জেরুজালেমকেন্দ্রিক প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম ইতিহাসখ্যাত অঞ্চল হচ্ছে বর্তমান ইসরায়েলিদের দখল করা এবং ফিলিস্তিনিদের রক্তঝরা ভূখণ্ড। এক সপ্তাহ ধরে আবার এই নিরীহ ফিলিস্তিনিদের রক্ত ঝরছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর নির্দেশে সেনাবাহিনী গাজা এবং জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে বসবাসরতদের ওপর ক্রমাগত বোমাবর্ষণ করে চলেছে। এতে প্রতিদিন নারী-শিশু ও বৃদ্ধদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। ইসরায়েল যদিও দাবি করছে, ফিলিস্তিনি উগ্র গোষ্ঠী হামাসকে দমন করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য, কিন্তু প্রতিদিন যেসব মানুষ নিহত ও আহত হচ্ছে, বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে, তারা সবাই ফিলিস্তিনের সাধারণ নাগরিক।
এই পর্যন্ত প্রায় তিন শ ফিলিস্তিনি ইসরায়লিদের হামলায় নিহত হয়েছে। গাজাকে এখন অনেকটাই মানব বসবাসের নিরাপদ জায়গা হিসেবে কেউ ভাবতে পারছে না। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এই আবাসভূমিকে ফিলিস্তিনিশূন্য করার লক্ষ্য নিয়েই একের পর এক বোমাবর্ষণ করে চলছে। সে কারণেই হামাস বাহিনী পাল্টা ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ সংঘটিত করার চেষ্টা করছে।
হামাস মনে করছে, ইসরায়েলকে প্রতিঘাত না করলে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের গাজা ও পশ্চিম তীরের ভূখণ্ড দখল করে নেবে। পৃথিবীর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শক্তিসমূহ ইসরায়েলিদের বর্বরোচিত হামলার নিন্দা এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করে চলছে।
বৈশ্বিক করোনা সংক্রমণের এমন ভয়াবহ অবস্থাতেও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী দেশের অভ্যন্তরে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য ফিলিস্তিনিদের ওপর নতুন করে এই হামলা চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাকে সরাসরি সমর্থন জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের এমন আগ্রাসী আক্রমণ নতুন নয়। বরং প্রায় আট দশক ধরে সংঘটিত ঘটনা যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই ইসরায়েলকে সমর্থন এবং শক্তি জুগিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের অনেক আক্রমণ ভয়াবহ রক্তাক্ত যুদ্ধের দুঃখজনক নজির সৃষ্টি করেছে, যা পৃথিবীব্যাপী মানুষের মধ্যে ইসরায়েলিদের প্রতি ঘৃণা, ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমবেদনা ও সমর্থন তৈরি করে চলছে। তারপরও ইসরায়েলিদের জায়ানবাদী আক্রমণ, আগ্রাসন রোধে সারা বিশ্ব যেমন এক হতে পারছে না, ফিলিস্তিনিদের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র অর্জিত হচ্ছে না। অধিকন্তু ফিলিস্তিনিরা একের পর এক ইসরায়েলিদের নৃশংস হামলায় আক্রান্ত হচ্ছে।
২০১৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব জেরুজালেমে তাদের দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। কারণ ফিলিস্তিনিরা সব সময় পূর্ব জেরুজালেমে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী স্থাপনের স্বপ্ন দেখে আসছে। সেখানে মার্কিনরা তাদের দূতাবাস সরিয়ে আনার ফলে ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার যে শক্তি আগে থেকে প্রয়োগ করছিল, সেটিকে বাস্তবে রূপ দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ভূমিকা রাখে বলে ফিলিস্তিনিরা মনে করে। এর বিরুদ্ধে গাজায় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যে বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়, সেটিকে দমন করতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করে। তাতে নিহত হয় ৫৮ ফিলিস্তিনি এবং আহত হয় ৩ হাজারের বেশি ।
২০১৪ সালের ৮ জুলাইতে ইসরায়েলিরা গাজায় হামাস বাহিনীর ওপর হামলা শুরু করে। ৮ জুলাই থেকে আগস্টের ২৬ তারিখ পর্যন্ত ইসরায়েল বাহিনী বোমা ও গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখে। এতে ২ হাজার ৩০০ জনের মতো বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং প্রায় ১০ হাজার ৮০০ জন আহত হন। এভাবে পেছনের দিকে আমরা যত যেতে থাকব, তত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের আক্রমণ এবং হতাহতের বিবরণ একের পর এক দেখতে পাব।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনি জাতিগোষ্ঠীর মূল ভূখণ্ডে ইসরায়েলিদের রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড একের পর এক দখল করে নেয়ার লক্ষ্যে সামরিক আক্রমণ পরিচালিত করে যাচ্ছে। অথচ ফিলিস্তিনিদের একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন এখন পর্যন্ত ইসরায়েলিদের বারবার আক্রমণের কারণে বাস্তবে রূপ নিতে পারছে না। বিশ্বের মোড়ল শক্তিগুলো ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও ফিলিস্তিনিদের মর্যাদা তথা স্বীকৃতি দিচ্ছে না।
বর্তমান ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল ভূখণ্ড ছিল প্রাচীন যুগের অন্যতম গুরত্বপূর্ণ সভ্যতা। এর নিকটবর্তী অন্যান্য সভ্যতা যথা- ব্যাবিলনীয়, আসিরীয়, পারস্য, মেসিডোনিয়া এবং রোমানরা সাম্রাজ্য বিজয়ে যেসব অভিযান পরিচালনা করেছিল তাতে হিব্রু সভ্যতার সঙ্গে সংঘাত ও যুদ্ধবিগ্রহ সংঘটিত হয়েছিল। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত পিতৃপুরুষরা এই অঞ্চলে ইহুদি রাষ্ট্রের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন বলে ইহুদিরা বিশ্বাস করেন। সে কারণে তারা এখানে তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ধর্মীয় অধিকার বলে দাবি করে থাকেন।
