কাজী নজরুল ইসলাম শুধুই বিদ্রোহী কবি, নাকি প্রেমের কবি? কিংবা সাম্যবাদ ভাবধারার? নানা সংকট। আসলে নজরুলকে নিয়ে বাঙালির কোনো কোনো বিচ্ছিন্ন অংশের একটা মহাসংকট হলো নজরুলের আত্মপরিচয় বা আইডেন্টিটি নিয়ে। এসব নানা সংকট ও প্রশ্নে নজরুলকে ক্লান্ত হতে হয়েছে। যদিও অধিকাংশ বাঙালি নজরুল কোন ধর্মের সদস্য, তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তার বিকাশ ও পরিপক্বতার কালে হিন্দু না মুসলিম অথবা অহিন্দু বা অমুসলিম তা অনেকাংশেই ফিকে হয়ে গিয়েছিল। অন্নদাশঙ্কর রায় স্পষ্টতই বলেছিলেন, ‘ভাগ হয়ে গেছে বিলকুল ভাগ হয়নিকো নজরুল’।
১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর নজরুল তার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যা বলেছিলেন আচার্য প্রফুল্ল রায়ের সভাপতিত্বে ‘আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তপগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই আমি জন্ম গ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি।’ কবি সভাপতির ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলেন।
সভাপতি বলেছিলেন, ‘নজরুল কবি, প্রতিভাবান মৌলিক কবি। আজ এই ভেবে বিপুল আনন্দ অনুভব করছি যে, নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমানের কবি নন, তিনি বাংলার কবি বাঙ্গালির কবি।’ সভাপতির এ ধরনের বক্তব্যের উত্তরে সেদিন সমগ্র বাঙালির আয়োজনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্টজনের সামনে নজরুলের আত্মপরিচয় নিজেই উপস্থাপন করেন প্রায় ৯২ বছর আগে। তার পরও গোঁড়া অনেক মুসলিম তাকে কাফের, সনাতনি হিন্দু ভণ্ড, সাধুরা পাতিনেড়ে বলে আজও বিদ্রূপ করে থাকে।
গোলাম মুরশিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শুধু কি তাই, গান্ধীবাদী অহিংস আন্দোলনের সমর্থকরা তাঁকে বিপ্লবী বলে বিবেচনা করে, কারণ তাদের মতে, ভায়লেন্সের বাঁশি বাজান, কিন্তু বিপ্লবীরা তাঁকে তাই বলে তাদের লোক বলে গণ্য করে না। বরং সন্দেহ করে গান্ধীবাদী বলে।’ তাদের যুক্তি হলো তিনি গান্ধীবাদী না হলে চরকার গান গাইবেন কেন। কেবল ধর্ম এবং রাজনীতির মতো আবেগপ্রবণ এলাকার নয়, অন্যান্য কারণেও তাকে ভুল বোঝা হয়। যেমন পুরুষরা তাকে নারীঘেঁষা বলে গাল দেয়, তা সত্ত্বেও নারীরা তাকে অবলাবান্ধব বলে প্রশংসা করে না, বরং নারীবিদ্বেষী বলেই শনাক্ত করে।
তারপরও নজরুল জনমানুষের এত ভালোবাসা পেয়েছিলেন যে, গোলাম মুরশিদ এ প্রসঙ্গে আরও বলেন-
‘স্বয়ং নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথও জনগণের হৃদয়ের এত কাছে আসতে পেরেছিলেন কি না সন্দেহ করি।’
কিন্তু জনপ্রিয়তার পাশাপাশি বিতর্কও তিনি কম সৃষ্টি করেননি। নজরুল যে একজন বিতর্কিত ব্যক্তি, সে সম্পর্কে নিজেও পুরোপুরি জ্ঞাত ছিলেন কি না ভাবনা হয়।
