কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ গত দুই মাসের অধিক সময় ভারতে যেভাবে তাণ্ডব চালাচ্ছে সেটা সামাল দিতে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলো হিমশিম খাচ্ছে। ভারতের অন্তত সাতটি রাজ্যে পরিস্থিতি একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
দিল্লি এবং মুম্বাইয়ের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উত্তর প্রদেশ, কেরালা ও গোয়া। এছাড়াও, ভোট পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের অবস্থা অত্যন্ত খারাপের দিকে যাচ্ছে।
করোনা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় হাসপাতালগুলোতে শয্যা ও আইসিইউ সংকট দেখা দিয়েছে। সর্বোপরি অক্সিজেন সরবরাহের ঘাটতি সার্বিকভাবে ভারতকে অত্যন্ত বাজে অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছে সেখানে।
রোগীর স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। আমরা প্রায় একমাস যাবৎ লক্ষ করছি ভারত করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুহারের দিক থেকে প্রায় প্রতিদিনই নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে ভারতে ডাবল এবং ট্রিপল মিউটেন্ট ভাইরাসের অস্তিত্ব লক্ষ করা গেছে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভ্যারিয়েন্টগুলোকে স্বীকৃতি দেয়নি, তবুও তারা এটা স্বীকার করেছে যে, এই ভ্যারিয়েন্টগুলোর অস্তিত্ব পৃথিবীর প্রায় ২২টি দেশে পাওয়া গেছে।
ভারতের বিজ্ঞানীরা বলছেন এই ভ্যারিয়েন্টগুলো অত্যন্ত সংক্রমণশীল এবং এগুলো করোনার আগের স্ট্রেইনগুলোর তুলনায় অনেক দ্রুত রোগীকে আক্রান্ত করতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই ভ্যারিয়েন্টগুলো ভ্যাকসিনের সুরক্ষা ভেদ করে রোগীদের সংক্রমণ করছে।
ভারত আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ভারতের সঙ্গে রয়েছে আমাদের বিভিন্ন স্থল সীমান্ত যেখান দিয়ে প্রতিনিয়তই মানুষ ভারতে যায় এবং ফিরে আসে। এই ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে সরকার ভারতের সঙ্গে সকল সীমান্ত পথ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে- সেটি সুচিন্তিত একটি সিদ্ধান্ত।
এরপরেও আমরা লক্ষ করেছি ভারতফেরত বেশ কিছু মানুষের শরীরে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বিধায় এটা বাংলাদেশের জন্য চিন্তার বিষয়।
ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ করেছি বাংলাদেশে প্রায় এক মাসের বেশি লকডাউন থাকায় করোনা সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুহার অনেক কমে এসেছে। সরকার চলমান লকডাউন ২৩ মে পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে ঈদ উদযাপনের জন্য জনগণের শহর থেকে গ্রামে যাওয়ায় পরিস্থিতি খারাপ হবার আশঙ্কা রয়েছে।
সরকার রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ঈদের ছুটিতে স্ব-স্ব কর্মস্থলে থাকা বাধ্যতামূলক করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো লকডাউন কার্যকর করার ফলে আমরা করোনা ভাইরাসের চেইনটাকে ইতোমধ্যে ভাঙতে এবং অনেক ক্ষেত্রে দুর্বল করতে সক্ষম হয়েছি। তবে ঈদ উপলক্ষে মানুষ যেভাবে শহর থেকে গ্রামে গেছে এবং আবার প্রাম থেকে শহরে ফিরছে তাতে পরিস্থিতি খারাপ হবার যথেষ্ট সম্ভবনা রয়েছে।
আমরা ইতোমধ্যেই লক্ষ করেছি ঈদের পরে গত দুই দিন করোনা টেস্টের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে রোগীর সংখ্যা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যেই ধারণা করছেন যে, ঈদের সময় স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে মের শেষের দিকে রোগীর সংখ্যা আবারও বাড়তে পারে।
বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কারণ আমরা ইতোমধ্যেই লক্ষ করেছি সরকার জীবিকার কথা চিন্তা করে শপিং মল এবং দোকানপাট স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে খুলে দিয়েছে। এমনকি গণপরিবহন শ্রমিকদের দুর্দশার কথা মাথায় রেখে জেলার মধ্যে গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে।
এমতাবস্থায় যদি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টগুলো মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে করোনা পরিস্থিতি আবার ভয়াবহ আকার ধারণ করবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া, ঈদে বাড়ি যাওয়া মানুষের ভিড়ের মধ্যে যদি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বহনকারী রোগী থেকে থাকে তাহলে সংক্রমণ খুব দ্রুতই বেড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।
সুতরাং এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা হলো কঠোরভাবে লকডাউন নিশ্চিত করা এবং জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করার পাশাপাশি গ্রাম থেকে শহরে জনগণের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা। আমরা ইতোমধ্যেই লক্ষ করেছি গণপরিবহন না চললেও মানুষ ভেঙে ভেঙে গ্রাম থেকে ঢাকার দিকে ফিরছে এবং এই ফেরার পথে করোনা সুরক্ষা বিধি কোনোভাবেই মেনে চলা হচ্ছে না। ফলে আমরা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি।
