গাজায় ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে খেলনা পুতুল হতে নিয়ে ২/৩ বছরের যে শিশুটি কাঁদছিল, যে শিশুটি বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে নিথর হয়ে, ইসরাইলি রকেট হামলায় পরিবারের সবাইকে হারিয়ে পথের পাশে বসে হাউমাউ করে কাঁদছিল যে দুই ভাইবোন, তারা সবাই আমার আপনার সন্তান হতে পারত। রাজনীতি এত নিষ্ঠুর যে, যুগের পর যুগ ধরে এই শিশুদের কান্না কারো হৃদয় গলাতে পারেনি।
কয়েকবছর আগে টিভিতে দেখেছি ৪/৫টি শিশু ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে প্রশ্ন করছে- কেন তোমরা আমাদের ভাইকে ধরেছ? তোমরা চলে যাও, তোমরা ওকে ছেড়ে দাও।
অপরদিকে ১৬/১৭ বছরের এক শিশুকে, মানে তাদেরই ভাইকে ৫/৬ জন ইসরাইলি জোয়ান বুট দিয়ে গলা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ছবিগুলো দেখে বুকটা ভেঙে যায়। আহত হই, ভিতরে ভিতরে প্রতিবাদ করি, কিন্তু জানি যে কিছু হয় না। এই একইরকম ছবি দেখে চলেছি যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায়, ইরান ও ইরাকে। এভাবেই পথের ধারে বসে কাঁদতে কাঁদতে অসংখ্য ফিলিস্তিনি শিশু ঝরে পড়ে। তাদের আর স্কুলে যাওয়া হয় না, বড় হয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নপূরণ হয় না, বাবা-মায়ের পাশে শুয়ে গল্প শোনা হয় না।
গাজা ও ইসরাইলের মধ্যে সাময়িক যুদ্ধবিরতি হয়। কিন্তু এরমধ্যে মানুষের যা হারানোর তা হারিয়েই যায়। বেশ কিছুদিন হলো দক্ষিণ ইসরাইলে সাইরেনের শব্দ থেমে গেছে, গাজাতেও বোমার শব্দ শোনা যাচ্ছে না, বরং সেখানে উৎসব আয়োজনের গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
পরিস্থিতির এই পরিবর্তনের কারণ হামাস বাহিনী ও ইসরাইলিদের মধ্যে একটি দুর্বল ধরনের যুদ্ধবিরতির ঘোষণা হয়েছে সম্প্রতি। দুপক্ষই জানে যেকোনো মুহূর্তে আবার যুদ্ধ শুরু হবে। মাঝখান দিয়ে অজস্র শিশু-কিশোরের জীবন ভাঙা ভবনের নিচে চাপা পড়ে যেতেই থাকবে!
অতীতেও হামাস আর ইসলাইলের মধ্যে বেশ কয়েকবার সন্ধি হলেও, সেগুলো টেকেনি। আর তাই দুপক্ষের মধ্যেই একধরনের অস্থিরতা রয়েই গেছে। আসলে ‘মূল সমস্যা’র সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের যুদ্ধবিরতি কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না।
জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে জমির অধিকার এবং জেরুজালেমের পুরোনো শহর নিয়ে ধর্মীয় উত্তেজনা যতদিন নিষ্পত্তি না হবে, ততদিনই ইসরাইল ও মিশরের মধ্যে গাজা একটি শাস্তিমূলক অবরোধ ব্যবস্থায় থাকবে। ফলে ফিলিস্তিনের এই সংকট কাটবে না কোনোদিনও।
বছরের পর বছরজুড়ে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যে হত্যাযজ্ঞ চলছে, সেই হত্যা হচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। ফিলিস্তিনিরা মুসলিম বলেই ইসরাইলি বাহিনীর গণহত্যা নিয়ে বিশ্ব চুপ করে থাকে, বিশেষ করে আমেরিকা।
আমেরিকা বিশ্বের যেকোনো দেশে মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হলে কথা বলে কিন্তু ইসরাইল প্রশ্নে নিশ্চুপ। এমনকি ইসলামি দেশগুলোও তেমনভাবে কোনো ভূমিকা রাখে না এই সংকট নিরসনে।
আমরা যারা ভেবেছিলাম ট্রাম্পের মতো উদ্ভট লোকটা ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে, বাইডেনের মতো ভদ্রলোক এসেছে, কাজেই আন্তর্জাতিক কৌশলে পরিবর্তন আসবে, তা ভুল হলো। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে সরকার বদল হয় কিন্তু তাদের শত্রু-মিত্র একই থাকে। ইসরায়েল তাদের বড় মিত্র। কাজেই ইসরাইলের পক্ষে যে যুক্তরাষ্ট্র কলকাঠি নাড়বে, তা সহজেই অনুমেয়। ইসরাইলের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
অপরদিকে কুয়েত-ইরাক যুদ্ধ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, সিরিয়ায় হামলা এবং এমনকি রোহিঙ্গা সংকটের সময় আমরা দেখেছি আরব বিশ্বের পলায়নপর ও ভোগের মানসিকতা। কোথায় মানুষ মারা যাচ্ছে, কোথায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এসব নিয়ে তারা কোনোদিনই ভাবেনি এবং কারো পাশে এসেও দাঁড়ায়নি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এই আরব বিশ্ব পাকিস্তানকে নগ্নভাবে সমর্থন দিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে সবধরনের জঙ্গি তৎপরতায়, তাদের ইন্ধন ছিল বলে অভিযোগ আছে।
মুসলিম শক্তিগুলো চেয়েছে ফিলিস্তিনে হামাস পর্যুদস্ত হোক। কারণ তারা মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিজেদের জন্য ত্রাস হিসেবে মনে করে।