নজরুলের পরিচয় মুখ্যত বিদ্রোহী কবি রূপে। অধ্যাপক প্রীতি কুমার মিত্র তার ‘দ্য ডিসেন্ট অব নজরুল ইসলাম: পোয়েট্রি অ্যান্ড হিস্ট্রিতে পাঁচ ধরনের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে বিদ্রাহ ব্যক্ত করেছেন- ১. ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে, ২. ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতিতে গান্ধীবাদী আদর্শের বিরুদ্ধে, ৩. ইসলামি রক্ষণশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, ৪. হিন্দু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে এবং ৫. রবীন্দ্র নামধারী সমকালীন সাহিত্যিক আদর্শের বিরুদ্ধে।
সমকালীন রক্ষণশীল ধর্ম, সমাজ ও রাজনৈতিক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে নজরুল বিদ্রোহী। কিন্তু নজরুলের বিবেচনায় সর্বাগ্রে ছিল সমাজের সকল স্তরের নিপীড়িত মানুষ ও মানবপ্রেম। নজরুলের শৈশব কৈশোর বা পরিপক্ব নজরুল হিসেবে বেড়ে ওঠার কালে নজরুল-সম্পর্কিত লেখাগুলোর অনেকটাই অতিকথন বা কিংবদন্তিতুল্য। নজরুল যে পরিবারে জন্মেছিলেন, সে পরিবার ছিল ধর্মভীরু, অর্ধশিক্ষিত, হতদরিদ্র রক্ষণশীল মুসলিম পরিবার। এমন একটা অজপাড়াগাঁয়ের সন্তানের জন্য সাহিত্যচর্চা ছিল দুরূহ, এমনকি মুসলিম পরিচয়েও এ কথা ভাবা বৃথা। তার পরিবার ফারসি ভাষায় পারঙ্গম এটিও অতিকথন ছাড়া আর কী?
পারিবারিক পরিমণ্ডল নয়, বরং সাহিত্য ও সংস্কৃতিসেবা অন্য কোনো আবহ থেকে তিনি পেয়েছিলেন। অল্প বয়সেই নজরুল পিতৃহীন হন। অভাব অনটন ছন্নছাড়া বাঁধনহারা বিচিত্র স্বপ্ন ও বিচিত্র পরিবেশে নানা অভিজ্ঞতায় নজরুল বড় হন। মক্তব-মসজিদের মোয়াজ্জিন-ইমামতি-খাদেমের কাজ ছেড়ে লেটো দলে যোগদান, একেবারেই উল্টো পথ। দুটোর পরিমাণগত বা স্থানিক দূরত্ব যা-ই হোক, আদর্শিক পরিসীমা কত যোজন যোজন দূর, তা ভাবনার বিষয় বটে। এরপর রুটির দোকান। দারোগার গৃহভৃত্য। স্কুল পালানো আনুষ্ঠানিক কোনো কাজে মন না বসা,
দুরন্তপনা লক্ষ্যহীন জীবনের তীর্থযাত্রা, কোনখানে নেই নজরুলের অবস্থান! তারপরও দুস্তর প্রান্তর, বটের ছায়া কিংবা সুরেলা বাঁশি, একান্ত আপন ঠিকানা ছিল নজরুলের।
রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘যে আছে মাটির কাছাকাছি কবি।’ নজরুল নিম্নবর্গের মানুষের নয়নমণি। তিনি যে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠছিলেন এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়। পরিপূর্ণ মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনা থাকে, নজরুল অন্তত সেভাবেই বেশ সচেতনতার সঙ্গে বেড়ে ওঠেন।
প্রথম মহাযুদ্ধ, রুশ বিপ্লব নজরুলকে দারুণভাবে আন্দোলিত করে এবং প্রভাবিত হন অভূতপূর্বভাবে। তবে সেনাবাহিনীতে যোগদান, ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে নজরুলের অবস্থান স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের মহাপ্রতীক বলে মনে করা হয়। কারণ সে সময় তিরিশ টাকা বেতন, এমন সুখের সাদ নজরুল কখনোই পাননি। সাটেল কর্কের মতো এদিক সেদিক ছুটে বেড়িয়েছেন, কিন্তু সেনাজীবনেই একটু স্থির হলেন। পিটি, প্যারেড, চানমারি প্রভৃতি সেনা প্রশিক্ষণের মধ্যে গানবাজনা এবং লেখাপড়ার বাস্তব দিক যে করাচিতে বসে হলো সেটি হলফ করে বলতে পারি।