এছাড়া যে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার সেটি হলো বাজারে মানুষের আধিক্য। ঈদের পরেও বাজার ও শপিংমলগুলোতে মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করছে এবং বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে সুরক্ষা বিধি মানার ক্ষেত্রে এক ধরনের অনীহা লক্ষ করা যাচ্ছে। গণপরিবহন অপ্রতুল হওয়ায় ছোট ছোট যানবাহনে গাদাগাদি করে মানুষ দোকানপাটে যাচ্ছে। এখানেও সুরক্ষা বিধি মানা হচ্ছে না। এই অবস্থা যদি চলতে থাকে, তাহলে এক সপ্তাহ পরে পরিস্থিতি পুনরায় ভয়াবহ হবে বলে আমি মনে করি।
আমরা যদি লকডাউনের আগে অর্থাৎ মার্চ এবং এপ্রিলের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখব যে, করোনা পরিস্থিতি কি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল বাংলাদেশে? আমরা রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের রোগী নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে দেখেছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ শয্যা ও আইসিইউ সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছিল। কোথাও কোথাও অক্সিজেন সরবরাহের সংকট দেখা দিয়েছিল।
সরকারের লকডাউনের সিদ্ধান্তের ফলে আমরা সেই পরিস্থিতিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। কিন্তু আমরা যদি এখন আবার আত্মতুষ্টিতে ভোগা শুরু করি তাহলে পরিস্থিতি যেকোনো সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে করোনা শনাক্তের হার অবশ্যই শূন্যে নিয়ে আসতে হবে এবং সেখানেই ধরে রাখতে হবে। তখন হবে আমাদের কিছুটা আত্মতুষ্টি।
নেপাল ভারতের পাশের দেশ হওয়ার কারণে নেপালের করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আমরা করোনার প্রথম ধাপে দেখেছি নেপাল অত্যন্ত সফলভাবে করোনা মোকাবিলা করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে ভয়াবহতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
সেখানে ইতোমধ্যেই হাসপাতালে রোগীর চাপ, রোগীর মৃত্যু এবং অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে। অনেকেই মনে করছেন নেপালের করোনা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পেছনে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্বই দায়ী। ফলে, ভারত এবং নেপালের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশকে এই মুহূর্তে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
এই মুহূর্তে সরকারের উচিত ভারতের সঙ্গে বর্ডার বন্ধের সিদ্ধান্তটি আরও দীর্ঘায়িত করা। কারণ এখন পর্যন্ত ভারতের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ হয়নি। আমরা যদি ভারতের সঙ্গে বর্ডার এক মাস বা দুই মাস বন্ধ রাখি আমাদের অর্থনীতিতে এর তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু আমরা যদি বর্ডার খুলে দেই এবং ভারতের ভ্যারিয়েন্ট যদি বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে প্রবেশ করে তাহলে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
এখন যেটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে জনগণের মধ্যে করোনাকেন্ত্রিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আমরা করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় থেকে লক্ষ করেছি বাংলাদেশের জনগণের একটি বড় অংশ করোনা সুরক্ষা বিধি মেনে চলে না। তাদের মধ্যে এক ধরনের ঢিলেঢালা ভাব লক্ষণীয়। এটি যদি এখনও চলে তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে যেকোনো সময়।
ইতোমধ্যেই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন যে, করোনার তৃতীয় ঢেউ বাংলাদেশে যেকোনো সময় আঘাত হানতে পারে। সে আঘাত থেকে যদি নিজে এবং দেশকে রক্ষা করতে হয়, তাহলে সর্বপ্রথম যেটি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে সুরক্ষাবিধি মেনে চলা অর্থাৎ বাড়িতে থাকা, বাড়ির বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করা, ঘন ঘন হাত ধোয়া, জনসমাগম এড়িয়ে চলা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। আর যদি না করি তাহলে আমরা আবার করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের শিকার হবো।
ভারতের ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে শনাক্তকরণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের উদ্বিগ্নতা বেড়েছে। ফলে আমাদের সকলকে এক হয়ে কাজ করতে হবে এই মহামারি থেকে মুক্তি পাবার জন্য। তবেই আমরা আবার আগের মতো করোনামুক্ত বাংলাদেশে শ্বাস নিতে পারব।
লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।