এ নিয়ে শুরু থেকেই অন্য ধর্মাবলম্বী, গোত্র এবং জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ ইতিহাসের পথপরিক্রমায় একের পর এক ঘটতে দেখা গেছে। তাতে পরাজিত হলে তাদের দাসে পরিণত করা হয়। জুডেয়া নামক স্থানে ইহুদিদের বড় ধরনের বিদ্রোহ ১৩৫ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত হয়। রোমান সম্রাট হাড্রিয়ান সেটি দমন করেন। এরপর তিনি রোমানদের নিয়ে সিরিয়া ও জুডেয়াকে একত্রিত করে সিরিয়া-প্যালেস্টাইন গঠন করে। কিন্তু এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি বরং রক্তক্ষয় একের পর এক ঘটছিল। এখান থেকে অনেক ইহুদি পালিয়ে অন্যত্র চলে যায় অষ্টম শতকে ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড জয় করে আরব মুসলমানরা। ইউরোপ থেকে একাদশ-ত্রয়োদশ শতকে ধর্মযুদ্ধের অভিযান শুরু হলে জেরুজালেম পর্যন্ত সেই অভিযানে অনেকেই নেতৃত্ব প্রদান করেন।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সম্পর্কের সংকট ১৯৪৮ সালের ১৪ মে থেকে নতুন করে শুরু হয়। ফিলিস্তিন তখনও কোনো রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়নি। ফিলিস্তিনিদের আবাসভূমির প্রতিশ্রুত সীমা জাতিসংঘ নির্ধারণ করেনি, ইসরায়েল তা বাস্তবায়ন করতে দেয়নি। এই সংকট উভয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তীব্রতর হতে থাকে। ফিলিস্তিনিরা নিজের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) প্রতিষ্ঠা করে।
১৯৬৭ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন-ইসরায়েলকে কেন্দ্র করে পরাশক্তি এবং আরবদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ও বিভাজন সৃষ্টি হয়। ১৯৯৩ সালে অসলোতে পিএলও এবং ইসরায়েল একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে, তাতে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের দখল করা ভূখণ্ড ছেড়ে দেয়া এবং পর্যায়ক্রমে চলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। পিএলও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে ইসরায়েলের অস্তিত্ব মেনে নেয়। হামাস এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। পিএলওর নেতা হিসেবে ইয়াসির আরাফাত বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেন। তিনি ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। প্যালেস্টাইন আন্দোলন যোগ্য নেতৃত্বের সংকটে পড়ে।
অপরদিকে আরব দেশগুলোর মধ্যেও নানা অনৈক্য দেখা দেয়। ইসরায়েল সেই সুযোগ গ্রহণ করে। ফলে ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র বাস্তবে আজও প্রতিষ্ঠা কিংবা স্বীকৃতি লাভ করতে পারেনি। ইসরায়েলের বারবার হামলার প্রতিক্রিয়া থেকে হামাস ফিলিস্তিনে তার শক্তি বৃদ্ধি করার চেষ্টা করে। তবে ফিলিস্তিনের বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
একটি চরম রাজনৈতিক সংকট এই অঞ্চলকে দিন দিন ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে জটিল হচ্ছে। এতে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ ফিলিস্তিনিরা। ইসরায়েলিরা ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনিদের আবাসভূমি দখলে নিচ্ছে। বিতাড়িত করছে তাদের মূল ভূখণ্ড থেকে। এত আরব রাষ্ট্র থাকতে ইসরায়েল ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া ফিলিস্তিনি জাতিগোষ্ঠীর পাশে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে পারেনি বলেই এই জাতির এত অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও রাষ্ট্র পরিচয়ের স্বীকৃতির অভাব।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ফিলিস্তিনি জাতিগোষ্ঠীর সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাদেশে পিএলওর কার্যালয়ও খোলা হয়। ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র গঠনের অধিকারের পক্ষে বাংলাদেশের জনগণ সব সময়ই সংহতি প্রকাশ করে এসেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৫ বছর পূর্তিতে ইয়াসির আরাফাত আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার গভীর সম্পর্ক ছিল। তার মৃত্যুর পরও বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণ ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্রলাভের অধিকারে অকুণ্ঠভাবে সমর্থন প্রদান করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কখনোই ইসরায়েলি রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে ফিলিস্তিনি জনগণের রাষ্ট্রলাভের প্রতি বাংলাদেশের নৈতিক সমর্থন বহাল থাকা।
ফিলিস্তিনে চলমান রক্তক্ষয়ের মধ্যেই একটু সুখবর হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল, ফিলিস্তিনের হামাস ও ইসলামিক জিহাদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির কথা জানা গেছে শুক্রবার। হামাস যুদ্ধে বিজয় লাভ করেছে দাবি করে নিজেরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। এখানে স্বস্তির বিষয় হলো- দৃশ্যত আপাতত প্রাণহানি ও রক্তক্ষয় বন্ধ হলো। এটি স্থায়ী হবে বলে আমরা আশা করতেই পারি। সেই সঙ্গে আরও প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা ফিলিস্তিনিদের স্বভূমি ও স্বাধীনতা ফিরে পাবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে।
লেখক: গবেষক, অধ্যাপক।