“বিপ্লব সৃষ্টি করে বুদ্ধিজীবীরা, তবে সব বুদ্ধিজীবীই বিপ্লবী নন। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা যদি তাদের চিন্তা বোঝাতে পারেন, পৌঁছাতে পারেন সাধারণ মানুষের কাছে, যদি বোঝাতে পারেন কিসে তাদের ভালো বা কী-ইবা তাদের ধ্বংস করে দেবে- তাহলে বুদ্ধিজীবীরা সাধারণ মানুষকে মবিলাইজ করতে পারবেন।” -মার্কিন সাংবাদিক থিয়োডর এইচ হোয়াইট
একজন বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব জাতির মানস গঠনের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। মুনতাসীর মামুন সেই কাজটি করেছেন লেখালেখি, আন্দোলন-সংগ্রাম ও সংগঠন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। তার চিন্তা ও কর্মের পরিধি ব্যাপক। তিনি শুধু ইতিহাস ও সাহিত্যচর্চা তথা গ্রন্থ রচনার মধ্যে কর্মপরিধি সীমাবদ্ধ রাখেননি। অধ্যাপনা ও গবেষণার পাশাপাশি সংগঠন গড়ে তুলেছেন, দেশের নানা বিদ্বৎকাজে সম্পৃক্ত হয়েছেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বাংলাদেশের প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। তার সম্পাদনায় ডাকসুর মুখপত্র হিসেবে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে পাক্ষিক ছাত্রবার্তা। একই সময়ে ছিলেন সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি।
বাংলাদেশ লেখক শিবির ও বাংলাদেশ লেখক ইউনিয়নের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম যুগ্ম সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেই স্থাপন করেছিলেন ইতিহাসচর্চা কেন্দ্র। এ ছাড়াও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর, ঢাকা নগর জাদুঘর, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর বেঙ্গল স্টাডিজ (আইবিএস), বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অসাম্প্রদায়িক গণমুখী ইতিহাসচর্চার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী। তার নেতৃত্বে এই সংগঠনের উদ্যোগে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পর্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করা হয়। খুলনায় তিনি গড়ে তুলেছেন ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ নামে বাংলাদেশর প্রথম গণহত্যা জাদুঘর। দেশের বাইরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের চোত্তাখোলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত উদ্যান স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন একটি কথা সব সময় বলেন, ‘পথে না নামলে দাবি আদায় হয় না।’ এই বিশ্বাস থেকেই তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি সারাটা জীবন রাজপথে কাটিয়েছেন। দাবি আদায়ের জন্য লেখালেখি, সংগঠন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আদালতেরও দ্বারস্থ হয়েছেন বহুবার। অধ্যাপক মামুন লেখালেখি, সভা-সমিতি, সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘ কর্মময় জীবনে যে শক্ত ভিত তৈরি করেছেন, সে ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আজ অনেকে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি এমন একজন শিক্ষক যিনি ক্লাসরুমে শিক্ষকতার পাশাপাশি ইতিহাসকে ক্লাসরুমের বাইরে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছেন। উদারনৈতিক সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে তিনি রাজনৈতিক ভাষ্যে এবং মৌলবাদ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে রাজপথের লড়াইয়ের অগ্রণী সংগ্রামী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহসভাপতি হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরু হলে অনেকে যখন ভয়ে সাক্ষী দিতে রাজি হননি, তখন তিনি এগিয়ে এসেছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে তিনি ছিলেন প্রথম সাক্ষী।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হলে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা দখলের হুমকি দেয়। নির্মূল কমিটির আহ্বানে সারা দেশে হরতাল চলাকালে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা অবরোধ করে। ঢাকায় প্রবেশের পথে হেফাজতের কয়েক হাজার কর্মী মহাখালীতে নির্মূল কমিটির সমাবেশে আক্রমণ করে সভাস্থল চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। চাচা মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও মুনতাসীর মামুন রাস্তায় পিকেটিং করেছেন। কারণ, তখন তার কাছে হেফাজতের তাণ্ডব থামানো জরুরি মনে হয়েছে। তারপরও হেফাজতের তাণ্ডব থামানো সম্ভব হয়নি। পুলিশ বা আমরা অনেক চেষ্টা করেও তাকে সভাস্থল থেকে সরাতে পারিনি। শুধু বললেন, ‘দাবি আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে এই রাজপথেই একদিন আমার পাশেরজন গুলি খেয়ে মারা গেছেন। সেদিন আমিও মারা যেতে পারতাম। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’ তার এই অবিচল অবস্থান দেখে যেমন অবাক হয়েছি, তেমনি তার প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পেয়েছে হাজার গুণ। অনেকের মতো তিনি শুধু এসি রুমে বসে বক্তৃতা করে বা ক্লাস নিয়ে দায়িত্ব শেষ করেননি, বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে রাজপথে থেকে দাবি আদায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমাজে জাগরূক রাখতে তিনি সদা জাগ্রত থেকে জনস্বার্থে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পেছনে ভুয়া মাজার সরানোর জন্য তিনি রিট করেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী কারও নামে স্থাপনা না হওয়ার জন্য রিট করেন এবং রিট করেন বধ্যভূমি ও গণহত্যার স্থল সংরক্ষণের জন্য। এর প্রত্যেকটির পক্ষে তিনি রুল পেয়েছেন। যে কারণে খুলনার শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী খান এ সবুরের নামের সড়ক তার পূর্বতন নাম ‘যশোর রোড’ ফিরে পেয়েছে।
তিনি পত্রিকার প্রথম পাতায় কলাম লিখে জনসমাজের সামনে তুলে ধরেন গোলাপ শাহ মাজার সত্যিকার অর্থে কোনো মাজার নয়। তার এই সাহসী পদক্ষেপ জনসমাজের অন্ধত্ব দূর করতে সহায়তা করে। এ ছাড়াও ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সন্ত্রাসীদের হামলার প্রতিবাদ করায় মিথ্যা মামলায় মুনতাসীর মামুনকে কারাবরণও করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি রাজপথ থেকে ভয় পেয়ে সরে আসেননি।
মুনতাসীর মামুনের সবচেয়ে প্রিয় জগৎ হলো বই আর লেখালেখি। ছোটবেলা থেকেই তার বইয়ের প্রতি ভালোবাসা। স্কুলে পড়ার সময় ঢাকা ও চট্টগ্রামের পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হয়। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানে বাংলা ভাষায় সেরা শিশু লেখক হিসেবে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে আহমদ ছফা ও সত্যেন সেনের উদ্যোগে কালি-কলম প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গ্রন্থ গল্প বলি।
মুনতাসীর মামুন যেমন লেখালেখি করেছেন, তেমনি আন্দোলন সংগ্রামে থেকেছেন সক্রিয়। আহমদ ছফার সম্পাদনায় বাংলা ১৩৭৬ সনের ফাল্গুন মাসে ‘স্বদেশ প্রকাশনী’ থেকে মাসিক সাহিত্যপত্র স্বদেশ প্রকাশিত হয়। এর সহযোগী সম্পাদক ছিলেন মুনতাসীর মামুনসহ তিনজন। স্বদেশ-এর তিন সংখ্যা বের হওয়ার পর বাংলাদেশ আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। এই সময়ে আহমদ ছফা ঠিক করলেন বাংলাদেশ আন্দোলন জোরদার করার জন্য লেখক শিল্পীদের একত্র করতে হবে। আহমদ ছফার তোপখানা রোডের বাসায় একটি সভায় গঠিত হলো ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’। আহমদ ছফা উদ্যোগ নিলেন নিয়মিত একটি বুলেটিন প্রকাশের। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন মুনতাসীর মামুন, মুহম্মদ নুরুল হুদা, রফিক নওশাদ, সাযযাদ কাদির। বুলেটিনের নাম রাখা হয় ‘প্রতিরোধ’।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বুলেটিনের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। কাপ্তানবাজারের কাছে বিসিসি রোডের এক ছাপাখানায় ছাপা হতো প্রতিরোধ। মুনতাসীর মামুনসহ কয়েকজন মিলে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার আগে হাতে হাতে প্রতিরোধ বিক্রি করেন। শাহরিয়ার কবির, বেবী মওদুদ, বেনজির আহমদ, মুনতাসীর মামুনসহ কয়েকজন মিলে রানার নামে একটি সাপ্তাহিকও বের করতেন।
স্বাধীনতার পর আহমদ ছফা লেখক সংগ্রাম শিবিরের ধারাবাহিকতায় ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’ গঠন করেন। এটি ছিল স্বাধীনতা লাভের পর লেখকদের প্রথম সংগঠন। মুনতাসীর মামুন ও মুহম্মদ নুরুল হুদা আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। তবে সংগঠনের মূল চালিকা শক্তি ছিলেন আহমদ ছফা। ক্রমেই তিনি আহমদ শরীফ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রমুখ প্রগতিশীল লেখককে এই শিবিরে নিয়ে আসেন। লেখক শিবির লেখকদের মোটামুটি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়।
এই সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধের তিনটি সংকলন প্রকাশের কথা আহমদ ছফা বাংলা একাডেমির পরিচালক কবির চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনা করেন। তিনটি সংকলনের নাম হবে হে স্বদেশ। গল্প সম্পাদনের জন্য সম্পাদক ছিলেন মুনতাসীর মামুন ও মুহম্মদ নুরুল হুদা। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংকলন হে স্বদেশই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলা ১৩৭৮ সনে ২১টি গল্পের সংকলন ছিল বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হে স্বদেশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে মুনতাসীর মামুন বিচিত্রায় সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হন। তখন তিনি ছোটগল্প রচনায় নিমগ্ন ছিলেন। এরপর তিনি গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর পরই প্রবন্ধ ও গবেষণায় নিবিষ্ট হয়ে পড়েন। অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনার জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে একাত্ম। গবেষণার বিষয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিকে জনপ্রিয় করার জন্য যারা ভূমিকা রেখেছেন তিনি তাদের অন্যতম।
