কোভিড তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের থেকেও ভয়াবহভাবে আক্রান্ত করল পৃথিবীকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিডে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা যা ধারণা করছে, তা প্রায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নিহতের সংখ্যার কাছাকাছি হতে চলেছে। অর্থনীতির মোট ক্ষতি শেষ বিচারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে যে ক্ষতি হয়েছিল তার থেকে বেশিই হবে। তবে এ মুহূর্তে সব থেকে বড় হিসেবে দেখা দিয়েছে দুটি বিষয়। এক. মূল্যস্ফীতি, অর্থাৎ বিশ্বজুড়ে সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া। দুই. ধনী ও দরিদ্র দেশের ভেতর বৈষম্য বাড়ার দিকে এগিয়ে চলেছে পৃথিবী।
বাস্তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ষাটের দশক অবধি বিশ্বজুড়ে ছিল মূল্যস্ফীতির সংকট। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশকে পোহাতে হয় এই সংকট আরও বেশি সময় ধরে। তারপরে ধীরে ধীরে তা কমে আসে। তারপরে পৃথিবীজুড়ে আবার যে মূল্যস্ফীতি হয়, অর্থাৎ বাজারদর বেড়ে যায় তা নতুন মিলেনিয়ামে বিশ্বজুড়ে একটা মন্দা নেমে আসায়। এই মন্দা অবশ্য পৃথিবীকে খুব বড় ধাক্কা দিতে পারেনি।
কারণ, বিশ্বজুড়ে পণ্য চলাচলের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের রাষ্ট্রীয় কোষের অর্থ-সাহায্য দিয়ে উৎপাদন ঠিক রাখা; অভ্যন্তরীণ বাজার, রপ্তানিকে সহায়তা করায় মন্দা তেমন বড় আকার নিতে পারেনি। তবে কোথাও আর মূল্যস্ফীতিকে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। অবশ্য দেশে দেশে মানুষের আয় বেড়ে যাওয়াতে মানুষ ওই মূল্যস্ফীতির মধ্যে, অর্থাৎ ওই বেড়ে যাওয়া জিনিসপত্রের দামকেও সহ্য করতে পারছিল।
এ অবস্থার ভেতর পৃথিবীজুড়ে আঘাত করেছে কোভিড-১৯। বড় আকারের লকডাউন যেমন অর্থনীতিকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে; তেমনি কোভিড থেকে বাঁচতে মানুষের ঘরবন্দি জীবন অর্থনীতিকে করে তুলছে প্রতিমুহূর্তে ক্ষতিগ্রস্ত। তা ছাড়া এতে দেশে দেশে কৃষিপণ্যসহ নানা পণ্য উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। কোথাওবা বিদেশি শ্রমিক বা পরিযায়ী শ্রমিকের অভাবে সম্ভব হচ্ছে না অনেক কৃষিপণ্য উৎপাদনও।
অর্থাৎ পণ্য চলাচলে বাধা ও উৎপাদন কমে যাওয়ায় পণ্যের দাম বেড়ে চলেছে পৃথিবীর সব দেশে। যেমন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া কোভিড শুরু হওয়ার পর থেকেই বিদেশি শ্রমিকের অভাবে পাম উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এই দুটি দেশই পৃথিবীর অধিকাংশ পামের জোগানদাতা। এই পাম উৎপাদন কমে যাওয়ায় পৃথিবীজুড়ে পাম থেকে উৎপাদিত সব থেকে কম দামের এই ভোজ্যতেলটির দাম বেড়ে গেছে। আর পাম অয়েলের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে দাম বেড়ে গেছে সয়াবিন তেল থেকে অলিভ অয়েল অবধি। এ রকমভাবে নানা পণ্যের দাম বাড়ছে কোভিডের ধাক্কায়।
আবার এই পণ্যের দাম যখন বাড়ছে, এ সময়ে পৃথিবীতে মানুষের রোজগার কমে যাচ্ছে। মানুষের যখন রোজগার কমে যায় এবং সে সময়ে যদি বাজারে পণ্যের দাম বেশি থাকে, তাহলে মানুষ বাধ্য হয় তার সব ধরনের প্রয়োজনকে সীমাবদ্ধ করে ফেলতে। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে তো মানুষ তার খাদ্য কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
এমনকি যদি দেশে দেশে মূল খাদ্যপণ্যের দাম না বাড়ে, তারপরেও আয় কমে যাওয়ার ফলে মানুষ সেটা কম কিনতে বাধ্য হয়। এ অবস্থায় সৃষ্টি হয় অপুষ্টিজনিত একধরনের দুর্ভিক্ষ; যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীতে দেশে দেশে দেখা গিয়েছিল। এমনকি সে সময়ে ইউরোপের মতো উন্নত দেশগুলো থেকে শুরু করে এশিয়ার উন্নত দেশ জাপানেও এই বিশেষ ধরনের দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
কোভিড যেভাবে দ্বিতীয় ওয়েভের পর তৃতীয় ওয়েভে প্রবেশ করছে বিভিন্ন দেশে, তাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী এই বিশেষ ধরনের দুর্ভিক্ষের মতো দুর্ভিক্ষ পৃথিবীর বহু দেশকে পোহাতে হবে। পাশাপাশি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাণিজ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়াসহ অর্থনীতির নানান ক্ষতির কারণে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের মানুষকে ঠেলে দিয়েছিল চরম বেকারত্বে, এবারও তার ইঙ্গিত ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে; এবং এটা বাড়বে।
