চীনের উহান প্রদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হওয়ার কিছুদিন পরেই গবেষণা থেকে দুটি বিষয় আসে। প্রথমত, ভাইরাসটিতে মানুষ আক্রান্ত হয়েছে সি ফুড মার্কেট ও প্রাণীর বাজার থেকে। দ্বিতীয়ত, ভাইরাসটি এসেছে বাদুড় থেকে। চীনে এই করোনাভাইরাসে মানুষ প্রথম আক্রান্ত হওয়ার আগে- ২০০২ থেকে ২০০৪ অবধি সার্স ভাইরাস সিঙ্গাপুরে দেখা দেয়, পরে সেটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশকে আক্রান্ত করে। এরপরে ব্রাজিল, মেক্সিকোসহ কয়েকটি দেশের মানুষকেও একই ভাইরাস আক্রান্ত করে।
সার্স ভাইরাসকে মোকাবিলা করার শেষের দিকে এসে বিজ্ঞানীরা জানতে পান সার্স-২-এর অস্তিত্ব। তারা সে সময়েই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। আজ সবাই জানে, এই সার্স-২-ই কোভিড-১৯ বা নোভেল করোনাভাইরাস। চায়নাতে এই করোনাভাইরাস ধরা পড়লে তখন এটা সার্স-২ বলে চিহ্নিত হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে কোভিড-১৯ বলে এ কারণে, সার্স-২ হিসেবে চিহ্নিত হলে এটা বিশ্বব্যাপী একটা প্যানিক সৃষ্টি করবে। কারণ, সার্স ভাইরাস পৃথিবীতে প্যানিক সৃষ্টি করেছিল। বেশ ভয়াবহও হয়। অর্থাৎ তখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করেছিল কোভিড-১৯-এর ভয়াবহতা সার্সের থেকে কম থাকবে বা সমপরিমাণ থাকবে। এমন যে বিশ্বজুড়ে অতিমারি হবে, সেটা তারা চিন্তা করতে পারেনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কেন চিন্তা করতে পারেনি, এ প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। তবে এই সার্সের পরিবর্তিত রূপ তখন থেকেই ধীরে ধীরে এগোতে থাকে, তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন, ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ায় নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী শেষ অবধি সার্স-২ হিসেবে চিহ্নিত হয়। ধারণা করা হয়েছিল, এটা কুকুরের শরীর থেকে রোগীর শরীরে এসেছে।
বাস্তবে কোভিড-১৯ যে সরাসরি বাদুড় থেকে বা সি ফুড মার্কেট থেকে মানুষের শরীরে আসেনি, এর মাঝে অন্য কোনো প্রাণী আছে, যার মাধ্যমে মানুষের শরীরে এসেছে, তা এখন বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। তারা মনে করছেন, এই প্রাণী কুকুর হতে পারে আবার বিড়ালও হতে পারে। তবে গৃহপালিত কুকুর বা বিড়াল কি না, তা নিয়ে এখনও সন্দেহ আছে। অনেক বিজ্ঞানী মনে করছেন, গৃহপালিত বিড়াল বা কুকুর নয়। কারণ, এই প্রাণীগুলো দীর্ঘদিন মানুষের সংস্পর্শে আছে। অর্থাৎ যে বিষয়টি দেখা যাচ্ছে তা হলো, বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি কোথা থেকে কীভাবে এ ভাইরাস মানুষের শরীরে এল। যা নিশ্চিত হওয়া এর উৎস বন্ধ করার জন্য অনেক বেশি প্রয়োজন। যদিও এখন এ ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে এবং এর প্রতিষেধক মোটামুটি কার্যকর টিকাও আবিষ্কার হয়ে গেছে। তারপরে পরিপূর্ণ পরিত্রাণের জন্য উৎসটি জানা থাকলে অনেক বেশি উপকার হবে।
বাস্তবে সাধারণ ঠাণ্ডা বা কমন কোল্ড, সার্স, মার্স সব মিলিয়ে সাত ধরনের যে করোনাভাইরাস পৃথিবীতে এ পর্যন্ত মানুষকে আক্রান্ত করেছে, তার ভেতর এখন দেখা যাচ্ছে, এই কোভিড-১৯-ই সব থেকে ভয়াবহ।
বিজ্ঞান ও অর্থনীতির এই অগ্রগতির যুগে বসেও যে হারে কোভিড-১৯ মানুষ এবং অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তা স্প্যানিশ ফ্লু যে হারে ক্ষতি করেছিল তার থেকেও বেশি।
অথচ একটি বিষয় এখন স্পষ্ট বলা যায়, এই কোভিড-১৯কে নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গবেষণা করার যথেষ্ট সময় পেয়েছিল। তারা যদি ২০০৪-এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিত এবং পৃথিবীকে হুঁশিয়ার করত, তাহলে আজ হয়তো এই মহাবিপর্যয় দেখতে হতো না। কারণ, ২০০৪ থেকে ২০১৯-এর ভেতর গোটা পৃথিবী এ নিয়ে গবেষণা করতে পারত। অনেক প্রতিষেধকও আবিষ্কার করতে পারত; এবং মানুষ সেগুলো আগেই নিয়ে নিত। তাহলে কোনোমতেই এই কোভিডের ভয়াবহতায় পৃথিবীকে ভুগতে হতো না। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সে দায়িত্ব পালন করেনি।
