের কণ্ঠস্বর।’
নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন-
‘মানুষের প্রতি শেখ হাসিনার ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে।’ তার উদ্যোগে দেশের গৃহহীন পরিবারকে সরকারি খরচে ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে সরকার। বর্তমান করোনা দুর্যোগে ঘনবসতির বাংলাদেশকে রক্ষা করতে তার কর্মপ্রচেষ্টাও বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। গত বছর করোনার সময় বিভিন্ন প্রণোদনাসহ সুবিধাবঞ্চিত ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ অর্থ দিয়েছে তার সরকার। বর্তমান করোনাকালেও বিভিন্ন প্রণোদনা ও নগদ অর্থ পাচ্ছে দেশের গরিব-দুখী মানুষ।
শেখ হাসিনার উদ্যোগে ২০১৫ সালে ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময়ে নতুন ঠিকানা পেয়েছে ৬৭ বছর মানবেতর জীবন-যাপনকারী লাখ লাখ অধিবাসী। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার নেতৃত্ব-দর্শন মানবিক বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে নতুন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনসহ আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়ে তার উদ্ভাবনী প্রস্তাব বিশ্বরাষ্ট্রে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে। তার প্রদত্ত ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’ এবং ‘শান্তির সংস্কৃতি’ বিষয়ক প্রস্তাব জাতিসংঘের অধিবেশনে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থনে গৃহীত হয়েছে ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর।
শেখ হাসিনা অর্জন করেছেন বিশ্বের অন্যতম সৎ, দক্ষ ও সেরা প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতিসহ ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’, ‘মানবতার চ্যাম্পিয়ন’, ‘বিশ্বমানবতার নেতৃত্ব’, ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক নেতা’, ‘বিশ্ব মানবতার বিবেক’, ‘বিরল মানবতাবাদী নেতা’ এবং অন্যান্য মানবিক বিশেষণ। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্জন করেছে মানবিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। সমসাময়িক বিশ্বের কোনো নেতাই শেখ হাসিনার মতো এত মানবিক টাইটেল পাননি।
মনুষ্যত্বপূর্ণ কর্ম ও লোকহিতকর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জনগণের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করে মানবিক মূল্যবোধের চর্চা ও বিকাশে নিয়োজিত রাষ্ট্রকে মানবিক রাষ্ট্র বলা যায়। সরকার শুধু রাষ্ট্রের মুখপাত্রই নয়, রাষ্ট্রের রূপকারও।
সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের নীতি-আদর্শ ও বৈশিষ্ট্যের কারণে রাষ্ট্রের ধরন বা শ্রেণি-বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত হয়। প্রায় দুই যুগ ধরে এ দেশের রাজনীতির প্রভাবশালী নিয়ামক শেখ হাসিনার শাসনামলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয়, তার শাসনামলে রাষ্ট্র ও সরকারের কার্যাবলি এবং পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। জনগণের সুবিধার্থে এবং সমাজ জীবনের পূর্ণতার জন্যে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ব্যক্তিজীবনের বহুমুখী উন্নয়ন সাধনের জন্যে তার সরকার সমাজতান্ত্রিক ও অসমাজতান্ত্রিক বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
শেখ হাসিনার চিন্তা-কর্ম, নীতি-তত্ত্ব, দর্শন এবং ‘সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে উন্নয়ন তত্ত্ব’, ‘মানবিক রাষ্ট্র’-এর ধারণা সম্পর্কে বিশ্বকে নতুন দিগন্ত দিয়েছে। বাংলার মানুষও মনে করে, দেশমান্য শেখ হাসিনা দেশের গর্ব, দেশিকোত্তম ব্যক্তি, সর্বোত্তম পথনির্দেশক, দেশহিতব্রতী মানবিক শাসক। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, শেখ হাসিনা শুধু মানবিক বিশ্বের বাতিঘর নন, ‘মানবিক রাষ্ট্র’ নামক নতুন শ্রেণির রাষ্ট্রগঠনের মডেল। যার প্রেরণামূলে কাজ করেছে শেখ হাসিনার চার দশকের লড়াই-সংগ্রাম ও অভিজ্ঞতার দীর্ঘ পথ। রাষ্ট্রের শ্রেণিবিভাগে আগামী বিশ্বে ‘মানবিক রাষ্ট্র’ ধারণার পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে এবং বাংলাদেশ হবে মানবিক রাষ্ট্রের মডেল। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবসে এ প্রত্যাশা করি।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক।