করোনাকালের মহাবিপর্যয়ের মধ্যেও ডিজিটাল বাংলাদেশ আশার আলো। সাদামাটা নয়, উজ্জ্বল আলোই বলা চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষকতার সুবাদে একটি ব্যাচের ছাত্রছাত্রীদের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলাম, যার শিরোনাম- ‘করোনাকালে অনলাইন ব্যবসা : সমস্যা ও সম্ভাবনা’। তাদের ক্লাস নিয়েছি অনলাইনে।
বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় তারা ছড়িয়ে আছে। কখনও কখনও ইন্টারনেট কানেকশন থাকে না, কখনওবা বিদ্যুৎ চলে যায়। তবে সার্বিকভাবে অভিজ্ঞতা খুব ভালো। ছাত্রছাত্রীরা একে অপরকে সহযোগিতা করে। কেউ ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলে অন্যদের কাছ থেকে সহজেই ক্লাস নোট পেয়ে যায়। একবার ক্লাসে বলেছিলাম- ‘অনলাইন ক্লাসে অনুপস্থিতদের কিন্তু পরীক্ষায় সমস্যা হতে পারে।’ আমার কথা শেষ হতে না হতেই এক ছাত্রী (যে বরাবরই পরীক্ষায় ভালো ফল করছে) মন্তব্য করল- ‘যারা অনুপস্থিত থাকছে, তাদের নিশ্চয়ই অসুবিধে আছে। আমাদের উচিত হবে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা। কেউ যেন ইন্টারনেট-সুবিধা না থাকার কারণে বঞ্চিত না হয়।’
ছাত্রছাত্রীদের পরস্পরের প্রতি এমন মনোভাবই কাম্য। অনলাইন ব্যবসা-সংক্রান্ত বিষয়ের অ্যাসাইনমেন্টে সবাই ভালো লিখেছে। এ প্রশ্নটি নতুন, তাই পাঠ্যবইয়ে তেমন পাওয়া যাবে না। উত্তর প্রদানের মালমসলা আছে সংবাদপত্রে। ইন্টারনেট ব্যবহার করেও পাওয়া যায়। অর্থাৎ উত্তর খুঁজে নিতে হবে প্রত্যেককে। করোনাকালে সব ঘরে সংবাদপত্র সর্বত্র মেলে না। বিশেষ করে গ্রামে। তাই প্রধান ভরসা ইন্টারনেট।
দেখা গেল যে ছাত্রছাত্রীরা ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোন ব্যবহারে অভ্যস্ত। দক্ষতাও যথেষ্ট। কারো ই-মেইল, হোয়াটস্যাপ বা মেসেঞ্জারে একটি নোট দিলে মুহূর্তে পৌঁছে দিচ্ছে গ্রুপে, সবাই তা পেয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের এমন মনোভাব উৎসাহব্যঞ্জক। আমার জন্যও শিক্ষণীয়।
ঢাকার বাইরেও ইন্টারনেট-সুবিধার প্রসার ঘটেছে এবং এ জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কৃতিত্ব পাবেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর কল্পনা নয়, খুবই বাস্তব। গত বছর ডিসেম্বরের শেষদিকে বরিশালের (আগৈলঝাড়া উপজেলা, গৈলা গ্রাম) বাড়িতে গিয়েছিলাম। এ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ক্লাস নিয়েছি বাড়িতে বসেই। বাড়িতে পল্লী বিদ্যুতের সরবরাহ নিয়মিত।
ওয়াইফাই সেবা দিন-রাত সর্বক্ষণ পেয়েছি। ঘরে, উঠানে কিংবা পুকুরপাড়ে বসেছি ক্লাস নেয়ার সময়। ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকের বাড়ির নানা দৃশ্য উপভোগ করেছে। গ্রামে বসে টেলিভিশনে টক শোসহ বিভিন্ন প্রোগ্রাম করা গেছে তেমন ঝামেলা ছাড়াই। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশের সর্বত্র ইন্টারনেট-সুবিধা সমানভাবে নেই। অনেক পরিবারেই কম্পিউটার-ল্যাপটপ-স্মার্ট ফোন পৌঁছেনি। ইন্টারনেট-সুবিধা কিনতে হয়। ওয়াইফাই বা মোবাইল ডাটা, যে সংযোগই থাকুক না কেন, অর্থব্যয় করতে হয়। সব পরিবারের এ সংগতি নেই।
গ্রামে থাকার সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে বার্ষিক পরীক্ষা নিতে দেখেছি মোবাইল ফোনে। শিক্ষক ফোনে প্রশ্ন করছেন, ছাত্রছাত্রীরা উত্তর দিচ্ছে। বেশিরভাগ পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে রাতে। কেন দিনে নয়? উত্তরে শিক্ষক জানালেন- বেশিরভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্থীর ফোন থাকে পরিবারের পুরুষ সদস্যের কাছে। তাকে দিনে বাড়িতে পাওয়া যায় না।
ওই শিক্ষক জানালেন, যেসব পরিবারে মা-বাবা লেখাপড়া জানে, তারা করোনাকালে সন্তানদের পড়াশোনার প্রতি কিছুটা হলেও নজর রাখতে পেরেছেন। মোবাইল ফোনে তাদের যেসব পরামর্শ দেয়া হয়েছে, তা অনুসরণ করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। ‘দিনমজুর-বস্তিবাসী-কাজের বুয়া’- অতি দরিদ্র এ সব পরিবারেও শিক্ষার আলো প্রবেশ করতে শুরু করেছে। অনেকে পরীক্ষায় ভালো ফল করছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে ‘অদম্য মেধাবী’ শিরোনামের ছড়াছড়ি। এ সব পরিবারের সন্তানরাও মেডিক্যাল-ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষার প্রবল প্রতিযোগিতায় টিকে যাচ্ছে। কিন্তু সব অসচ্ছল পরিবারের জন্য ইন্টারনেট সুবিধাসম্পন্ন মোবাইল সেট বা ল্যাপটপ ব্যবস্থা করা সহজ নয়।