ফারসি ভাষা সামান্য শিখলেও এ সেনা পল্টনে পাঞ্জাবি মৌলভির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে নজরুল ফারসি ভাষা রপ্ত করেন। কলকাতা, ঢাকার সমসাময়িক পত্রিকার গ্রাহক হন নজরুল। পড়ে ফেলেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎ, মধুসূদন এবং বঙ্কিম-এর লেখাগুলো। ফারসি ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি ফারসি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হন নজরুল সেনাজীবনেই। লেখা পাঠাতে শুরু করেন ঢাকার পত্রিকায়। আবার হাবিলদার পদেও পদোন্নতি ঘটে। আড়াই বছরেই তার বাহিনী উঠে যায়। আবারও এক অনিশ্চিত জীবনের পথে নজরুল। দেশে ফেরা, কমরেড মুজফ্ফর আহমদের মতো বন্ধুদের সাহচার্যে কখনও স্থির কখনও অস্থির জীবনে নজরুল। রাজনীতি, সাহিত্যচর্চা, ইংরেজবিরোধী আন্দোলন এবং অনন্ত প্রেমিক হয়ে ওঠেন নজরুল। জীবনের নানা বৈতরণি, কোনো দিককেই আমরা ছোট করে দেখতে পারি না।
বাংলা সাহিত্যের আকাশে নজরুল ধূমকেতু হিসেবে আবির্ভূত হলেন। নজরুলের অগ্নিবীণার প্রলয়শিখা তাকে বিপ্লবী করে তুলল। আবার প্রেমিক করতেও ছাড়েনি। অতিমাত্রা হলে যা হয়, ইংরেজদের কারাগারেও থাকতে হলো আবার প্রেমে ও বিরহের বলিচিত্র ফুটে উঠল তার ললাটে। যুদ্ধফেরত নজরুলের জীবনে কমরেড মুজফ্ফর আহমদ এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। অসাধারণ এ ব্যক্তি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ভাবশিষ্য। মুজফ্ফর আহমদের স্বাধীনচেতা, মানবদরদি এবং অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী ভাবধারায় নজরুল অনেকাংশে উদ্বুদ্ধ হন। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার অফিসে একসঙ্গে থাকতে গিয়ে এ ঘনিষ্ঠতা আরও বৃদ্ধি পায়।
অসংখ্য বন্ধু জুটিয়ে ফেলেন তিনি; যারা সাহিত্যমোদি, জাতীয়তাবাদী এবং স্বাধীনতাকামী। নজরুল হিন্দু-মুসলিম ভেদরেখা মুছে দেন তার শিল্প-সাহিত্যর ভালোবাসা এবং অসাম্প্রদায়িক হৃদয়বৃত্তি দিয়ে। যা হোক, মোসলেম ভারত পত্রিকায় লিখে সামান্য রোজগার করতেন। মুজফ্ফর আহমদের কল্যাণে ফজলুল হকের নবযুগে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা তার মানস গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। রাতারাতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যান নজরুল। গরম গরম লিখে ইংরেজদের রোষানলে পড়েন। তারপর নবযুগের চাকরি হারিয়ে ভেসে বেড়ানো নজরুল, কখনও কুমিল্লা, কখনও দৌলতপুর। কলকাতার সাহিত্যবৃত্ত থেকে ছিটকে পড়া নজরুলকে আবারও কুমিল্লা দেওঘর থেকে উদ্ধার করে কলকাতায় ফিরিয়ে আনেন মুজফ্ফর আহমদ ১৯২১ সালের জুলাইয়ের দিকে।
অসাম্প্রদায়িক, প্রেমিক মন একই সঙ্গে মানুষের সঙ্গে মুহূর্তে মিশে যাওয়ার শক্তি ছিল নজরুলের। পান খেয়ে গান গেয়ে জীবন কাটলেও নজরুল ছিলেন সুদর্শন।