এমনকি ২০০৪-এ এটা জানার পরেও উন্নত দেশগুলোও গুরুত্ব দেয়নি। কেন গুরুত্ব দেয়নি, তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় কোভিড-১৯ চায়নায় শুরু হওয়ার পরে। এটা চায়নাতে আউটব্রেক হওয়ার পরেও বেশির ভাগ দেশ মনে করেছিল, রোগটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক রোগ। তাই তখন থেকে কোনো প্রতিষেধক টিকারও পৃথিবী চেষ্টা করেনি, এমনি গোটা পৃথিবী লকডাউন না হোক অন্তত বিমান চলাচল বন্ধ করে রোগটি শুধু চায়নার ভেতর রাখার উদ্যোগও নেয়নি। তারা একবারও ভেবে দেখেনি, সার্সের পরে ১৫ বছরে পৃথিবীর চলাচল অনেক বদলে গেছে। বাজেট এয়ারের ফলে পৃথিবীজুড়ে এখন মানুষের চলাচল বেড়েছে। তাই সার্স যেমন কয়েকটি দেশে আটকে ছিল, এটা কোনোমতেই সেভাবে থাকবে না। এ সত্য এখন সামনে আসছে, গবেষণা না করা ও চায়নাতে কোভিড দেখা দিলেই পৃথিবীজুড়ে রাষ্ট্র পরিচালকদের হুঁশিয়ার না হওয়ার কারণেই আজকের পৃথিবীর এ দুর্গতি।
যা হোক, যে দুর্গতি এসে গেছে, এটা এখন মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ব্যর্থতা ও রাষ্ট্র পরিচালকদের ব্যর্থতা থেকে এখন তাদের শিক্ষা নিতে হবে। বিশ্বজুড়ে এখন মোটামুটি লকডাউনই চলছে। তবে এখন যে বিষয়টি সামনে এসেছে তা হলো- প্রতিটি দেশকে আলাদাভাবে গবেষণা করতে হবে। কারণ, সার্স পরিবর্তিত হয়ে সার্স-২ হিসেবে দেখা দেয় ২০০৪-এ, যা আজকের কোভিড-১৯। ঠিক একইভাবে ২০১৯-এ পৃথিবী এই সার্স-২ বা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে দেখা যাচ্ছে, কোভিড জলবায়ু অনুয়ায়ী হোক আর মানুষের দেহের জৈবিক বা অন্য কোনো গঠনের কারণে হোক, দ্রুত পরিবর্তিত রূপ নিচ্ছে।
তা ছাড়া ভাইরাসের চরিত্রও হলো দ্রুত পরিবেশ অনুযায়ী নিজেকে বদলে ফেলা। যে কারণে ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট, দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট, নাইজেরিয়ান ভ্যারিয়েন্ট, ব্রিটেন ভ্যারিয়েন্ট এবং সর্বশেষ ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট দেখা দিয়েছে। এগুলোর চরিত্রের সঙ্গে মূল উহান ভাইরাস বা কোভিড-১৯-এর আগের চরিত্রের অনেক পার্থক্য আছে। পৃথিবীজুড়ে অনেক ভাইরোলোজিস্ট তাই ইতোমধ্যে বলেছেন, এ পরিবর্তিত রূপ হবেই। এ কারণে অনেকেই মনে করছেন, একে রুখতে হলে কমন ভ্যাকসিনের বদলে অঞ্চলভিত্তিক ভ্যাকসিন আবিষ্কারই বেশি কার্যকর হবে।
তাই বাস্তবে বাংলাদেশসহ সব দেশের সামনে এখন দুটো বিষয় এসে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেককেই তার অঞ্চলভিত্তিক প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে হবে। বাংলাদেশেরও তাই এখন আর গবেষণা থেকে পিছিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ল্যাব আছে, ওই ল্যাবরেটরিসহ প্রয়োজনে একটি উন্নত মানের ভাইরোলজি গবেষণাগার তৈরি করতে হবে। মনে রাখা দরকার, রোগটি যেহেতু পশুপাখি থেকে সংক্রমিত হচ্ছে, তাই এই গবেষণায় অবশ্যই অ্যানিমেল সায়েন্সের প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্টদেরও যোগ করতে হবে। আর সে মাপের বাঙালি ভাইরোলজিস্টও বাংলাদেশের আছে। তা ছাড়া তরুণ ভাইরোলজিস্টরাও এখানে বড় ভূমিকা রাখবে।
বাস্তবে যতক্ষণ অবধি নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে নিজস্ব প্রতিষেধক ও ওষুধ আমরা তৈরি করতে না পারছি, ততক্ষণ অবধি শতভাগ মুক্তি এই কোভিড-১৯ থেকে পাওয়া যাবে না। তাই এ মুহূর্তে দেশের জন্য অন্যতম জরুরি কাজ হলো কোভিড গবেষণা ল্যাব ও গবেষণা।