যে ভূখণ্ডকে ইসরায়েল নামে ডাকা হয়, তা আসলে ইসরায়েলের ভূখণ্ড নয়, এটি ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। সে হিসেবে আন্তর্জাতিক ভূমিদস্যু ইসরায়েল অবৈধ দখলদার।
১০ হাজার ৪২৯ বর্গমাইল আয়তনের ফিলিস্তিন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানরা পরাজিত হলে ফিলিস্তিন ব্রিটিশদের অধিকারভুক্ত হয়। ১৯২২ সালে জাতিসংঘ তার গঠনতন্ত্রের ২২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ফিলিস্তিন প্রশাসন পরিচালনার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে সাময়িকভাবে কর্তৃত্ব বা ম্যান্ডেট প্রদান করে। উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনের প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবকাঠামো গড়ে ওঠার পর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় সত্তা গঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজিত রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে অধিকৃত কিছু ঔপনিবেশিক অঞ্চলের সাময়িক শাসনের দায়িত্বও জাতিসংঘের কোনো কোনো সদস্য রাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করা হয়। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়ের আগে অন্তর্বর্তীকাল এসব অঞ্চলের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত কোনো রাষ্ট্রের অভিভাবকত্বের অধীনে প্রদান করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজিত তুরস্ক, জার্মানি, ইতালি ও জাপানের কাছ থেকে অধিকৃত যেসব অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের অভিভাবকত্বের অধীনে প্রদান করা হয়েছিল, একে একে সবাই স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণতি লাভ করেছে। কিন্তু ব্যতিক্রম দেখা দেয় ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে।
ফিলিস্তিনের ব্রিটিশ রক্ষক ভক্ষককে পরিণত হয়। ফিলিস্তিনের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটেন ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রিটিশ সরকার ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিলেও ফিলিস্তিনে রাষ্ট্র গঠনের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক ইহুদি ছিল না। অল্প কয়েক হাজার ইহুদির বাস ছিল তৎকালীন ফিলিস্তিনে। ব্রিটিশ সরকার ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে তাই নানা প্রান্ত থেকে ইহুদিদের নিয়ে এসে ফিলিস্তিনে জড়ো করতে থাকে। ইহুদিদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি মুসলমানদের ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত করতে ব্রিটিশ সরকার ইহুদি সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করে। অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পেয়ে ইহুদিরা বেশ কয়েকটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে তোলে। এদের মধ্যে ভয়ংকর সন্ত্রাসী সংগঠন ছিল হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং; যারা হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের বাধ্য করে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে৷ আর এই সুযোগে ফিলিস্তিনিদের জমিজমা ইহুদিরা দখল করে নেয়।
১৯২২ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদি ছিল মাত্র ১২ শতাংশ, ১৯৩১ সালে তা হয় ২৩ শতাংশ, আর ১৯৪৭-এ তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ শতাংশে। ইহুদিদের সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি পেলে ব্রিটিশ সরকার নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে। ১৯৪৭ সালের ২ এপ্রিল ব্রিটিশ সরকার নবগঠিত জাতিসংঘকে চিঠি দেয় পরবর্তী সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিন ইস্যুকে এজেন্ডাভুক্ত করে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য সুপারিশ গ্রহণ করতে। অথচ এ বিষয়ে জাতিসংঘের কিছুই করণীয় ছিল না। ব্রিটিশ সরকারের দায়িত্ব ছিল জাতিসংঘ প্রদত্ত ম্যান্ডেটের শর্ত অনুযায়ী তার কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণা করা। চিঠি পেয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একই বছরের ১৫ মে ১০৬ নং সিদ্ধান্তে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ফিলিস্তিন বিষয়ে অনুসন্ধান করে উপযুক্ত সুপারিশমালা প্রণয়ণের জন্য U.N. Special Committee on Palestine (UNSCOP) গঠন করে।