দৌলতপুরে এক বালিকার প্রেমে পড়েন। নিজেই নামকরণ করেন নার্গিস। প্রেমের তিন মাসেই বিয়ে, আবার বিয়ের রাতেই পালিয়ে যেতে হয় অজ্ঞাত কোনো কারণে। বন্ধু ইন্দ্রনাথ গুপ্তের বাড়িতে আশ্রয় নেন। কুমিল্লার এ বাড়ি নজরুলের অচেনা নয়। গৃহকর্ত্রী বিরজা সুন্দরী দেবীর কাছে যে অপরিসীম আদর স্নেহ পেয়েছিলেন, যাকে ‘মা’ বলে ডাকতেও নজরুল দ্বিধা করেননি। এ পরিবারের কিশোরী কন্যা আশালতার (ডাকনাম দুলি) প্রেমে পড়েন। নজরুল নতুন নামে ডাকেন প্রমীলা।
গোলাম মুরশিদ উল্লেখ করেন, বিয়ের আগে প্রমীলাকে পার হতে হয়েছিল দুস্তর সমুদ্র। প্রথমেই ছাড়তে হয়েছিল আপনজন আশ্রয়দাতা পরিজনকে। সমাজ থেকেও প্রবল বাধা এসেছিল। ধর্মমতে, হিন্দু মুসলমানের বিয়ে হয় না। তখনকার একাধিক রাজনীতিক এ বিয়ের সমর্থন জানান। আইনেরও বাধা ছিল। কারণ প্রমীলা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হননি এবং তার বয়স ছিল ষোল বছরের সপ্তাহ দুয়েক কম। ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে হয়তো প্রমীলার মা গিরিবালা চাননি কিংবা নজরুলও আমল দেননি।
নজরুল ও তার বন্ধুর মুসলমান-অধ্যুষিত কোনো এক বাড়িতে ইসলামি রীতি অনুযায়ী আইনকে পিছে ফেলে বিয়ে সম্পন্ন করেন। নজরুলের অধিকাংশ বন্ধুই ছিলেন হিন্দু কিন্তু এ বিয়েতে একজনও উপস্থিত ছিলেন না। এমনকি পুত্রজ্ঞানে স্নেহকাতর বিরজা সুন্দরী দেবীও এ বিয়ে সমর্থন করেননি। বিয়ের সতেরো সপ্তাহের পরেই নজরুল-প্রমীলার ঘরে এল পুত্রসন্তান। নজরুল নাম রাখেন কৃষ্ণ মুহম্মদ ওরফে আজাদ কামাল। মাত্র চার মাস বয়সে তার মৃত্যু হয়। এর দুই বছর পরে হয় তাদের আর একটি সন্তান অরিন্দম খালেদ বুলবুল। মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে দারুণ কষ্ট পেয়ে বসন্ত রোগে মারা যায়। মুজফ্ফর আহমদের বর্ণনায় নজরুল পুত্রশোকে যে আঘাত পান তা আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি। যা তার নানা কবিতা ও গানে ব্যক্ত করেন নজরুল।
পরবর্তীকালে সব্যসাচী (সানি) ও অনিরুদ্ধ (নিনি) এ দুটো সন্তান নজরুল-প্রমীলার সুখ-দুঃখের সাথি হিসেবে বেড়ে ওঠেন। নজরুলের বাইরে জগৎ ছিল, কল্পনাবিলাসী ভুবন ছিল, ছিল কবিতা ও গানের মহাপৃথিবী। প্রমীলার অন্তর্লোক থাকলেও বাইরের জগৎ ছিল না। ছিল না সামাজিক জগৎ। ১৯২৯-৩০ সালের দিকে নজরুল গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য গান লেখা, সুর করা, গায়ক-গায়িকাদের শেখানো বাবদ প্রচুর টাকা পেতেন। বেতার ও মঞ্চের সঙ্গেও যোগাযোগ গড়ে ওঠে। গাড়ি কেনা, বাড়িতে নেপালি দারোয়ান। তার পরও স্বাচ্ছন্দ্য আসেনি পরিবারে। মুজফ্ফর আহমদ বলেছেন, ১৯৪০-এর আগেই আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যান নজরুল। প্রমীলার দীর্ঘমেয়াদি রোগ। চিকিৎসা, টোটকা, যোগ, পূজা ও নামাজের আশ্রয় নিয়ে প্রমীলা সুস্থ হননি। দুর্ভাগ্য থেকেই গেছে। আবার ১৯৪২ সালের শুরুর দিকেই নজরুল অপ্রকৃতস্থ উন্মাদে পরিণত হলেন। ক্রমেই বাকরুদ্ধ হন। গিরিবালা দেবী টানা চার বছর পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রমীলা এবং বাকরুদ্ধ নজরুলসহ দুই কিশোর পুত্রকে নিয়ে যে নিদারুণ দুঃসময় পার করেছেন তা বর্ণনাতীত।
