প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার রোজিনা ইসলামের কাজের ক্ষেত্রই সচিবালয়। ধরে নিতে পারি ছুটির দিন ছাড়া নিয়মিতই তাকে সেখানে যেতে হয়। অন্যদিনের মতো সোমবারও তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। যেখানে সংবাদ বেশি, সাংবাদিকরা সেখানেই যাবেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিই সবার নজর। রোজিনাও তাই সেখানেই গিয়েছিলেন। গত এক বছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নানা দুর্নীতি নিয়ে একের পর এক রিপোর্ট করে তিনি তার দক্ষতার প্রমাণও রেখেছেন। তবে এই দক্ষতা দেখাতে গিয়েই তিনি অনেকের চক্ষুশূল হয়েছেন। নিশ্চয়ই তাকে বিপদে ফেলার জন্য ওত পেতে ছিলেন কেউ কেউ।
সোমবার স্বাস্থ্যসচিবের একান্ত সচিবের রুমে গিয়ে তেমনই কারো আক্রোশের ফাঁদে পড়েন রোজিনা ইসলাম। তার বিরুদ্ধে স্পর্শকাতর নথি ‘চুরি’ বা এর ছবি তোলার অভিযোগ আনা হয়। যদিও ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে রোজিনাকে বলতে শোনা যায়, তার সোর্স তাকে কিছু ডকুমেন্টস দিয়েছে। তবে তিনি কোনো ডকুমেন্টসে হাত দেননি। তারপরও তাকে আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়, তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া হয়, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। তিনি বারবার স্বাস্থ্যসচিব বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দেয়া হয়নি। প্রবল চাপের মুখে তিনি দুঃখপ্রকাশ করেন, প্রয়োজনে মুচলেকা দিতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও তারা কর্ণপাত করেননি।
বেআইনিভাবে ছয় ঘণ্টা আটকে রাখার পর তাকে শাহবাগ থানায় নেয়া হয়। পরে তার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। পরদিন আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। বৃহস্পতিবার জামিন শুনানি হলেও আদেশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে রোববার পর্যন্ত।
রোজিনার সঙ্গে যা হয়েছে, তাতে তার সহকর্মী সাংবাদিকদের মধ্যে তো বটেই, তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে দেশ-বিদেশে। পরদিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিল। সাংবাদিকরা সেখানে উপস্থিতও হয়েছিলেন। কিন্তু সহকর্মীকে কারাগারে রেখে তারা সেই সংবাদ সম্মেলন কাভার করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। তাই সাংবাদিকরা সংবাদ সম্মেলন বয়কট করে চলে আসেন।
আমি তাদের আবেগের সঙ্গে ষোলোআনা একমত। কিন্তু বয়কটের সঙ্গে নয়। মন্ত্রী-এমপিদের মতো শপথ নিতে হয় না বটে, তবে সাংবাদিকদেরও ‘অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার সঙ্গে সমান আচরণ’ করার অলিখিত নীতি মেনে চলতে হয়। তাই আমি বিশ্বাস করি, আবেগের বশবর্তী হয়ে সাংবাদিকদের কিছু করার সুযোগ নেই। সাংবাদিকদের সব কষ্ট, আবেগ বুকে চাপা দিয়ে দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়।
কখনও শুনেছেন পুলিশ, বিদ্যুৎশ্রমিক বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ধর্মঘট করেছে? ডাক্তাররা কোনো কারণে কাজ বন্ধ রাখলে আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ি। সাংবাদিকতা পেশাটিও বিশেষ পেশা। এখানে আবেগের কোনো স্থান নেই। আমি এখনও মনে করি সেদিন সাংবাদিকেদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলন কাভার করা উচিত ছিল। প্রয়োজনে সাংবাদিকরা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে পারতেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের।
আমরা সব সময় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলি। এই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কিন্তু সাংবাদিকদের নয়, সব মানুষের। ‘আপনার মতের সঙ্গে আমার না-ও মিলতে পারে, কিন্তু আপনার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে আমি জীবন পর্যন্ত দিতে পারি’- এই হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মূল চেতনা। সেদিন সংবাদ সম্মেলন বয়কট করে আসলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকেই ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। সারাক্ষণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে অপরের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করা কোনো কাজের কথা নয়।
তবু তাৎক্ষণিক বিশুদ্ধ আবেগ বলে সাংবাদিকদের বয়কটটি আমি মন থেকে মানতে না পারলেও চুপ করে ছিলাম। কিন্তু পরদিন পত্রিকা খুলে বিস্ময়ে আমি হতবাক হয়ে যাই। দেশের প্রায় পত্রিকায় এক-চতুর্থাংশ পাতাজুড়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপাটা কোনো অন্যায় নয়, বিস্ময়েরও কিছু নেই।
