সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির অধিকার বাস্তবায়নে আপসহীন লক্ষ্য নিয়ে শত নির্যাতন, জেল-জুলুম, ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার এক দুর্দম লড়াই করেন। সুদীর্ঘ ২৩ বছরের লড়াই সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হলো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা, গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতাবিরোধী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ইতিহাসের নৃশংসতম অধ্যায় সৃষ্টি করল।
এর পর নানা ইতিহাস। শুরু হলো আওয়ামী লীগ কর্মীদের হত্যা, ঘরছাড়া এবং দল ভাঙার এক গভীর ষড়যন্ত্র। কর্মীরা দিশেহারা, পথহারা, কিছু নেতা ক্ষমতার সঙ্গে মিশে গেল। মূলধারার নেতৃবৃন্দ হিমশিম খাচ্ছে ভাঙন ঠেকাতে, নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে। এমন সময়ে ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশন। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা শত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বুকের ভেতর কষ্ট-যন্ত্রণা নিয়ে পিতার হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে আন্তর্জাতিক কমিশন গঠন এবং বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে ব্যস্ত।
কাউন্সিলে অনেক আলাপ আলোচনার পর জাতীয় ও দলীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তার একটি বার্তা সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক সম্মেলনে পাঠ করে শোনান। শেখ হাসিনা তার বার্তায় সব রকমের দ্বন্দ্ব-বিভেদ ভুলে আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে কাউন্সিলর ও নেতাদের বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচি বাস্তবায়নের আহ্বান জানান। কাউন্সিলরা সেদিন এক ধরনের স্বস্তি এবং আশা এবং আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
শেখ হাসিনার ফেরার দিনে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে সেদিন জনসমুদ্রে শেখ হাসিনা বলেছিলেন-
“সব কিছু হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে ফিরে এসেছি। বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের সঙ্গে থাকতে চাই।” কুর্মিটোলা থেকে শেরেবাংলানগর পর্যন্ত ৮ মাইল সময় লাগার কথা বেশি হলেও ৩০ মিনিট। প্রায় তিন ঘণ্টায় শেখ হাসিনা শেরে বাংলানগরে পৌঁছলেন। ঝড়বৃষ্টিতে নগর জীবন প্রায় বিপন্ন, রাস্তা-ঘাটে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়ে গেছে। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে শেরে বাংলানগরে অপেক্ষায় থাকেন লাখ লাখ মানুষ। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় তিনি মানিক মিয়া এভিনিউর গণসংবর্ধনা মঞ্চে এলেন।
গণসংবর্ধনায় ভাষণদানকালে শেখ হাসিনা বলেন, “বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমি জীবন উৎসর্গ করে দিতে চাই। আমার আর কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। সব হারিয়ে আমি এসেছি আপনাদের পাশে থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য।” আনন্দঘন ও হৃদয়বিদারক এ অনুষ্ঠানে কর্মীরা মুহুর্মুহু নানা স্লোগানে মুখরিত করে রেখেছিল- ‘শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব’, জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, শুভেচ্ছা স্বাগতম, ঝড়বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে। শেখ হাসিনা সেদিন বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। কর্মীদের চোখেও ছিল অশ্রুধারা। তখন সময়টা খুব খারাপ ছিল।
পঁচাত্তরের খুনিরা তখনও তৎপর সব জায়গায় ওত পেতে আছে। এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকন্যা পিতার পথ ধরে জীবনের সকল ঝুঁকি নিয়ে শুরু করলেন বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। সেদিন তিনি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন না করলে এতদিনে দেশ পুরোপুরি পাকিস্তানের মতো স্বৈরাচারী, বিশৃঙ্খল ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হতো। শেখ হাসিনা সে অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছেন এবং বাংলার মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় অভিষিক্ত করেছেন।
৭ মে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন দিবসটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসের জন্য একটি বিশেষ দিন। শেখ হাসিনা যদি সেদিন তার একক সিদ্ধান্তে ফিরে না আসতেন তবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য আর কতদিন লড়াই করতে হতো, কত মানুষের আবারও জীবন দিতে হতো তা ভাবাই যায় না।
‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’- ৮১ থেকে ৯০ পর্যন্ত দীর্ঘ আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন শেখ হাসিনা এবং প্রধান শক্তি ছিল তার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সঙ্গে সহযোগী সংগঠনসমূহ। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নৈরাজ্য, অনাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
এবার বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৪০ বছর পূর্ণ হলো। তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে ঢাকার মাটি ছুঁয়ে যে কথা দিয়েছিলেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন। একইভাবে সেদিন ঢাকা শহরে লাখ লাখ কর্মী শপথ নিয়েছিলেন; দেশের সকল পরিস্থিতিতেই তাদের মায়ের মতো, বোনের মতো নেত্রীকে আগলে রাখবেন সেটিই তারা প্রমাণ করেছেন। আজকে সংকটাপন্ন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আবহে, হাজার বছরের বাঙালি কৃষ্টি সংস্কৃতির অবগাহনে ফিরে পেয়েছে বাংলাদেশের প্রাণ। শেখ হাসিনার চারবার দেশ পরিচালনার মাধ্যমে বাংলাদেশ আজকে বিশ্বের বিস্ময়।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আকাশ-সমুদ্র, সীমান্ত বিজয় পূর্ণ হয়ছে। এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো সকল শর্ত পূরণ করে বাংলাদেশ উন্নয়শীল দেশে পর্দাপণ করেছে।
বাংলাদেশের মাথা পিছু আয় এখন ২০৬৪ ডলার। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা, সৎ, যোগ্য, কর্মঠ, মানবতাবাদী গণতান্ত্রিক নেতা। গণতন্ত্রের মানসকন্যা এখন গণতন্ত্রের মূর্তপ্রতীক।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন, গণতন্ত্রের এ ধারা অব্যাহত রাখার জন্য, দেশকে একটি সম্পূর্ণ কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত করার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য আজকে দেশের মানুষের সামনে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। সকল বিবেচনায় পরিস্থিতিটা এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যে, শেখ হাসিনা বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।
লেখক: চিকিৎসক, সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়