১৯৬২ সালের ৩০ জুন প্রমীলা মৃত্যুবরণ করেন। চুরুলিয়ায় নজরুলের পৈতৃক বাড়িতে তাকে সমাহিত করা হয়। এরপর আরও ২৪ বছর নজরুল জড়বৃক্ষের মতো বাকরুদ্ধ অবস্থায় ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ইহলোক ত্যাগ করেন। সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে।
কাজী নজরুল ইসলাম লালন সাঁইজিকে কতটুকু গ্রহণ করতে পেরেছিলেন জানি না। তবে রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যদর্শনে লালনকে অতিমাত্রায় লালন করেছিলেন। তারপরও নজরুল চণ্ডীদাসের বিখ্যাত উক্তি: ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’- এ দর্শনের সমর্থক। ভারতীয় উপমহাদেশে তিন প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল (১৮৭৩-১৯৩৮) এবং কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)।
নজরুল বাদে অপর দুজনই উচ্চ ও অভিজাত শ্রেণিভুক্ত। ইকবালের পূর্বপুরুষ কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইকবাল মুসলিম চিন্তাবিদ, কবি এবং কালের অন্যতম ইসলামি দার্শনিক। আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় দর্শনশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত, গবেষক এবং অধ্যাপক। রাবীন্দ্রনাথের আনুষ্ঠানিক সার্টিফিকেট না থাকলেও ছিল ব্রাহ্মণ আভিজাত্য। স্বশিক্ষায় শিক্ষিত ও তার পারিবারিক বলয় ছিল শীর্ষস্থানীয়। আর নজরুল খেটে খাওয়া নিরন্ন দুখী মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তিন প্রধান কবিকে সাতচল্লিশের দেশ বিভাজনে রাজনৈতিক ইতিহাসের কাঠগড়ায় তেমনভাবে দাঁড়াতে হয়নি। দায়ী বা দেশভাগের কাঠগড়ায় আসামিও নন তারা। আল্লামা ইকবাল ১৯৩৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন, রবীন্দ্রনাথ ১৯৪১ সালে না ফেরার দেশে যাত্রা করেন এবং ১৯৪২ থেকে নির্বাক জীবন্মৃত অবস্থায় নজরুল ১৯৭৬ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন। তারপরও রবীন্দ্রনাথ ও ইকবাল নিজ নিজ ধর্মীয় বেষ্টনী ও সম্প্রদায়ের বাইরে যেতে পারেননি। যা নজরুল নিমেষেই অতিক্রম করেছেন। বেদ, পুরাণ, গীতা, মহাভারত, আল কোরআন, ত্রিপিটক, বাইবেল, গ্রন্থসাহেব কোনো ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মের অনুসারীদের খাটো করে দেখেননি। এখানেই নজরুল ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব। নানা ঘাটে ঘাটে নানা শাখায় বিচরিত নজরুল মহাসমুদ্রসম নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষকে নিয়েই আরাধনা করে গেছেন, তাই তো তিনি অনন্য অসাধারণ নজরুল।
লেখক: প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