মহামারিতে বিধি ও তথ্য না মানার সুলুক সন্ধান
সমাজবিজ্ঞানী পল লেজারসফেল্ড ও রবার্ট কে মার্টন ১৯৪৮ সালে গণমাধ্যমের প্রভাবসংক্রান্ত নার্কোটাইজিং ডিসফাংশন তত্ত্বটি আবিষ্কার করেন। এ তত্ত্বের মূল কথা হলো- গণমাধ্যম যখন কোনো বিষয়ে প্রচুর তথ্য সরবরাহ করে তখন পাঠক ও শ্রোতা সেসব তথ্য কাজে লাগানোর ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ব্যাপকভাবে প্রবাহিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কোনো কার্যকর উদ্যোগ বা সিদ্ধান্ত নিতে পাঠক ও শ্রোতা নিরুৎসাহিত হতে পারে।
এ তত্ত্বানুসারে বন্যার স্রোতের মতো ধেয়ে আসা তথ্য পাঠক-শ্রোতাকে উদ্দীপ্ত না করে বরং নিষ্ক্রিয় এবং সামাজিক ক্রিয়াশীলতার ব্যাপারে নির্লিপ্ত হতে সহায়তা করে পারে। পল লেজারসফেল্ড ও রবার্ট কে মার্টনের এ তত্ত্ব ‘ম্যাস কমিউনিকেশন, পপুলার টেস্ট অ্যান্ড অরগানাইজড সোস্যাল অ্যাকশন’ শিরোনামে প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হয়।
উল্লেখ্য, নার্কোটাইজিং ডিসফাংশন তত্ত্ব যখন আবিষ্কার হয় তখন কেবল মুদ্রণ ও রেডিওতে এর প্রভাব ছিল। বর্তমানে মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিকতা এসেছে।
করোনা বিষয়ে বানের পানির মতো তথ্যপ্রবাহ এবং বাড়তি কিছু অনুষঙ্গ এ সংক্রমণরোধে শিথিল জন-আচরণ তৈরিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। করোনাকালে জন-আচরণের ওপর অনেকাংশে পল লেজারসফেল্ড ও রবার্ট কে মার্টনের গণমাধ্যমের প্রভাবসংক্রান্ত নার্কোটাইজিং ডিসফাংশন তত্ত্বের প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। জনগণ করোনা বিষয়ে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এত বেশি তথ্য পেয়েছে বা পাচ্ছে যে, তারা তথ্যভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এসব তথ্য অনুসরণের ক্ষেত্রে একধরনের উদাসীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
গত ২০২০-এর মার্চে যখন করোনা সংক্রমণ শুরু হয় তখন মানুষ এ বিষয় সম্পর্কে আগ্রহী এবং তা মেনে চলার ব্যাপারে অনেকাংশেই সচেষ্ট ছিল। কিন্তু মহামারি প্রভাব যত দীর্ঘ হচ্ছে তথ্য বা বার্তা মানার ক্ষেত্রে তত বেশি অনীহা লক্ষ করা যাচ্ছে। করোনা-সংক্রান্ত সচেতনতামূলক প্রচারে কেবল তথ্য ছিল না, ছিল বার্তা। তথ্য ও বার্তার মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। তথ্য কাজ কগনেটিভ বা ধারণা-জ্ঞানগত পর্যায়ে আর বার্তার কাজ ব্যবহারিক পর্যায়ে।
যেমন-করোনা কী, কখন সংক্রমণ শুরু হলো, কোথা থেকে শুরু হলো, কেন শুরু হলো, কারা সংক্রমিত হচ্ছে ইত্যাদি বিষয় তথ্যের আওতাভুক্ত। আর করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে কীভাবে সুরক্ষায় কী কী স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হবে তা সম্পর্কে নির্দেশনা হলো বার্তার কাজ।
করোনা বিষয়ে সচেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে তথ্য ও বার্তাবন্যা যে বয়ে গেছে, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তথ্য ও বার্তার এ বন্যা দর্শক-শ্রোতাকে করোনা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা নিতে হয়ত নিষ্প্রভ করে তুলছে।
পুনঃপুন করোনা ভয়াবহতার প্রচার স্বাভাবিক প্রবণতা হয়ে উঠছে। একেই বলে বার্তার স্বাভাবিকীকরণ। ভয়াবহতা বার বার উপস্থাপিত হলো বা দীর্ঘস্থায়ী হলে তা স্বাভাবিক প্রবণতা হিসেবে দেখা দেবে। যেমনটি এখন লক্ষ করা যাচ্ছে। করোনার সংক্রমণরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানতে এক ধরনের নির্লিপ্ততা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