সত্তর দশক পর্যন্ত তিনি সাহিত্যচর্চা ও গবেষণা নিয়েই মগ্ন ছিলেন। কিন্তু স্বৈরাচারের কবলে যখন দেশ, তখনই তিনি কলম ধরেন এর বিরুদ্ধে। নতুনভাবে রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে তার আবির্ভাব ঘটে। সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠা, সামরিকায়ন, সামরিক শাসন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, গণতন্ত্রের অঙ্গীকার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ সমকালীন রাজনীতির চড়াই-উতরাইয়ের নানা দিক নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি এসব লেখায় রাষ্ট্র ও সমাজের সমকালীন সংকট ও সমস্যার সত্য কথাটি বলতে চেয়েছেন, সৃষ্টি করেছেন জনমত। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবির প্রতিনিয়ত লিখে চলেছেন।
মুনতাসীর মামুন নিজে কাজ করে তৃপ্ত নন। তার কর্মতৃষ্ণা তিনি অন্যদের মধ্যেও সঞ্চারিত করে চলেছেন। যে কাজগুলো হওয়া প্রয়োজন, যে বিষয়টি গুরুত্ববহ, এমন অনেক কাজ তিনি অন্যদের দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তার সম্পাদনায় প্রকাশিত গণহত্যা বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ ও ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালা। অনালোচিত সব গণহত্যা ও বধ্যভূমির ইতিহাস উঠে এসেছে এসব গ্রন্থমালায়। তরুণ গবেষকরা মাঠপর্যায়ে গবেষণার মাধ্যমে গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং করছেন।
অনেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা-নির্যাতনের কথা নতুন করে জানতে পারছেন কাজ করতে গিয়ে। তারাও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন যা মুনতাসীর মামুনেরই অবদান। এই সিরিজ সম্পাদনার মধ্য দিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবরের প্রামাণ্য ইতিহাস রচনা করে চলেছেন।
১৯৬৮ সালে ঢাকায় আসার পর থেকে ঢাকার তৎকালীন বিদ্বৎসমাজের সঙ্গে মিলে কাজ শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কারপ্রাপ্তি তার যে খ্যাতি এনে দিয়েছিল তা তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বিস্তার করেছেন। মাত্র ২১-২২ বছরের একজন তরুণ মুনতাসীর মামুন নিজের কর্মের মধ্য দিয়ে সমকালীন বুদ্ধিজীবী মহলে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রথম যে সভা শহীদমিনারে ১৯৭২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৮৪ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র’, ‘৭১ এর যাত্রী’ বা ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানেও ছিলেন সক্রিয়। শেষ পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই ২০১০ সালে ট্রাইব্যুনালে গোলাম আযমের বিচারের প্রথম সাক্ষী ছিলেন তিনি। যখন অনেক প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবী সামনে আসতে রাজি ছিলেন না। তখন তিনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে গণহত্যাকারীদের বিচারের জন্য অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য মুনতাসীর মামুন যেমন মাঠে আন্দোলন করেছেন, তেমনি লেখালেখি চালিয়ে গিয়েছেন। মুনতাসীর মামুন মাঠের আন্দোলন, লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মের সামনে যুদ্ধাপরাধীদের অপকর্মের কথা প্রচার করেছেন। যা অন্তিমে তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে সহায়তা করেছে। মুনতাসীর মামুন শুরু থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার আন্দোলনে নিজে যেমন অংশগ্রহণ করেছেন, তেমনি তরুণ প্রজন্মকে সেই আন্দোলনের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, মুনতাসীর মামুন তার কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সত্যিকারের একজন বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। ইতিহাসকে শ্রেণিকক্ষের বাইরে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে একজন জন-ইতিহাসবিদ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন।
তার গবেষণাকর্ম, বক্তৃতা, বিবৃতি, চিন্তাভাবনা, সংগঠন প্রতিষ্ঠা সবই তো জাতির জন্য আলোকদিশারি। মনীষী আবুল ফজলকে বলা হতো জাতির বিবেক। সে অর্থে মুনতাসীর মামুনকে বলা যায় জাতির আলোকদিশারি। প্রজ্বলিত প্রদীপ হাতে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন তার বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা সেই ধারারই প্রবর্তক।
আজ এই জন-ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের ৭০তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা ও প্রণতি জানাচ্ছি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়