১৯২৬ সালের শেষ দিকে যখন ‘ভারতীয় কেন্দ্রীয় আইনসভা’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, কবি কাজী নজরুল ইসলাম তখন সারা বাংলায় অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি। অবশ্য ইতোমধ্যেই গোঁড়া মুসলিম ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দেয়া ‘কাফের’ ফতোয়াও কবির কাঁধে পড়েছে। নির্বাচনে কংগ্রেস-সমর্থিত অর্থাৎ স্বরাজ পার্টির প্রার্থী ছিলেন কবি নজরুল।
নির্বাচনে ভোটদাতাদের সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ১১৬ জন।প্রত্যেক ভোটদাতা দুটি করে ভোট দিতে পারতেন। প্রার্থী দাঁড়িয়েছিলেন পাঁচজন। তার অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মুসলিম লীগের প্রার্থী, বরিশালের বামনার জমিদার মুহম্মদ ইসমাইল চৌধুরী (তিনি ছিলেন রাজবাড়ীর পদমদীর জমিদার নবাব মীর মোহাম্মদ আলীর ভ্রাতুষ্পুত্রী আসমাতুন্নেছার স্বামী), টাঙ্গাইলের জমিদার আব্দুল হামিদ গজনভী, ঢাকার নবাববাড়ির আব্দুল করিম ও মফিজ উদ্দিন আহমেদ।
অবশ্য বাংলা একাডেমির জীবনীপঞ্জিতে ওই নির্বাচনে কবি নজরুলের সঙ্গে তমিজউদ্দিন খানের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সেবার রাজবাড়ীর (খানখানাপুর) তমিজউদ্দিন খান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মুসলিম লীগ থেকে নিম্ন আইন পরিষদ (গোয়ালন্দ ও ফরিদপুর সদর মহকুমা) আসনে।
স্বরাজ পার্টি-কংগ্রেস থেকে নির্বাচন করেন ফরিদপুরের তরুণ জমিদার চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে লাল মিয়া। আর কেন্দ্রীয় আইনসভায় সমগ্র ঢাকা বিভাগ থেকে মুসলমানদের জন্য দুটি আসন সংরক্ষিত ছিল, যার একটিতে কবি নজরুল প্রার্থী ছিলেন।
ওই নির্বাচনে মূলত পীর-মাশায়েকদের সমর্থননির্ভর হয়েই মুসলিম প্রার্থীরা ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। ফরিদপুরের পীর মহসিন উদ্দিন দুদুমিয়া বা পীর বাদশা মিয়া (১৮১৯-১৮৬২) নির্বাচনে সেবার ফতোয়া দিয়েছিলেন বেশ কায়দা করে, কেন্দ্রীয় পরিষদে স্বরাজ পার্টির কবি নজরুল আর নিম্ন আইন পরিষদে বিপরীত দলের প্রার্থী লাল মিয়াকে। পীর সাহেবের ‘ফতোয়া’ হাতে নিয়ে নজরুল ছুটে এসেছিলেন ফরিদপুরে, তমিজউদ্দিনের উদ্দেশে। ওঠেন পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের বাড়িতে। পল্লিকবি জসীমউদ্দীন লিখেছেন সেই নির্বাাচনী স্মৃতিকথা-
একদিন গ্রীষ্মকালে হঠাৎ কবি আমার পদ্মাতীরে আসিয়া উপস্থিত। তিনি কেন্দ্রীয় আইনসভার সভ্য হইবার জন্য দাঁড়াইয়াছেন। ...কবি তখন তাঁর সুটকেস হইতে এক বান্ডিল কাগজ বাহির করিয়া আমার হাতে দিয়া বলিলেন, ‘এই দেখ, পীর বাদশা মিয়া আমাকে সমর্থন দিয়া ফতোয়া দিয়েছেন।
পূর্ববঙ্গের এত বড় বিখ্যাত পীর যা বলবেন, মুসলিম সমাজ তা মাথা নত করে মেনে নেবে। জসীম, তুমি ভেবো না। নিশ্চয় সবাই আমাকে ভোট দেবে। ঢাকায় আমি শতকরা নিরানব্বইটি ভোট পাব। তোমাদের ফরিদপুরের ভোট যদি কিছু আমি পাই তা হলেই কেল্লাফতে। ফরিদপুরে ভোটের সহযোগিতা চাইতে গেলে তমিজউদ্দিন খানের সমর্থকদের মধ্য থেকেই সেদিন কবি নজরুলকে ‘কাফের’ আখ্যা দেয়া হয়েছিল। নিরাশ না হয়ে কবি বরং তাদের কবিতা শোনার আহ্বান করেন। তার স্বকণ্ঠে ‘মহররম’ কবিতা শুনে কবির সমালোচনাকারীদের চোখে অশ্রুধারা নেমে এল, কিন্তু ভোটের প্রতিশ্রুতি মিলল না। কবি জসীমউদ্দীন লিখেছেন-