করোনা বিষয়ে সচেতনতায় তথ্য ও বার্তা মানবীয় যোগাযোগ, গণমাধ্যম- রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষত ফেসবুকেও ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে।
তথ্য বা বার্তা যে মাধ্যমে থেকে আসুক, হোক না কেন তার কার্যকারিতা নির্ভর করে বেশকিছু সূচকের ওপর। এ নিবন্ধ লেখক ও মো. হুমায়ুন কবির ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকের মিডিয়া এবং বার্তার কার্যকারিতা বিষয়ে গবেষণায় দেখিয়েছেন- মিডিয়া ও বার্তার কার্যকারিতা নির্ভর করে মূলত চারটি সূচকের ওপর; এগুলো হলো- বোধগম্যতা, প্রয়োগযোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও প্রভাবান। গবেষকদ্বয় দেখান- ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংক যতগুলো মাধ্যম ব্যবহার করেছে তার মধ্যে ‘মানুষ’ ছিল সবচেয়ে কার্যকর যোগাযোগ মাধ্যম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন- ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে মানুষ ছিল সবচেয়ে ভালো মাধ্যম।
করোনা মহামারি বিষয়ে পরিবেশিত তথ্য ও বার্তার কার্যকারিতার ক্ষেত্রে মূল সমস্যা ঘটেছে প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে। জনগণ কোনো বিষয় সম্পর্কে কেবল জানলে বা বুঝলেই হবে না, তথ্য সচেতনতার পাশাপাশি তথ্য কাজে লাগানোর জন্য সহায়ক পরিবেশ দরকার।
২০০০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক ড. দুলাল চন্দ্র বিশ্বাসের নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার একটি এলাকার মানুষ পানিতে আর্সেনিক দূষণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে সচেতন হলেও তাদের কাছে নিরাপদ পানির সুব্যবস্থা না থাকায় আর্সেনিকযুক্ত পানি পানে বাধ্য ছিল।
বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে যে প্রচারাভিযান এটির সাফল্য এসেছিল মূলত সচেতনতা বৃদ্ধি এবং জন্মনিরোধ উপকরণগুলোর সহজলভ্যতার কারণে। তথ্য ও বার্তার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন সহায়ক পরিবেশের। কেবল সচেতনতা বাড়লে হবে না- তাকে কাজে লাগানোর মধ্যে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট থাকতে হবে।
মহামারিকালে তথ্য বা বার্তা কাজে লাগানোর বিষয়টি তিনটি দিক থেকে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে;
১. মহামারি সম্পর্কিত তথ্যের অসীম প্রবাহ, যা এর ভয়াবহতাকে স্বাভাবিক করছে;
২.তথ্য কাজের লাগানোর ক্ষেত্রে বিকল্পের অভাব; এবং
৩. সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে শৈথিল্য ও বৈষম্যমূলক প্রয়োগ।
করোনা মহামারি সম্পর্কিত তথ্যের অসীম প্রবাহ, যা এর ভয়াবহতাকে স্বাভাবিক করতে সহায়তা করছে: করোনা মহামারি কোনো শর্ট ইভেন্ট হিসেবে থাকছে না। এটা পরিণত হয়েছে এক লম্বা ইভেন্টে। যেকোনো লম্বা ইভেন্টের প্রতি দর্শক-স্রোতা তার মনোযোগ ধরে রাখাটা সহজ নয়। এ ধরনের দীর্ঘ পরিস্থিতি মানুষের মধ্যে নৈরাশ্য তৈরি করে। ক্লান্ত করে ফেলে। তথ্য বা বার্তার অনুশাসনে জীবন চালাতে অনীহা তৈরি হয়। তারপরও মহামারির অভিঘাত যখন ক্রমশ বাড়তে থাকে পরিচিতজনদের অসুস্থতা ও মৃত্যুর খতিয়ান প্রতিদিন হালনাগাদ করতে হয়। তখন ব্যক্তি ভেতরে ভেতরে নিজের মৃত্যুর হিসাব কষতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
মানুষ একবার মৃত্যুর হিসাব কষতে শুরু করলে কোনো অনুশাসনের সে আর পরোয়া করে না। এ পরিস্থিতিতে বার্তার শ্রেণিকরণ, প্রয়োজনীয় টুকু বেছে নেয়া এবং তা কাজে লাগানোর ব্যাপারে আর বিশেষ কোনো আগ্রহ থাকে না।
তাছাড়া, এদেশের সিংহভাগ মানুষ প্রতিদিন মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করে। নানা বঞ্চনা, বৈষম্য ও প্রত্যাখ্যান ব্যক্তির বেঁচে থাকা কঠিন করে তোলে। জীবন নিয়ে নিজের প্রতি রয়েছে এক বিরক্তিকর অনুভূতি। মৃত্যু সর্তকতা ব্যক্তির কাছে রসিকতাও বটে। এ সর্তকতা তাকে সজাগ করে না, করে না সচেতন।