পক্ষপাতদুষ্ট UNSCOP ১৯৪৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত তার রিপোর্টে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে ফিলিস্তিনকে ভাগ করে ইহুদি ও মুসলমানদের জন্য দুটি রাষ্ট্র অথবা এক রাষ্ট্রের অধীনে দুই সম্প্রদায়ের জন্য দুটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। ফিলিস্তিনে মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ আরব আর ৩৩ শতাংশ ছিল ইহুদি। মোট ভূমির ৮৫ শতাংশের মালিক আরবরা আর ৭ শতাংশের মালিক ছিল ইহুদিরা। আরবদের নিয়ন্ত্রণে ৮৫ শতাংশ ভূমি থাকা সত্ত্বেও ৪৫ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ে আরব রাষ্ট্র আর ৭ শতাংশের মালিক ইহুদিদের জন্য ৫৫ শতাংশ নিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করার সুপারিশ করে UNSCOP।
প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ সরকারের পাশাপাশি এই UNSCOP-ই ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে তাদের রাষ্ট্র কেড়ে নেয়া ও ফিলিস্তিন সমস্যা সৃষ্টির প্রধান অভিযুক্ত। UNSCOP রিপোর্টের সুপারিশের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে ব্রিটিশ সরকার বিবৃতি দেয়। কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে UNSCOP রিপোর্টের সুপারিশকে প্রত্যাখ্যান করে বলা হয় ফিলিস্তিনের কোনো বিভক্তি কিংবা ইহুদি সংখ্যালঘুদের জন্য কোনো বিশেষ অধিকার সৃষ্টি করা হলে আরবরা সম্ভাব্য সব উপায়ে তা প্রতিহত করবে। আরবরা ঘোষণা করে ম্যান্ডেটের বিধান অনুযায়ী সমগ্র ফিলিস্তিন নিয়ে আরব রাষ্ট্র গঠিত হবে, যেখানে সংখালঘু সব সম্প্রদায়ের মানবাধিকার, স্বাধীনতা, আইনের দৃষ্টিতে সমতা, নিজ নিজ ধর্মপালনের স্বাধীনতা ও পবিত্র স্থানগুলোয় সবার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হবে। এমতাবস্থায় সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিন সমস্যার সঙ্গে জড়িত আইনগত বিষয়াবলি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য Ad Hoc Committee on the Palestinian Question গঠন করে। অ্যাডহক কমিটি ১৯৪৭ সালের ১১ নভেম্বর তার প্রতিবেদন সাধারণ পরিষদে জমা দেয়। কমিটি স্পষ্ট করে বলে যে, ফিলিস্তিনে আরব ও ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে UNSCOP রিপোর্টে যে যুক্তি উল্লেখ করা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক আইন ও সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা সমর্থনযোগ্য নয়। বরং, League of Nations কর্তৃক ফিলিস্তিনের ওপর ব্রিটেনকে দেয়া ম্যান্ডেট অবসান হলে এবং ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে ফিলিস্তিনের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তর হতে বাধা নেই। কেবল ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরই ম্যান্ডেটের উদ্দেশ্যের যৌক্তিক পরিণতি লাভ করবে ও League of Nations-এর সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
অ্যাডহক কমিটি আরও বলে যে, ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান ছাড়া সাধারণ পরিষদের আর কোনো সুপারিশ করার এখতিয়ার নেই। পর্যবেক্ষণে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করা জাতিসংঘ সনদের নীতিমালার পরিপন্থি এবং নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি করার এখতিয়ার জাতিসংঘের নেই। কমিটির পর্যবেক্ষণে জোর দিয়ে বলা হয়, ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ সরকার নির্ধারণ করার ও একটি রাষ্ট্র ভেঙে একাধিক রাষ্ট্র গঠন করার এখতিয়ার কেবল ফিলিস্তিনের জনগণের।
অ্যাডহক কমিটি তার সুপারিশে আরও বলে, ফিলিস্তিন নিয়ে জাতিসংঘে আর আলোচনার প্রয়োজন নেই এবং ফিলিস্তিন ইস্যুকে সাধারণ পরিষদের এজেন্ডা থেকে বাদ দেয়া সমীচীন হবে। এরপরও এ বিষয় নিয়ে কোনো বিরোধ হলে তা আন্তর্জাতিক আদালতের উপদেশমূলক মতামতের জন্য প্রেরণ করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত, আরব রাষ্ট্রসমূহও বারবার ফিলিস্তিন ইস্যুকে আন্তর্জাতিক আদালতে প্রেরণের দাবি করে আসছিল।