আবার অনেক পরিবারে দেখা গেছে- ইন্টারনেট-সুবিধা আছে কিন্তু ক্লাসের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। কারিগরি ত্রুটি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশের হাজার হাজার স্কুলে সরকার এবং দানশীল ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গত কয়েক বছরে কম্পিউটার ও ল্যাপটপ দিয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে ‘কম্পিউটার ল্যাবরেটরি’ রয়েছে। শিক্ষকও আছেন। কিন্তু দেখা গেছে, শিক্ষক নিয়োগের সময় যোগ্যতা ও দক্ষতা সব প্রতিষ্ঠানে গুরুত্ব পায়নি।
অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালীদের চাপে কম্পিউটার জ্ঞান তেমন নেই, এমন ব্যক্তিকেও নিয়োগ দিতে হয়েছে। আমাকে একাধিক বিদ্যালয় শিক্ষক বলেছেন যে, নিয়োগ প্রদানের সময় যদি চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে উপযুক্ত ব্যক্তি বেছে নিতে পারা যেত- করোনাকালে খুব কাজে লাগত।
যারা এমন মহা ভুল করেছেন, তারা এ থেকে শিক্ষা নেবেন কি? আশা করি- ভবিষ্যতে এমন ভয়ংকর ভুল আর হবে না। এসব প্রভাবশালী ব্যক্তির নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু ভুলেও কি সেখানে অদক্ষ হিসাবরক্ষক বা কম্পিউটার অপারেটর নেবেন?
দলীয় লোক কিংবা আত্মীয়কে চাকরি প্রদানের বাধ্যবাধকতা থাকলে এমন সব শাখায় নিয়োগ দেবেন, যে কাজ তারা করতে পারেন। কাজ না জানলে বসিয়ে বেতন দেবেন? শিক্ষকতায় এমনটি চলে না। চিকিৎসায় এটা চলে না। অথচ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন কম্পিউটার শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছে, যারা সফটওয়্যার আপডেট করতে জানে না। মেরামত কাজ জানে না। অনলাইন ক্লাসের আয়োজন করতে জানে না।
করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়েছে। গত বছর (২০২০) মার্চে করোনা রোগী চিহ্নিত হওয়ার পর দাবি ওঠে- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে। কেউ কেউ অনশন পর্যন্ত করেছে। মানববন্ধন হয়েছে। গণমাধ্যমে তার প্রচার হয়েছে। এখন দাবি উঠছে- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। সরকারের ভয়- যদি ঢাকা বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের ছাত্রছাত্রীরা সংক্রমিত হয়? আরেকটি বিপদ, যারা বিশেষজ্ঞ হিসেবে টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে মতামত-পরামর্শ দিচ্ছেন, তাদের কাছ থেকে এক সুর আসছে না। একজনের কথার সঙ্গে অপরজনের অমিল থাকে, অনেক সময় বিপরীত মতও আসছে।
শিক্ষার্থীরা কী করবে?
করোনাকালে অনলাইন শিক্ষার ওপর জোর পড়েছে। যতটা না বাস্তবে, তার চেয়ে ঢের বেশি বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায়। ইন্টারনেট-ভিত্তিক আলোচনায় এক বছরে অনেক ছাত্রছাত্রী উপকৃত হয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় ব্যক্তিগত যোগাযোগ উপেক্ষিত হয়েছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা নিজ প্রতিষ্ঠানের ২০-২৫-৩০ জনকে ভাগ করে নিয়েছেন- এমন কথা শুনেছি। এটা হয়ে থাকলে আশার কথা। কিন্তু সন্দেহ, যতটা বলা হয়, বাস্তবে ততটা হয়নি।
মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের বলা যেত- তোমার বসবাসের আশপাশের ২৫-৩০টি পরিবারের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর রাখবে। এ বিষয়ে নোট রেখে শিক্ষকের সঙ্গে পরামর্শ করবে। একেক ক্লাসের জন্য একেক ধরনের টাস্ক। এ ধরনের কাজের জন্য মেডিক্যাল ছাত্রছাত্রীদের সরকার বৃত্তিও দিতে পারত। এ কাজ করা গেলে স্বাস্থ্য সেবায় নতুন দিগন্ত খুলে যেত।
প্রকৌশল ও টেকনিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্যও যার যার উপযোগী টাস্ক দেয়া যেত। কিন্তু হায়, আমরা যে ভরসা করেছি প্রধানত ইন্টারনেট ও ক্লাসে উপস্থিত করানোর পর শিক্ষা।
সামনে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে, কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না। বিশ্বের কোনো দেশই করোনার শেষ দেখতে পারছে না। আমরা সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করছি কয়েক বছর ধরে। পরীক্ষতেও ‘সৃজনশীলতা’। কিন্তু করোনার মহাবিপর্যয়ের সময় শিক্ষাক্ষেত্রে যে সৃজনশীলতা দেখানোর প্রয়োজন ছিল, সেটা দেখাতে পেরেছি কি? শিক্ষকরা কি পেরেছেন? তাদের সংগঠনের নেতারা পেরেছেন? ছাত্র সংগঠনের নেতারা পেরেছেন? শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা দপ্তর ও অধিদপ্তর কি পেরেছে?
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।