এমন অবস্থায় টনকে টন তথ্য ঢাললেই তা কার্যকর হবে না। সাধারণ জনগণ কোনো মর্যাদাপূর্ণ জীবন পায়নি। করোনা মহামারিতে জনগণের জীবন সুরক্ষা বিষয়ে তথ্যের যে জোয়ার ও জোরাজুরি তা তাদের জীবন-জীবিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং তাদের কাছে অনেক সময় বাড়াবাড়ি। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণ আরেক কাউন্টার রিয়ালিটি তৈরি করে। দ্রোহ দেখায়। তথ্য ও বার্তা বা কোনো নির্দেশনার প্রতি মনোযোগী হতে চায় না। এ জীবন সুরক্ষা বিষয়ে এ ঝুঁকি তার একধরনের প্রত্যাখ্যান।
তার শরীর হয়ে পড়ে হাঁসের মতো। হাঁস যেমন সারাদিন পানিতে থেকে ভিজে যায় না। জনগণও ঠিক ব্যাপক তথ্যপ্রবাহে নিমজ্জিত হয় কিন্তু শুকনো থাকে। করোনা সংক্রমিত হবে কি হবে না তা অনিশ্চিত কিন্তু সে যে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে পারবে তা তো নিশ্চিত। জনগণ নিশ্চিত বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। পরিবার তার কাছে নিশ্চিয়তার আধার কোনো বৈরী পরিস্থিতি তাকে নিবৃত্ত করতে পারছে না। জীবন-জীবিকার তাগিদে মহানগরে এলেও তার জীবনের ফুসরৎ কম। যেখানে সবাই কোনো না কোনোভাবে ম্যানেজ করে বাড়ি যাচ্ছে সেখানে তাকেও যেতে হবে।
তথ্য কাজের লাগানো ক্ষেত্রে বিকল্পের অভাব: করোনাকালে জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয়টা একটা বড় ইস্যু হিসেবে উঠে এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে দুস্থ ও অসহায় মানুষ সুরক্ষায় আর্থিক সহায়তা দেয়া হলেও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। জীবিকার বিকল্প না থাকায় সমাজের ক্ষুদ্র পেশাজীবীরা চরম সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ বিষয়ে সচেতনতা থাকলেই রুটি-রুজির সংস্থানের জন্য একটা বড় অংশকে বাইরে বের হয়ে আসতে হচ্ছে। জীবিকার প্রশ্নে ভালো কোনো বিকল্প বের করা সম্ভব হয়নি, যা তথ্য সচেতনতা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে শৈথিল্য ও বৈষম্যমূলক প্রয়োগ; করোনা মহামারি রোধে সরকার ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে শৈথিল্য লক্ষ করা গেছে এবং ঘটছে এর বৈষম্যমূলক প্রয়োগ। যেমন- আন্তজেলা গণপরিবহন ছাড়া সব পরিবহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হচ্ছে। আকাশপথে বিমান চলছে, সড়কপথে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসসহ অন্য সব পরিবহন চলছে।
সমাজের সুবিধাভোগীদের চলাফেরায় কোনো সমস্যা নেই। কেবল নিষেধাজ্ঞা গণপরিবহনের ক্ষেত্রে, যা মূলত সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে থাকে। জনগণ যখন দেখছে কেবল তার যাত্রাপথ রহিত করা হয়েছে তখন বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না। অপরদিকে, তার ‘দ্যাশে’ যাওয়ার জন্য রয়েছে পূর্বপ্রতিশ্রুতি। আর এ ঈদকে ঘিরে সে পরিবারের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগ পায়।
গণরাসের অংশ নেয়া মানুষ জেনে গেছে করোনা তাকে ধরতেও পারে না-ও পারে। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে তার যে দেখা হচ্ছে তা তো নিশ্চিত। মানুষ অনিশ্চিয়তার দিকে ধাবিত হয় না যা নিশ্চিত সেদিকের অনুগামী হয়। তাই সাধারণ জনগণ সুযোগ পেলে দ্যাশে যায়। কারণ, যেখানে সে যায় সেখানে ভালোবাসা, স্নেহ ও মর্যাদা পায়। পায় একটু স্বস্তি।
‘দ্যাশে’ যাওয়ার গণরাস কেবল তথ্য সচেতনতা বা বিধি-নিষেধ দিয়ে রোখা সম্ভব নয়।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিশ্লেষক