আমরা দুইজনে উঠিয়া ফরিদপুর মৌলবী তমিজউদ্দীন খানের বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলাম। তমিজ উদ্দীন সাহেব আইনসভার নিম্ন পরিষদের সভ্যপদের প্রার্থী ছিলেন। তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী ফরিদপুরের তরুণ জমিদার বন্ধুবর লালমিঞা সাহেব। আমরা লালমিয়া সাহেবের সমর্থক ছিলাম। ...কবিকে দেখিয়া তাঁহারা সবাই আশ্চর্য হইয়া গেলেন। কবি যখন তাঁহার ভোট অভিযানের কথা বলিলেন, তখন তমিজউদ্দীন সাহেবের একজন সভাসদ বলিয়া উঠিলেন, ‘তুমি তো কাফের। তোমাকে কোন মুসলমান ভোট দিবে না।’
…তিনি হাসিয়া বলিলেন, ‘আপনারা আমাকে কাফের বলছেন, এর চেয়েও কঠিন কথা আমাকে শুনতে হয়। আমার গায়ের চামড়া এত পুরু যে, আপনাদের তীক্ষ্ন কথার বাণ তা ভেদ করতে পারে না। তবে আমি বড়ই সুখী হব, আপনারা যদি আমার রচিত দু-একটি কবিতা শোনেন।’
কবিকে তখন সবাই ঘিরিয়া বসিলেন। কবি আবৃত্তি করিয়া চলিলেন। কবি যখন তাঁহার ‘মহররম’ কবিতাটি আবৃত্তি করিলেন, তখন যে ভদ্রলোকটি কবিকে কাফের বলিয়াছিলেন তাঁরই চোখে সকলের আগে অশ্রুধারা দেখা দিল।
তমিজউদ্দিন খান তখন ভারতবর্ষের মুসলমান নেতৃত্বের মধ্যে স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব এবং ফরিদপুরের রাজনৈতিক অঙ্গনের একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন মধ্যাহ্নে নিজের বাড়ি থেকে কবি নজরুলকে অভুক্ত রেখে তাঁর প্রতি যে বিরূপ আচরণ করেছিলেন, তাকে কোনোভাবেই শিষ্টাচারসম্মত বলে স্বীকার করা যায় না। কবি জসীমউদ্দীনের বর্ণনায় সেই মর্মবাণীই প্রতিধ্বণিত হয়েছে-
আমি কবির কানে কানে বলিলাম, ‘এইবার আপনার ইলেকশানের কথা ওঁদের বলুন।’
কিন্তু কে কাহার কথা শোনে! কবি আবৃত্তি করিয়াই চলিয়াছেন। তখন আমি সবাইকে শুনাইয়া বলিলাম, ‘আপনারা কবির কবিতা শুনছেন- এ অতি উত্তম কথা। কিন্তু কবি একটি বড় কাজে এখানে এসেছেন। আসন্ন ভোট-সংগ্রামে কবি আপনাদের সমর্থন আশা করেন। এই বিষয়ে কিছু আলোচনা করুন।’
তমিজউদ্দীন সাহেব চালাক লোক। ...কবিকে তিনি আড়ালে ডাকিয়া লইয়া গেলেন। পাঁচ-ছয় মিনিট পরে হাসি মুখেই...আসিয়া কবি আবার পূর্ববৎ কবিতা আবৃত্তি করিয়া চলিলেন।...
তাঁহাদের ভিতর হইতে একটি লোকও বলিল না, এত বেলায় আপনি কোথায় যাইবেন, আমাদের এখান হইতে খাইয়া যান। আমার নিজের জেলা ফরিদপুরের এই কলঙ্ক-কথা বলিতে লজ্জায় আমার মাথা নত হইয়া পড়িতেছে। কিন্তু এ কথা না বলিলে, সেই যুগে আমাদের সমাজ এত বড় একজন কবিকে কি ভাবে অবহেলা করিতেন, তাহা জানা যাইবে না।
জসীমউদ্দীন রাগে দুঃখে অপমানে অভিমানে ফরিদপুর শহরে খাবার হোটেলের খোঁজে বের হন, সেই মাছি ভন ভন, তেলচিটচিটে বালিশ নির্গত পূতিগন্ধময় পরিবেশ অতিক্রম করে অবশেষে কবিকে নিয়ে বাড়ন্ত বেলায় মধ্যাহ্ন আহারপর্ব সমাধা করেন।
কবি নজরুল প্রবন্ধে জসিমউদ্দীন লিখেছেন সেই মর্মন্তুদ এবং করুণ কথা-
‘পথে আসিতে আসিতে কবিকে জিজ্ঞাসা করিলাম,
তমিজউদ্দীন সাহেবের দল আমাদের সমর্থন করবেন। এবার তবে কেল্লাফতে!’
