রাজধানীর মিরপুরের পল্লবীতে সাহিনুদ্দীন নামে এক ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার দুই আসামি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। অর্থাৎ এই দুজনের নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে পুরো মামলাটির বিচারকাজ আপাতদৃষ্টিতে এখানেই শেষ হলো(?)। কেননা এই মামলায় একজন সাবেক সংসদ সদস্য গ্রেপ্তার হলেও তার বিচার করা কঠিন হবে; যেহেতু তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সাক্ষী হতেন যে দুজন, সেই দুজনই কোনোদিনও আর সাক্ষী হতে পারবেন না।
শুধু ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই আসামির মৃত্যুই নয়, বরং এই ঘটনার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে, যার নাম নৃশংসতা। যে দুজন আসামি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন, তারাই ছয় বছরের শিশু সন্তানের সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করেন সাহিনুদ্দীনকে। মোবাইল ফোনে ধারণ করা ওই নৃশংসতার ভিডিও ভাইরাল হলে সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, এই নৃশংসতার নীলনকশা আঁকেন লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক এমপি ও তরীকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়াল।
এই ঘটনায় যে প্রশ্নটি আরও একবার সামনে এসেছে তা হলো, খুনের ভিডিও না থাকলে এবং সেই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে না পড়লে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুততম সময়ের মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করত বা করতে পারত কি না? এই নৃশংসতার ভিডিও ছড়িয়ে না পড়লে একজন সাবেক সংসদ সদস্যও এত দ্রুত গ্রেপ্তার হতেন কি না বা তাকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে ধরনের চাপের মধ্যে পড়ত, সেই চাপ এড়িয়ে সত্যিই তাকে গ্রেপ্তার করা যেত কি না?
পল্লবীর এই নৃশংসতার রেশ না কাটতেই খোদ রাজধানীতেই আরেকটি ভয়াবহ খুনের ঘটনাও গণমাধ্যমে আসে। দক্ষিণখান সরদার বাড়ি জামে মসজিদের সেপটিক ট্যাংক থেকে আজহারুল নামে এক পোশাক শ্রমিকের ছয় খণ্ড গলিত লাশ উদ্ধারের পর ওই মসজিদের ইমাম মো. আবদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। র্যাব বলছে, গত ১৯ মে থেকে আজহার নিখোঁজ ছিলেন। তাকে খুঁজে বের করতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়। এভাবে হত্যাকারীকে চিহ্নিত করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, আটকের পর আজহারুলকে নৃশংসভাবে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন আবদুর রহমান।
গণমাধ্যমে এ পর্যন্ত যেসব খবর এসেছে তাতে বলা হচ্ছে, নিহত আজহারের ছেলে আরিয়ান ওই মসজিদের মক্তবে পড়াশোনা করত। আজহার নিজেও তার কাছে কোরআন শিক্ষা গ্রহণ করতেন। কিন্তু আজহারের স্ত্রীর সঙ্গে আবদুর রহমানের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
গত ১৯ মে এ নিয়ে আজহারের সঙ্গে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তার গলার ডানপাশে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেন আবদুর রহমান। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। কিন্তু পরে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে আজহারের লাশ টুকরা টুকরা করে সরদার বাড়ি জামে মসজিদের সেপটিক ট্যাংকে লুকিয়ে রাখেন আবদুর রহমান।