কারণ, পৃথিবীর সব মানুষকে কোভিডের টিকা দেয়ার আগে পৃথিবী কোনোমতেই এই কোভিডের একের পর এক ওয়েভের ধাক্কা থেকে বের হতে পারবে না। আর ২০২২ সালের আগে কোনোমতেই পৃথিবীর সব মানুষ টিকা পাচ্ছে না।
পৃথিবীর সব মানুষ যে সময়ে টিকা পাচ্ছে না, এ সময়ে দেখা যাবে আর্থিকভাবে উন্নত দেশগুলো আগেই তাদের মানুষকে টিকা দিতে সমর্থ হবে। যেমন, ইতোমধ্যে আমেরিকা ও চায়না তাদের বেশি মানুষকে টিকা দিতে সমর্থ হয়েছে।
এ মুহূর্তে পৃথিবীর বাস্তবতা বলছে, আমেরিকা ও চায়না সবার আগে তাদের সব মানুষকে টিকা দিতে সমর্থ হবে। অর্থাৎ পৃথিবীর সব থেকে বড় দুই অর্থনীতি সবার আগে কোভিড থেকে বের হয়ে যাবে; এবং গতিশীল করতে পারবে তাদের অর্থনীতি। যেমন চায়না এ মুহূর্তে তাদের অর্থনীতি যতটা গতিশীল করেছে, এমনটি আর কোনো দেশ পারেনি। বাস্তবতা বলছে, আমেরিকা দ্রুত পারবে। তবে এই দুই দেশ ছাড়া অন্য উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোকে এ অবস্থায় যেতে ’২২ সাল লেগে যাবে।
আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য আরও বেশি সময় লেগে যাবে। যার ফলে ধনী ও দরিদ্র দেশের ভেতর যে বৈষম্য বাড়বে, এমনটি হয়তো গত এক শ বছরেও ছিল না। এই ধনী ও দরিদ্র দেশের বৈষম্য বাড়া থেকে বের হয়ে আসতে বা সে সংগ্রামে যেতে চায়না ছাড়া এশিয়ার অন্য দেশগুলোর ও আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য সংগ্রামটি আরও কঠোর হবে। কারণ, এই দেশগুলো তাদের সব মানুষকে কোভিড টিকা ২০২২-এর মধ্যে দিতে পারবে, এমনটি আশা করা যাচ্ছে না। যার ফলে অর্থনীতিকে তারা পৃথিবীর সঙ্গে শতভাগ যুক্ত করতে পারবে না। দেশের উৎপাদনও শতভাগ চালু রাখতে পারবে না।
এমন একটি অবস্থায় বাংলাদেশ এখনও দক্ষিণ এশিয়ায় তার অর্থনীতিকে অনেক ভালো রেখেছে। ভারতে ভয়াবহ কোভিডের ছোবল আর মিয়ানমারে কোভিডের পাশাপাশি সামরিক জান্তার ছোবলের ফলে বাংলাদেশের মূল রপ্তানি পণ্য পোশাক সরবরাহের বাড়তি অর্ডার এ মুহূর্তে পাবে। তবে তারপরেও মোট রপ্তানি যে কমে যাচ্ছে, এর প্রমাণ একের পর এক ছোট ছোট পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া।
অপরদিকে সব থেকে নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে অনেক বেশি যুক্ত থাকে দেশের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজার। ভারতে কোভিডের ছোবল ভয়াবহ হওয়ায় বাংলাদেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে অনেক জিনিসের দাম বেড়েছে। তা ছাড়া আরও যে বিষয় হলো, ভারতের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া অবধি বাংলাদেশ সরকার দেশকে কোনোমতেই শতভাগ লকডাউনমুক্ত করতে পারবে না। কারণ, যেকোনো মুহূর্তে আরেকটি ওয়েভ বাংলাদেশকে আক্রান্ত করার আশঙ্কা থেকে যায়।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য সব থেকে জরুরি প্রয়োজন দেশের শতভাগ মানুষকে টিকা দেয়া। কিন্তু পৃথিবীজুড়ে টিকার যে চাহিদা, তাতে দেশের মানুষকে বিদেশ থেকে আমদানি করে টিকা দিতে হলে ২০২২-এর আগে বাংলাদেশ দেশের সব মানুষকে টিকা দিতে পারবে, এমন ধারণা করা শক্ত। এ জন্য বাংলাদেশকে দ্রুত নিজস্ব প্লান্টে টিকা উৎপাদনে যেতে হবে। কিন্তু তাও সময়সাপেক্ষ। অর্থাৎ ২০২১-এর এই ছয় মাসের মধ্যে সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশও শতভাগ উৎপাদন ও শতভাগ বিদেশের সঙ্গে নিজেকে সংযোগ করার কাজ ২০২২-এর একটা পর্যায়ের আগে করতে পারবে, এমনটি আশা করা যাচ্ছে না এ মুহূর্তে।
অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেয়া এই করোনা অতিমারির ধাক্কা পৃথিবীর অন্য দরিদ্র দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও বেশ বড় আকারেই লাগবে। এ অবস্থায় আগামীর এই আঘাত মোকাবিলার জন্য এখনই পর্যায়ক্রমে এগোনের সিদ্ধান্তগুলো নেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি জনগণকে বাস্তবতা মোকাবিলার জন্য তার আগামী দিনে কী করতে হবে, তাও জানানো দরকার।