কবি উত্তর করিলেন, ‘না হে, ওঁরা বাইরে ডেকে নিয়ে আগেই আমাকে বলে দিয়েছেন, আমাকে সমর্থন দিবেন না। ওঁরা সমর্থন করিবেন বরিশালের ইসমাইল সাহেবকে।’ তখন আমার রাগে দুঃখে কাঁদিতে ইচ্ছা হইতেছিল। রাগ করিয়াই কবিকে বলিলাম, ‘আচ্ছা কবিভাই! এই যদি আপনি জানিলেন, তবে ওঁদের কবিতা শুনিয়ে সারাটা দিন নষ্ট করলেন কেন?’
কবি হাসিয়া কহিলেন, ‘ওঁরা শুনতে চাইলে, শুনিয়ে দিলুম।’
এ কথার আর কী উত্তর দিব? কবিকে লইয়া হোটেলের সন্ধানে বাহির হইলাম। তখনকার দিনে ফরিদপুরে ভালো হোটেল ছিল না। যে হোটেলে যাই, দেখি মাছি ভন ভন করিতেছে। ময়লা বিছানা-বালিশ হইতে নোংরা গন্ধ বাহির হইতেছে।তারই মধ্যে অপেক্ষাকৃত একটি পরিষ্কার হোটেল বাছিয়া লইয়া কোনো রকম ভোজনপর্ব সমাধা করিলাম।
তমিজউদ্দিন খান বা তার কিছু অনুসারীই শুধু নয়, তখনকার দিনে মুসলমান সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী কিছু সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র নজরুলের বিরোধিতায় একেবারে মুখর হয়ে উঠেছিল। মুসলিম মাশায়েখ সমাজের সমর্থন ছাপিয়ে এসব প্রতিক্রিয়াশীলের বহুমুখী প্রচারণায় কবি ফরিদপুরে এসে বুঝতে পারলেন ভোটযুদ্ধে তার অবস্থান কোথায়? ভেবেচিন্তে কবি অবশেষে জামানতের টাকা রক্ষার তাগিদে ঢাকার দিকে চলে যান। জসিমউদ্দীন লিখেছেন-
প্রথম ভোটের দিন কবিকে ভোট গ্রাহক অফিসারের সামনে বসাইয়া দিলাম। কবির সামনে গিয়া ভোটাররা ভোট দিবেন। ...পরদিন সকালে....কবি আমাকে বলিলেন, “দেখ জসীম, ভেবে দেখেছি, এই ভোটযুদ্ধে আমার জয় হবে না। আমি ঢাকা চলে যাই। দেখি, অন্ততপক্ষে জামানতের টাকাটা যাতে মারা না যায়।
ভারতীয় আইন পরিষদের ১৯২৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী তমিজ উদ্দিন খান প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। ফরিদপুরের সেবারের নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে লিখলেও কবি নজরুলের প্রসঙ্গে তিনি কিছুই উল্লেখ করেননি-
১৯২৬-এর শেষে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের নির্বাচন...আমি দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে লাল মিঞা খান সাহেব চৌধুরী মইনুদ্দীনের ছেলে। ...রিটার্নিং অফিসার বললেন লাল মিঞার বয়স পঁচিশ হয়নি। স্কুলের রেজিস্টার দেখে তিনি এ কথা বললেন। কিন্তু তাঁর বাবার সুপারিশে এ বাধা দূর হলো।...নব্বইভাগ মানুষ ছিল কৃষক। তারা জমিদারদের ঘৃণা করত। জমিদারবিরোধী আন্দোলনে আমি সব সময় কৃষকদের পক্ষে ছিলাম।...কংগ্রেস-খিলাফত করে এবং হাজতবাস করায় আমার সুনাম হয়েছিল। মুসলমান সম্প্রদায় খুশি ছিল...আমার সমর্থকরা আমার শিক্ষাগত যোগ্যতাকে ফলাও করে দেখাল। লাল মিঞার এ ব্যাপারে ঘাটতি ছিল, যদিও তিনি ছিলেন তীক্ষ্ন বুদ্ধিমান, ভদ্র এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি। বক্তা হিসেবেও ছিলেন খুব জোরালো।
দুই কারণে তিনি জনপ্রিয়তা হারালেন। প্রথমত, তিনি প্রভাবশালী জমিদার। দ্বিতীয়ত, তখনও তিনি হিন্দু-প্রভাবিত কংগ্রেসে রয়ে গিয়েছিলেন। তার সব প্রজা গোপনে আমাকে ভোট দিল।…
নির্বাচনী প্রচারণার কাজ শেষে কবি ২৩ নভেম্বর কৃষ্ণনগর চলে যান, ২৯ নভেম্বর ফলাফল প্রকাশিত হয়। ফলে দেখা যায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী বরিশালের জমিদার মুহম্মদ ইসমাইল চৌধুরী বিজয়ী হন। নিম্ন আইন পরিষদে জয়লাভ করেন তমিজউদ্দিন খান।
লেখক: গবেষক, সাংবাদিক