প্রশ্ন হলো, একজন মসজিদের ইমাম কী করে এতটা নৃশংস হলেন? কী করে তিনি একজন মৃত মানুষের শরীরকে ছয় টুকরো করে সেপটিক ট্যাংকে লুকিয়ে রাখলেন? যে ইসলাম, যে ধর্ম সব সময় মানবতার কথা বলে; যে ব্যক্তি মসজিদের মতো একটি পবিত্র জায়গার জিম্মাদার; যার পেছনে অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন নামাজ পড়তেন— সেই লোকটি মুহূর্তের মধ্যে কী করে খুনি হয়ে উঠলেন? যদি অভিযোগ সঠিক হয়, তাহলে এ প্রশ্নও সামনে আসবে যে, একজন মসজিদের ইমাম কেন পরনারীতে আসক্ত হলেন বা আরেকজনের স্ত্রীর সঙ্গে কেন তাকে সখ্য গড়ে তুলতে হলো? যদি তিনি এসব লোভের ঊর্ধ্বে উঠতেই না পারলেন, তাহলে আর তিনি মসজিদের ইমাম হলেন কী করে? এতদিন তিনি কী নামাজ পড়িয়েছেন? তার নিজের নামাজটুকু হয়েছে কি না প্রশ্নটি সামনে এসে যায়।
র্যাব বলছে, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনে নিহতের স্ত্রী জড়িত কি না, তা নিয়েও তদন্ত শুরু হয়েছে। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। যদি তাই হয়, তাহলে ঘটনার আরও একটি দিক উন্মোচিত হবে এবং যদি সত্যিই আজহারের নিহত হওয়ার পেছনে তার স্ত্রীর হাত থাকে, তাহলে আজহারের মৃত্যুকেও ‘পরকীয়ার বলি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে; যে পরকীয়া বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক এখন সমাজে নীরব মহামারি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন।
যদি তাই হয়, তাহলে আর বুঝতে বাকি থাকবে না যে, পরকীয়া কী করে একজন মসজিদের ইমামের মতো সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য, আপাতদৃষ্টিতে ভালো এবং অজাতশত্রু মানুষকেও নৃশংস খুনি বানিয়ে ফেলে। সুতরাং আলোচনাটি তখন আর কেবল একজন পোশাক শ্রমিকের খুন হওয়া বা তার লাশ খণ্ড খণ্ড করে সেপটিক ট্যাংকে লুকিয়ে রাখা কিংবা এই ঘটনায় একজন ইমামের গ্রেপ্তারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তখন বিষয়টি দেখতে হবে একইসঙ্গে অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানের আলোকে।
পল্লবীতে শিশু সন্তানের সামনে বাবাকে নৃশংসভাবে খুন করার পরে দুই আসামির বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনাকেও একটি সিঙ্গেল ট্র্যাকে বা সিঙ্গেল পার্সপেকটিভে আলোচনার সুযোগ নেই। কেননা, এখানে শুধু একটি খুন এবং খুনের পরে আসামিদের গ্রেপ্তারই মূল বিষয় নয়। পুলিশ বলছে, নিহত সাহিনুদ্দিনের বিরুদ্ধেও পল্লবী থানায় প্রায় ২৪টি মামলা রয়েছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে তাকে গ্রেপ্তার করার পর ১১ মে জামিন পান। আবার সাহিনুদ্দিনের মা আকলিমা বেগমের অভিযোগ, পুলিশের অবহেলাই তার ছেলের মৃত্যুর কারণ। একাধিকবার জিডি করা হলেও পুলিশ তার সন্তানের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। আগ থেকে সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।
কে কাকে কীভাবে খুন করল, সেই প্রশ্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের জানা জরুরি। কিন্তু একজন মানুষ কী করে খুনি হয়ে ওঠে; সেখানে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কী দায়— সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
পল্লবীতে প্রকাশ্যে অবুঝ সন্তানের সামনে নৃশংসভাবে বাবাকে যারা হত্যা করল, তারা নিশ্চয়ই জানত যে, এই স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সময়ে কেউ না কেউ এই ঘটনার ছবি তুলছে এবং সেই ছবি ছড়িয়ে যাবে। কিন্তু তারপরও তারা কী করে এমন বেপরোয়াভাবে খুন করল? তারা কি ভেবেছিল বা নিশ্চিত ছিল যে তাদের কিছু হবে না বা পুলিশ তাদের ধরবে না? তারা কি ভেবেছিল যে, একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি যেহেতু তাদের সঙ্গে রয়েছেন, অতএব ধরা পড়লেও তারা একসময় ঠিকই ছাড়া পেয়ে যাবেন? তার মানে প্রচলিত বিচারব্যবস্থার প্রতিও তাদের একরকম তাচ্ছিল্য ছিল?