সাধারণ পরিষদ আন্তর্জাতিক আদালতে অভিমতের জন্য না পাঠিয়ে ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ১৮১ নং সিদ্ধান্তে UNSCOP-এর সুপারিশ মোতাবেক ফিলিস্তিন ভাগ করে আরব ও ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নিরাপত্তা পরিষদকে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সাধারণ পরিষদের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়। নিরপত্তা পরিষদের সদস্যরা এ নিয়ে চরম বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। নিরপত্তা পরিষদের সামনে প্রশ্ন দাঁড়ায়, কোনো রাষ্ট্রের জনগণের সম্মতি ছাড়া ওই রাষ্ট্রকে ভাগ করার, বিধিবিধান তৈরি করার, কোনো চুক্তি চাপিয়ে দেয়ার এখতিয়ার সাধারণ পরিষদের আছে কি না? তা ছাড়া সাধারণ পরিষদ নিরাপত্তা পরিষদকে যে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ করেছে, তা জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদের কাজের অন্তর্ভুক্ত কি না? বিতর্ক শেষে ঐকমত্য হয়, জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদ কেবল তখনই সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে পারে, যখন আগ্রাসন বা অন্য কোনো কারণে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় বা হুমকির মুখে পড়ে। রাষ্ট্র বিভাজনের পরিকল্পনা যা পক্ষগণ প্রত্যাখ্যান করেছে তা নিজেই শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হওয়ায় নিরাপত্তা পরিষদ কখনোই এমন কাজে যুক্ত হতে পারে না। নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি চীনা প্রতিনিধি মত দেন, নিরাপত্তা পরিষদ সৃষ্টি করা হয়েছে বিশ্ব শান্তি বজায় রাখার জন্য। এটি খুবই দুঃখজনক হবে, রাষ্ট্রভাগের নাম করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে জাতিসংঘ নিজেই যদি যুদ্ধের কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এমন পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ১৫ মে ১৯৪৮ ফিলিস্তিনের ওপর তাদের ম্যান্ডেট অবসানের ঘোষণা দেয়। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করায় দ্রুত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশন আহ্বানের প্রস্তাব পাস করে নিরাপত্তা পরিষদ। উদ্বেগাকুল এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ১৪ মে ১৯৪৮ ইহুদিরা একতরফাভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। তাদের ঘোষণার ভিত্তি হিসেবে সাধারণ পরিষদের ১৮১ নং সিদ্ধান্তকে উল্লেখ করে যেখানে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের কথা রয়েছে। আশপাশের আরব দেশগুলো ইসরায়েলের এ সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে হামলা চালালে ইসরাইল, ফিলিনিনের পুরোটাই দখল করে নেয় (শুধু গাজা মিসরের দখলে, এবং পশ্চিম তীর জর্ডানের দখলে ছিল)।
আরব এবং ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমাগত তিক্ততা এবং সীমান্তে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ১৯৬৭ সালে আবার আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়। পাঁচ দিনের যুদ্ধে মিসর, সিরিয়া এবং জর্ডানের সেনাবাহিনী ইসরায়েলের কাছে পরাস্ত হয়। ইসরায়েল গাজা উপত্যকা, মিসরের সিনাই মরুভূমি, সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে। এই প্রথমবারের মতো জেরুজালেম ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে।
সেখান থেকে বহু ফিলিস্তিনিকে বিতাড়িত করা মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনার যত আলোচনা পাঁচ যুগ ধরে হয়ে এসেছে, সেগুলোতে শান্তি আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে ১৯৬৭ সালের আগের অবস্থানে ইসরায়েলের পিছু হটার কথা বলা হয়েছে।
ইসরায়েল একের পর এক জাতিসংঘের প্রস্তাব উপেক্ষা করে ১৯৬৭ সালে দখল করা ফিলিস্তিনি ও আরব ভূমি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এরপর ১৯৮০ সালে ইসরায়েল আবার পূর্ব জেরুজালেমের দখলী অংশকে ইসরায়েল সম্প্রসারিত অঞ্চল হিসেবে অধিগ্রহণের কথা ঘোষণা করে। ওই বেআইনি অধিগ্রহণকে নিরাপত্তা পরিষদ (৩০ জুন ১৯৮০, প্রস্তাব ৪৭৬) বাতিল বলে ঘোষণা করে। ইসরায়েলই হচ্ছে একমাত্র রাষ্ট্র, যার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিশ্বশক্তিগুলো নির্বিকার। ইসরায়েল জাতিসংঘের প্রস্তাবিত ৫৬ শতাংশ ভূমির বাইরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রর জন্য প্রস্তাবিত এলাকায় নতুন ইহুদি বসতি নির্মাণ শুরু করে। ইতিমধ্যে সাবেক ফিলিস্তিনের প্রায় ৮০ শতাংশ দখল করে নিয়েছে।
পূর্ব জেরুজালেম, গাজা এবং পশ্চিম তীরে যে ফিলিস্তিনিরা থাকে, সেখানে নতুন করে ইহুদি বসতি স্থাপনকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলিদের উত্তেজনা প্রায়শই চরমে ওঠে। সম্প্রতি পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জাররাহ হতে কিছু ফিলিস্তিনি পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি ফিলিস্তিনিদের আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। পবিত্র রমজানের শুরু থেকে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। তখন প্রায় প্রতিরাতেই ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ চলছিল। এরই পরিণতিতে ইসরায়েল বর্বর আগ্রাসন শুরু করে।
অভ্যুদয়ের পরই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ইসরায়েলকে দখলদার হিসেবে অভিহিত করে স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আরব রাষ্ট্রগুলো পাকিস্তানের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছে। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার তখনও ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরবদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে পিছপা হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ইসরায়েলের ভূমিকা ছিল বিস্ময়কর। Jewish Telegraphic Agency (JTA)-এর ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি Daily News Bulletin-এ `Israel Recognizes Bangladesh’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের ভাষ্য অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র কয়েক সপ্তাহের (একটি সূত্রমতে ৩৩ দিনের) মাথায় ইসরায়েল প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। সংবাদে প্রকাশ বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে ইসরায়েল এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বরাবর একটি চিঠি পাঠায়। একাত্তরের ২ জুলাই ইসরায়েলি পার্লামেন্ট বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বেপরোয়া ধ্বংসলীলায় নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়। এমনকি ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারের অনুরোধে ইসরায়েলি রেডক্রস বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ওষুধ, কাপড় ও খাবার পাঠায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় লাভের পর প্রথম যেসব রাষ্ট্র বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় ইসরায়েল তাদের অন্যতম। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েল বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করে। নবপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি খুবই প্রয়োজন ছিল। তদুপরি দুটি যুদ্ধে আরব বিশ্বকে পরাজিত করে ইসরায়েল বেশ শক্তিশালী রাষ্ট্র। ইসরায়েলের সঙ্গে বিশ্বের অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্রের দহরমমহরম। তবু বাংলাদেশে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি জোরালো সমর্থন অব্যাহত রাখতে এবং মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি হোক এমন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে ইসরায়েলের স্বীকৃতি গ্রহণ করেনি। ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারির অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জনকে সমর্থন করা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অতিগুরুত্বপূর্ণ নীতি।