বিজ্ঞাপন না ছাপলে পত্রিকা চলবে কী দিয়ে! কিন্তু বিজ্ঞাপনের শিরোনাম দেখলে চমকে যাবেন আপনিও, ‘সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের অনভিপ্রেত আচরণ ও তৎপরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা’। প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে পুরো ঘটনার জন্য একতরফাভাবে রোজিনা ইসলামকে দায়ী করা হয়েছে। রোজিনা ইসলামকে ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে হেনস্তা করা, মামলা দেয়া, কারাগারে পাঠানো নিয়ে গোটা সাংবাদিক সমাজ যখন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে, তখন এমন একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ অনাকাঙ্ক্ষিত, অগ্রহণযোগ্য।
মাঠের সাংবাদিকরা সংবাদ সম্মেলন বয়কট করছেন, আর মালিকরা বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে টাকা নিচ্ছেন; এটা স্ববিরোধী, সাংবাদিক সমাজকে অপমান করার শামিল। বিজ্ঞাপনের যা বক্তব্য তা একতরফা, অসত্য এবং বিভ্রান্তিকর। এটা ঠিক, সাংবাদিকরা সংবাদ সম্মেলন বয়কট করেছেন বলেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ ধরনের একতরফা বক্তব্য প্রচার করার সুযোগ পেয়েছে। সংবাদ সম্মেলন বয়কট না করলে প্রতিটি বক্তব্যের পাল্টা প্রশ্ন করা যেত। এটা ঠিক, সাংবাদিকদের দায়িত্ব সংবাদ সংগ্রহ করা।
বিজ্ঞাপন ছাপা না-ছাপা সাংবাদিকদের এখতিয়ার নয়। বিজ্ঞাপন ছাপা না-ছাপা সম্পাদক এবং মালিকের সিদ্ধান্ত। সাংবাদিক সমাজের আবেগের প্রতি সম্মান দেখিয়ে মালিক-সম্পাদকরা অন্তত এই একটি বিজ্ঞাপন না-ও ছাপতে পারতেন। আর সাংবাদিকরা সংবাদ সম্মেলনটি বয়কটের কারণেই কিন্তু মন্ত্রণালয় তড়িঘড়ি করে এই বিজ্ঞাপনটি তৈরি করেছে।
তার মানে সাংবাদিকরাই আসলে মন্ত্রণালয়কে বিজ্ঞাপনটি দিতে বাধ্য করলেন এবং কৌশলে নিজেদের পত্রিকার আয় বাড়ালেন। পত্রিকা চালাতে বিজ্ঞাপন ছাপতেই হবে। কিন্তু একটি বিজ্ঞাপন না ছাপলে নিশ্চয়ই সব পত্রিকা বন্ধ হয়ে যেত না। বাংলাদেশের প্রায় সব পত্রিকার মালিক এবং সম্পাদক সাংবাদিকদের আবেগ-অনুভূতিকে পায়ে দলে বিজ্ঞাপনটি ছাপলেন; এটা আমার কাছে নিষ্ঠুর মনে হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়ের করা মামলায় রোজিনা ইসলাম কারাগারে আছেন।
বিচারাধীন একটি বিষয় নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই একতরফা বিজ্ঞাপন প্রচারের আইনি বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। আর এই বিজ্ঞাপন প্রকাশের অর্থ কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচিব বা অতিরিক্ত সচিবের পকেট থেকে যাবে না। জনগণের করের টাকায় একজন নির্যাতিত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এমন নির্লজ্জ প্রচারণা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, সাংবাদিকরা যে রোজিনার পক্ষে আন্দোলন করছে, সেখানেও তো একতরফা অভিযোগ আনা হচ্ছে। আমি আগেই বলেছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের ব্যাপারে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু সেটা টাকার বিনিময়ে নয়।
দেশের প্রায় সব দৈনিকে বিজ্ঞাপনটি ছাপা হলেও ব্যাখ্যা দিয়েছেন ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম। এই ব্যাখ্যার জন্য আমি তাকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে বিনয়ের সঙ্গে আমি তার ব্যাখ্যার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। ব্যাখ্যায় মাহফুজ আনামও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা কেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপন ছেপেছি, এ নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে।
এটি প্রকাশ করা না হলে এমন একটি সেন্সরশিপ তৈরি করা হতো, যা আমরা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করি। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। আমরা মনে করি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিভঙ্গি জানার অধিকার জনগণের আছে।' জানার অধিকার অবশ্যই জনগণের আছে। কিন্তু সেটা যে প্রক্রিয়ায় হয়েছে তা দৃষ্টিকটু এবং অসম্মানের। ডেইলি স্টার তার নিজস্ব প্রতিবেদকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য সংগ্রহ করত, প্রয়োজনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপনটি না ছেপে, সেই বিজ্ঞাপনের বক্তব্য নিউজ আকারে ছাপত, সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যের অসংগতিগুলো ধরিয়ে দিত; তাহলেই সেটা ভালো সাংবাদিকতা হতো। সংবাদ সম্মেলন বয়কট করে কৌশলে আদায় করা বিজ্ঞাপন ছেপে তার পক্ষে সাফাই গাওয়াটা অশোভন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলন বয়কট করাটা যেমন ভালো সাংবাদিকতার উদাহরণ নয়, তেমনি তাদের একতরফা, অসত্য বিজ্ঞাপন ছাপাটাও অনৈতিক।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক