১৭ মে বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক স্মরণীয় দিন। ৬ বছর স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকার পর ১৯৮১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্বদেশে ফিরে আসেন। নির্বাসিত নেত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া বাংলাদেশ ও ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে ফিরে পাননি। যেই বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, যেই তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী না হলে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ৯ মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না- সেই মুজিব-তাজউদ্দীনরা তখন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ।
পাকিস্তানের প্রেতাত্মা জেনারেল জিয়াউর রহমানের ৬ বছরের স্বৈরশাসনে মুজিবের বাংলা পাকিস্তানের আদলে মিনি পাকিস্তানে পরিণত হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে পাকিস্তানিদের স্লোগান জিন্দাবাদ চালু হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন বলেই জিয়া-এরশাদ-খালেদা গংয়ের ছিনতাই করা বাংলাদেশকে বাংলার মানুষ পুনরায় ফিরে পেয়েছে। শেখ হাসিনা নেতৃত্বে এসেছেন বলেই আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং জাতির পিতাকে হত্যার ২১ বছর পর স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।
আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হত্যার জন্যই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের সদস্যসহ স্বাধীনতার মহানায়ক শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়। জাতির পিতা হত্যার ৭৯ দিনের মাথায় স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতাকে ৩ নভেম্বর হত্যার পর পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর ক্ষমতায় আনা হয় জিয়াকে। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা তাদের আড়াই দশকের শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে হত্যার মাধ্যমে একাত্তরের ঘাতক স্বাধীনতাবিরোধীদের রামরাজত্ব কায়েম করে।
শেখ হাসিনা ১৭ মে স্বদেশে ফিরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুই দশক আন্দোলন-সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার করেন।
১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে ৬ বছর নির্বাসিত থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু কন্যা সর্বসম্মতিক্রমে দলের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে লাখ লাখ মানুষ তাকে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জানায়। ওই দিন ঢাকায় আরেক ১০ জানুয়ারির পুনরাবৃত্তি হয়।
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে গণবিরোধী স্বৈরশাসনের ভিত কেঁপে ওঠে। বঙ্গবন্ধু কন্যার আগমনের পর ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ছিনতাইকৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বাঙালি জাতি। এমনিভাবে ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, ১০ জানুয়ারির মতো ১৭ মে বাংলা ও বাঙালির কাছে ঐতিহাসিক দিন।
ওই সময় শেখ হাসিনার স্বদেশে ফিরে আসাটা ছিল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল হোতা জিয়াউর রহমান তখন রাষ্ট্রক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক-রশিদ ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা দেশেই অবস্থান করছে।
নেত্রী দেশে এলে জিয়া-ফারুক-রশিদচক্র যে তাঁকে যে-কোনো মূল্যে হত্যার ষড়যন্ত্র করবে, এতে কোনো সন্দেহ ছিল না। নেত্রীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের তারিখ ঠিক হলে জিয়াচক্র তা বানচাল করার অপচেষ্টা শুরু করে। বিভিন্নভাবে ওই চক্রটি চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চালায়। সারা দেশে অসংখ্য লিফলেট-হ্যান্ডবিল ইত্যাদি বিলি করে স্বদেশে ফেরার প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়।
নেত্রীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবরে উদ্বিগ্ন জিয়াচক্রের বিষয়টি ড. ওয়াজেদ মিয়ার গ্রন্থেও উঠে এসেছে। ড. ওয়াজেদ তাঁর আত্মজীবনীমূলক সেই ঐতিহাসিক গ্রন্থে লিখেছেন-
“শনিবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন সকালে নাশতা খাওয়ার সময় হাসিনা আস্তে আস্তে বলে, ‘ইতিমধ্যে পাকিস্তানপন্থী এবং জিয়ার রাজনৈতিক দল সারা বাংলাদেশে লিফলেট, হ্যান্ডবিল ইত্যাদি বিলি করে আমার ঢাকায় ফেরা যে কোনোভাবেই হোক প্রতিরোধ করার ডাক দিয়েছে। আমার মনে হয় জয়-পুতুলকে নিয়ে আমার ঢাকায় ফেরা সমীচীন হবে না।”
তাছাড়া জিয়াচক্র তার সাড়ে ৫ বছরের শাসনামলে ৩০ লাখ শহিদ ও চার লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন বাংলাদেশকে পুরোপুরিভাবে পাকিস্তানি আদর্শ ও ভাবধারায় নিয়ে যায়। জিয়ার বাংলাদেশ এবং পরাজিত পাকিস্তানের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না বললেও অত্যুক্তি হবে না। সেই কঠিন পরিস্থিতিতে অসম সাহসী মুজিবের দুঃসাহসী কন্যা পিতার মতোই নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার মানসে ১৭ মে স্বদেশে ফিরে আসেন।
রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ১৯৬৭ সালে বিয়ের পর থেকে শেখ হাসিনা সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। শেখ হাসিনা স্বেচ্ছায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেননি। ১৯৭৭ থেকে ’৮১- পর পর তিনটি কাউন্সিলে গ্রুপিং, স্লোগান-পাল্টা স্লোগান- এসব ছিল শীর্ষ নেতৃত্বের সীমাহীন ব্যর্থতা। এরই মধ্যে স্বৈর-সামরিক শাসক ও পাকিস্তানপন্থিদের প্রতিনিধি জেনারেল জিয়ার প্ররোচণায় ১৯৭৮ সালে মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ভাগ হয়ে যায়।
১৯৭৯-এর ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের প্রাক্কালে ওই বিভক্তি দলকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। এতকিছুর পরেও আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে ৩৯ আসন পেয়ে সংসদে বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়।
শেষ পর্যন্ত দলের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই শেখ হাসিনাকে সভানেত্রী করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। এদিকে সভানেত্রী হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ প্রায় চার যুগ ধরে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চলছে। মৃত্যু-ঝুঁকি নিয়েই তিনি রাজনীতি করছেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হওয়ার জন্য শেখ হাসিনার আকাঙ্ক্ষা বা প্রস্তুতি কোনোটাই ছিল না। আসলে নিয়তিই বঙ্গবন্ধুকন্যাকে রাজনীতিতে নিয়ে এসেছে।
তার সাহসী নেতৃত্বের জন্যই একাত্তরের ঘাতকদের বিচার ও ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। তার সাহস ও প্রজ্ঞার কারণেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর ওই নির্বাচনের জন্যই বাংলাদেশে আজও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রয়েছে। তার কারণেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হয়েছে।
বাংলা ও বাঙালির কাছে ১৭ মে নেত্রীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের তাৎপর্য অপরিসীম। শেখ হাসিনা নেতৃত্বে আছেন বলেই আওয়ামী লীগ আজ ঐক্যবদ্ধ। আর আওয়ামী লীগ রয়েছে বলেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বাংলাদেশকে এখনো ‘মিনি পাকিস্তান’-এ রূপান্তরিত করতে পারেনি। তাই যতদিন এ দেশের মানুষ বেঁচে থাকবে, ততদিন ১৭ মে নেত্রীর প্রত্যাবর্তনের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক; কলাম লেখক