বাস্তবতা হলো, এই দুজনের মতো আরও অসংখ্য মানুষ মনে করে, দুই চারটা খুন করলে কিছু হয় না। যারা মনে করে, টাকা দিয়ে থানা ও আদালত কিনে ফেলা যায়! সুতরাং, শুধু খুনির বিচার কিংবা খুনিকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যাই নয়, এর সঙ্গে অন্য প্রশ্নগুলোরও সুরাহা করা প্রয়োজন। যে প্রশ্নগুলোর সঙ্গে জড়িত একটি রাষ্ট্রের কিছু প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া।
কেন একজন মানুষ আদালতে খুনি, জঙ্গি বা ধর্ষক হিসেবে প্রমাণিত হওয়ার আগেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হোক, আর যার দ্বারাই হোক নিহত হবেন? কেন তিনি এভাবে বিনাবিচারে হত্যার শিকার হলে সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশই খুশি হয়; কেন মানুষ মনে করে যে প্রচলিত বিচারব্যবস্থায় এদের শাস্তি হবে না বা এদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়ার লোক পাওয়া যাবে না— সেসব প্রশ্নেরও সুরাহা করা প্রয়োজন।
সাধারণ মানুষ তো বটেই, সমাজের শিক্ষিত-সচেতন অংশের মধ্যেও এখন অপরাধীকে বিনাবিচারে মেরে ফেলার প্রতি জনসমর্থন বাড়ছে, যার বড় উদাহরণ বরগুনায় স্ত্রীর সামনে রিফাত নামে এক যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর এলাকায় মিষ্টি বিতরণ। কিন্তু অনেক সময়ই একজন অপরাধীকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে তাকে লালন-পালনকারী শীর্ষ অপরাধীরা বেঁচে যায়।
প্রচলিত আইনি কাঠামোয় সব সময় সব অপরাধীর বিচার হয় না বা প্রচলিত বিচারে দীর্ঘসূত্রতা আছে। রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষমতার জোরে অনেক সময়ই অপরাধীরা জামিনে বেরিয়ে যায় এবং পুনরায় একই ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
আবার বছরের পর বছর ধরে তাদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ থাকে; যেহেতু তারা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরলেও কেউ কিছু বলার সাহস পায় না; যেহেতু তারা নারীদের ওপর নির্যাতন করে; যেহেতু তারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকে, সুতরাং তাদের কেউ যখন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়, তখন তার প্রতি জনসমর্থন তৈরি হয়। অর্থাৎ বন্দুকযুদ্ধে অপরাধীদের মৃত্যুর পক্ষে যতটা না সমর্থন, তার চেয়ে বেশি প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা।
কিন্তু যে প্রশ্নটি বার বার সামনে এসেছে তা হলো, এভাবে বিনা বিচারে অপরাধীদের মেরেও কি সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে অপরাধ দূর করা গেছে?
সেন্ট্রাল আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এ ধরনের বন্দুকযুদ্ধ সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে পারেনি। উপরন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো অনেক সময়ই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। প্রতিপক্ষের কাছ থেকে টাকা খেয়ে নিরপরাধ লোককে বন্দুকযুদ্ধে মেরে ফেলার অনেক উদাহরণ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনেও বন্দুকযুদ্ধ ব্যবহৃত হতে থাকে।
এসব কারণে কথিত বন্দুকযুদ্ধে অপরাধী নির্মূলকে অনেক সময় প্যারাসিটামলের সঙ্গে তুলনা করা হয়। অর্থাৎ জ্বর হলে মানুষ যেমন তাৎক্ষণিকভাবে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেয়ে তাৎক্ষণিক উপশম পায়, বন্দুকযুদ্ধও আপাতদৃষ্টিতে একজন অপরাধীকে দুনিয়া থেকে বিদায় করলেও তিনি যেসব কারণে অপরাধী হয়ে উঠলেন, যারা তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিলেন, যে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় তিনি অপরাধী হয়ে উঠতে পারলেন, সেই বিষয়গুলো আড়ালে থেকে যায়।
বাস্তবতা হলো, দেশে আইনের শাসন থাকলে কথিত বন্দুকযুদ্ধ লাগে না। অর্থাৎ বিচারে যদি দীর্ঘসূত্রতা দূর হয়; যদি সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত হয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে সঠিক রিপোর্ট দেয়; যদি বিচার-সংশ্লিষ্টরা সৎ ও আন্তরিক হয়; যদি বিচার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না থাকে; যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার ব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকে; যদি টাকার কাছে তারা বিকিয়ে না যায়, তাহলে বিনাবিচারে কাউকে খুন করার প্রয়োজন হয় না। বরং যত বড় অপরাধীই হোক, প্রচলিত আইনেই তার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। অর্থাৎ প্রচলিত বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষ আস্থাবান হলে বন্দুকযুদ্ধ লাগে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।