১৯৬৭ সালে নির্ধারিত সীমানা অনুযায়ী জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে সমর্থন করে বাংলাদেশ। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে মেডিক্যাল টিম ও ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সহায়তা করে। ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ১৯৭৪ সালে লাহোরে ওআইসির দ্বিতীয় সম্মেলনের সময় ইয়াসির আরাফাত ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৈঠকের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে প্রথম উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তার প্রথম ভাষণে, ১৯৭৪ সালে ওআইসির দ্বিতীয় সম্মেলনে এবং ১৯৭৩ সালে চতুর্থ ন্যাম সম্মেলনে ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রাম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। ঢাকায় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর কার্যালয় স্থাপনের অনুমতি প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও পিএলওর মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। বাংলাদেশ সরকার ফিলিস্তিনি ছাত্রদের বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ফিলিস্তিনের সামরিক সদস্যদের বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সামরিক সম্পর্কও তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ যেমন ইসরায়েলের স্বীকৃতি গ্রহণ করেনি তেমনি গত ৫০ বছরে ইসরায়েলকেও বাংলাদেশ স্বীকৃতি দেয়নি। বাংলাদেশের পাসপোর্টে স্পষ্টভাবে উৎকীর্ণ রয়েছে, ‘This Passport is valid for all countries of the world except Israel.’ উপরন্তু, বাংলাদেশি নাগরিকদের ইসরায়েল ভ্রমণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে সব রকম বাণিজ্য (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ) সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্কও নেই।
বাংলাদেশ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ক্রমাগত ও জোরালো সমর্থক এবং ইসরায়েলের দখলদারির বিরোধিতাকারী। এরই ধারাবাহিকতায় ইসরায়েলের চলমান বর্বরোচিত আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী লিখিতভাবে প্রতিবাদ করেছেন। ইসরায়েলি হামলায় হতাহত ব্যক্তিদের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানিয়ে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাসকে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি আল-আকসা মসজিদ কমপ্লেক্সে নিরীহ মুসলমান এবং বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার গভীর দুঃখ এবং উদ্বেগ প্রকাশ করছি।’ প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দার পাশাপাশি হামলার শিকার ফিলিস্তিনিদের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন। ফিলিস্তিনসহ সারা বিশ্বের যেসব স্থানে এই ধরনের ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো বন্ধে টেকসই ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন।
শেখ জাররাহ এলাকা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে ইসরাইলের দখলের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করে সেই এলাকা দখল করে ইসরাইলি বাহিনী মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন করেছে। চিঠিতে ফিলিস্তিনের রাজধানী পূর্ব জেরুজালেমসহ ১৯৬৭ সালের সীমান্তের ওপর ভিত্তি করে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থানও পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশ বিশ্বাস করে সংঘাত, সহিংসতা, দখলদারি ফিলিস্তিন বা মুসলিম সম্পর্কিত বিষয় নয়; বিষয়টি মানবাধিকার ও মানবিকতার। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে সংগ্রামরত মানুষকে সব সময় সমর্থন দিয়েছেন। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান ও দ্বিরাষ্ট্র নীতির ভিত্তিতে একটি স্বাধীন ও টেকসই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবির পক্ষে উচ্চকিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার রক্ষায় এবং জাতিসংঘ প্রস্তাব, আরব পিস ইনিশিয়েটিভ ও কোয়ার্টেট রোডম্যাপের আলোকে স্বাধীন, সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফিলিস্তিন সংকটের একটি টেকসই এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।
অনেক মুসলিম দেশ ইতিমধ্যে ফিলিস্তিনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে কিংবা গোপনে ইসরায়েলের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক তৈরি করেছে, কিন্তু বাংলাদেশ বিশ্বাসভঙ্গ কিংবা কোনো ভান-ভনিতার আশ্রয় নেয়নি। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ইসরায়েলি দখলদারি ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে অটল রয়েছে।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।