এজন্য তারা ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দও করে না। আরবরা চাইলে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার ব্যাপারে ইসরাইলের ওপর চাপ দিতে পারত, পারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেনদরবার করতে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল প্রতিবেশী কোনো আরব রাষ্ট্র একটা কথাও বলেনি।
আসলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সৃষ্টি নিয়ে যে ইতিহাস, সেই ইতিহাসের মধ্যেই প্রোথিত হয়ে আছে ফিলিস্তিনের পরাজয়। এই ১০০ বছরের পুরোনো সংকট কাটেনি, বরং আরও স্থায়ী হয়েছে। ফিলিস্তিন অটোমান সম্রাটদের হাত থেকে ব্রিটেনের হাতে চলে গেল। তখন ফিলিস্তিনে যারা থাকত, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল আরব, সেই সঙ্গে কিছু ইহুদি যারা ছিল সংখ্যালঘু।
এই দুই ধর্মের মধ্যে যখন গোলযোগ বাড়তে শুরু করল, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্রিটেনকে দায়িত্ব দিয়েছিল ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য ফিলিস্তিনে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দেয়ার জন্য। মূল সমস্যাটা তখন যা ছিল, এখনও তাই আছে। ইহুদিরা এই অঞ্চলকে তাদের পূর্বপুরুষদের দেশ বলে দাবি করে। আরবরাও দাবি করে এই ভূমি তাদের।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে এক ভোটাভুটিতে ফিলিস্তিনকে দুই ভাগ করে দুটি পৃথক ইহুদি এবং আরব রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হলো। জেরুজালেম থাকবে একটি আন্তর্জাতিক নগরী হিসেবে। ইহুদি নেতারা এই প্রস্তাব মেনে নিলেও, আরব নেতারা একে অন্যায্য বলে ফিরিয়ে দিয়েছিল।
ফলে জাতিসংঘের এই পরিকল্পনা কখনই বাস্তবায়িত হয়নি। সেই ব্যর্থতার কারণে ইসরাইল এখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ, আর ফিলিস্তিনিরা মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য যুদ্ধ চালিয়েই যাচ্ছে।
ইসরাইল জাতিসংঘ পরিকল্পনায় বরাদ্দ ফিলিস্তিনের জন্য জায়গার অনেকটাই দখল করে নেয়। এরপর যে সামান্য জমি পড়ে ছিল, সেটা আবার ভাগ করে নিয়েছে মিসর ও জর্ডান।
এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে বার বার আলোচিত হচ্ছে ইসরাইলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দখলদারি মনোভাবের কারণে কোনো সমাধান হচ্ছে না, শুধু সহিংসতাই বাড়ছে।
১৯৯৬ সালে পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনিদের যে স্বায়ত্তশাসন কায়েম হয়েছে, তা নামমাত্র। কারণ অধিকাংশ এলাকা সেই ইসরাইলেরই নজরদারির ভিতরে থেকে গেল। আর তাদের প্রশাসনও দুইভাগ হয়ে গেছে। পশ্চিম তীর গেল ফাতাহর নিয়ন্ত্রণে, গাজা গেল ইসলামিক ব্রাদারহুডের মিত্র হিসেবে পরিচিত হামাসের কাছে।
সৌদি আরব, মিসর, জর্ডান ও উপসাগরীয় দেশগুলো মনে করে- হামাস ধ্বংস হলে তাদের প্রত্যেকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুরক্ষিত হবে। ফলে গাজা আর ইসরাইলের ভিতর কোনো গোলযোগ শুরু হলে এই দেশগুলো হামাসকে সমর্থন জানায় না।
বিশ্বের সাধারণ মানুষ শুধু দেখে যাচ্ছে ফিলিস্তিন জ্বলছে। আশির দশকে আমাদের ছাত্রজীবনে ইয়াসির আরাফাতকে দেখেছি হিরো হিসেবে, প্যালেস্টাইনের উপর পাতার পর পাতা পড়েছি, অসংখ্য ফিলিস্তিনি ছাত্রদের দেখেছি উদ্বাস্তু হয়ে ঘুরতে।
এখানে পড়াশোনা শেষ করে তারা কী করবে, কোথায় যাবে জানত না। কারণ তাদের কোনো ভিটামাটি ছিল না। সেসময় ফিলিস্তিনের পক্ষে যুদ্ধ করতে আমাদের দেশের অনেক ছেলে গিয়েছিল। জানি না কী হয়েছিল তাদের পরিণতি। কিন্তু ফিলিস্তিন রাষ্ট্র যে আদতে কায়েম হয়নি, তা তো দেখতেই পাচ্ছি।
প্রকৃতপক্ষে ইয়াসির আরাফাত চলে যাওয়ার পর ফিলিস্তিনিদের নিজেদের কোনো নেতা নেই, নেই পথ দেখানোর মতো খলিফা, বন্ধু-পরামর্শদাতা নেই, নেই অর্থ ও সঠিক পরিকল্পনা। বরং রয়েছে অনেক শত্রু রাষ্ট্র, যারা শক্তিধর, আছে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও স্বার্থগত দ্বন্দ্ব। আর আছে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের ষড়যন্ত্র।
তারা একদিকে আরব রাষ্ট্র ও হামাসের কাছে কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে, অপরদিকে করছে ইসরাইলের কাছে। এই অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কখনই চাইবে না যে, কোনোদিন যুদ্ধ থামুক। আর যে দেশ ও দেশের মানুষ সবসময়য়ের জন্য যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করে, তাদের পক্ষে পরিস্থিতি বুঝে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন প্রায় অসম্ভব।
লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন