একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসে এক ভদ্রমহিলা লিখেছেন- ‘আমার হাজবেন্ড জানেন আমার বয়স ৩২, ফেসবুকে ২৬ আর বাস্তবে ৩৭’। ফান পোস্ট মনে হলেও ফেসবুক বাস্তবতা এমনই- আমাদের। এই পোস্টটিও কোনো মহিলার নয়, পুরুষের। এই হচ্ছে আমাদের চরিত্র।
নিজে দুশ্চরিত্র হয়ে অন্যের চরিত্রহননে আমাদের আগ্রহ সীমাহীন। ছদ্মবেশে আড়ালে থাকতে ভালোবাসি। করি এক, বলি আরেক। লোকে যেন বুঝতে না পারে। এই আড়াল বা ছদ্মবেশীরা ফেসবুকজুড়ে আছে। গিজগিজ করছে, কিলবিল করছে, উপচে পড়ছে।
কদিন আগে একটি খবরে চোখ আটকে যায়- ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর ধর্ষণের শিকার গৃহকর্মী এক বছর ধরে’। সংবাদটি যেমন উৎকণ্ঠার, তেমনি হতাশার। ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী’, ‘ধর্ষণ', 'গৃহকর্মী', ‘বছরজুড়ে’!
এমন শব্দগুলো আমাকে রীতিমতো ভাবিয়ে তোলে। মনস্তত্ত্ব, মনোবৈকল্য বোঝার চেষ্টা আমার দীর্ঘদিন ধরে। সেই সূত্র ধরেই আমজাদ (প্রকৃত বা পুরো নাম নয়।
কেননা বিষয়টি বিচারাধীন) যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ধর্ষণ করে আসছিলেন তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা ঘুরে আসি। ঘুরে আসি না বলে আতশ কাচে দেখার চেষ্টা করি বলা ভালো। ফেসবুকে ছেলেটি সাধু সজ্জন। বন্ধুদের সঙ্গে সুন্দর সুন্দর ছবি, ভালো ভালো উক্তি, মনীষীদের বাণী, ধর্মের বাণীও রয়েছে সেখানে। কিন্তু ধর্ষণের চেয়ে অসভ্য, বর্বর, বীভৎস আর কী হতে পারে? অথচ কে বুঝবে ছেলেটির মুখোশের আড়ালে বিকৃতির বাস?
আমি আগেও বলেছি, ধর্ষণ কিন্তু কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। ধর্ষণকে যৌন সম্পর্কের সঙ্গে মেলালে নেহাত ভুল করবেন। ধর্ষণ কোনো যৌনসুখও দেয় না। ধর্ষণের যে ধস্তাধস্তি, বাধা, প্রতিরোধের চেষ্টা, প্রত্যাখ্যান, অনিচ্ছা তার বিপরীতে যাওয়ার চেষ্টা ও আনন্দই হলো ধর্ষণ। অপরাধীর আনন্দ রতিক্রিয়ায় নয়, বিকৃতিতে- ধর্ষণে।
এই বিষয়টি মনোবিদ জ্যাঁক লাকাঁ খুব ভালোভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। এমন আমজাদ ফেসবুকে একজন নয়; শত শত, হাজার হাজার, লাখ লাখ। ফেক আইডির অভাব নেই। কেউ কেউ আরও বেপরোয়া।
স্বনামেই চালিয়ে যাচ্ছেন দুরভিসন্ধি। সফল হচ্ছেন, সর্বনাশ করছেন অন্যের। কেউ জড়িয়ে যাচ্ছেন প্রেমে, কেউবা পড়ছেন ফাঁদে। কারো ভাঙছে সংসার, খোয়াচ্ছেন সর্বস্ব। বলতেও পারছেন না কাউকে।
এ তো গেল যৌন অধ্যায়, অযৌন অধ্যায়টিও কম ভয়াবহ নয়। এই অধ্যায়টিতে বিনিয়োগ আছে। রাজনৈতিক বিনিয়োগ। অপশক্তির অঢেল অর্থ। তারা ফেসবুকজুড়ে চাষাবাদ করছে গুজবের। সম্ভবত গুজব দাবানলের চেয়েও বেশি ছড়ায়, আর চাষাবাদ বাম্পার ফলনের চেয়েও বেশি।
কেউ রাজনৈতিক উসকানি, কেউ বাণিজ্যিক উসকানি, কেউবা ধর্মীয় উসকানিদাতা হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু এই উসকানিদাতাদের না আছে দেশপ্রেম, না তারা ধার্মিক।
আমি বলছি না সরকারের ব্যর্থতা নেই, অব্যবস্থাপনা নেই, দুর্বলতা নেই। আছে, তালিকা করলে সেই তালিকা দেখা যাবে কম দীর্ঘ নয়। কিন্তু যে বা যারা সরকারের অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী, খোঁজ নিলে দেখা যাবে তারা কেবলই সুবিধাবাদী গোষ্ঠী, একটি সম্প্রদায়।
সে কারণে সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলা কতটা যৌক্তিক? অপরাধী যেই হোক তার বিচার চাওয়া জরুরি। হোক সে আওয়ামী লীগের যে কেউই।
এ কথা সত্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম অনেক বেশি শক্তিশালী, জোরালো মত প্রকাশের ক্ষেত্রে। কিন্তু পাশাপাশি এটাও মনে রাখা প্রয়োজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কোনো নিউজ মিডিয়া নয়, নিউজ এজেন্সিও নয়। ফেক নিউজের জন্য ফেসবুক আইডি বন্ধ হতে পারে, শাস্তির আওতায় আসতে পারে। কিন্তু সে তো বিশৃঙ্খলা ঘটানোর আগে নয়, পরেই।
তাই অন্যকে বিশ্বাস করার আগে, বিশ্বাস করুন নিজেকে, হোক ব্যক্তিগত প্রেম অথবা দেশপ্রেমই।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক