বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শেখ হাসিনার কৌশলের কাছে পরাজিত অপশক্তি

  •    
  • ১৭ মে, ২০২১ ১৭:৪৫

যারা ভেবেছিলেন বাংলাদেশে মুজিব হত্যার বিচার হবে না, আওয়ামী লীগ আর কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারীদের বিচার হওয়া সম্ভব নয়, তাদের ভুল প্রমাণ করেছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে আর সবাই পরাজিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যেমন তার সময়ের অন্য সব রাজনীতিকের ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন, শেখ হাসিনাও তেমনি তার সময়ে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। কাজটি অবশ্যই সহজ ছিল না। ঘরে-বাইরে বৈরিতা ছিল এবং আছে।

৩৬৫ দিনে এক বছর। রাজনীতির ইতিহাসে প্রতিটি দিন বা বছরের সবগুলো মাস সমান গুরুত্ব বহন করে না। একেকটি তারিখ একেক কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকে। কোনোটা তারিখ বা দিন হয়তো আনন্দের আবার কোনোটা বেদনার। আমাদের দেশের রাজনীতি ঘটনাবহুল। তাই বছরের অনেকগুলো মাস এবং ওইসব মাসের কিছু তারিখ আমাদের আলোড়িত করে, তাড়িত করে, আবেগ আপ্লুত করে কিংবা বিষাদ-ভারাক্রান্তও করে। ১৭ মে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তেমনি একটি উল্লেখযোগ্য দিন। সেদিন শেখ হাসিনা ছয় বছর পর দেশে ফিরে এসেছিলেন, আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে। তার এই স্বদেশফেরা পঁচাত্তর-পরবর্তী দেশের রাজনীতির আবহ বদলে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল।

শেখ হাসিনা নিজে হয়ত কখনও ভাবেননি যে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হবেন। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন, কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভানেত্রীও নির্বাচিত হয়েছেন। অত্যন্ত কাছে থেকে দেখেছেন পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন। জেল-জুলুম-অত্যাচার-মামলা উপেক্ষা করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর প্রাণপাত ধারাবাহিক সংগ্রাম। কিন্তু তিনিও রাজনীতির পিচ্ছিল পথে হাঁটবেন, সেটা হয়তো ভাবনায় সেভাবে ছিল না। অথচ তাই হলো। কীভাবে তিনি জড়িয়ে পড়লেন রাজনীতির সঙ্গে?

১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের ঐক্য ধরে রাখার বৃহত্তর প্রয়োজনে বাধ্যতামূলক নির্বাসনে থাকা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল। তিনি দেশে ফিরেছিলেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের লালচোখ উপেক্ষা করে দেশে ফিরে রাজনীতিতে নতুন ইতিহাস গড়ার কারিগর হতে আত্মনিয়োগ করলেন। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তাই রাজনীতির বাইরের মানুষ তাকে বলা যাবে না। তবে রাজনীতির মঞ্চে তার আরোহণ স্বাভাবিক পথে হয়নি। বিশেষ অবস্থায়, বিশেষ প্রয়োজনে তিনি নৌকার হাল ধরেন।

১৯৮১ থেকে ২০২১। চার দশকের এই পথপরিক্রমা তাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। যাত্রাপথ অবশ্যই ফুল বিছানো ছিল না। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে চলতে হচ্ছে তাকে। এখনও তিনি দলকে, দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। ইতিহাস যেন তার কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে অনেক দায় ও দায়িত্ব। দায়িত্ব পালনে তিনি ক্লান্তিহীন যোদ্ধা।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে নির্মম হত্যাকণ্ডের দিন শেখ হাসিনা এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। ১৫ আগস্ট তারা দেশে থাকলে তাদেরও পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো পরিণতি বরণ করতে হতো। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল একটি সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক লক্ষ্য ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য।

ঘাতকচক্র এবং তাদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মদতদাতা ও পৃষ্ঠপোষকরা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে উলটো ধারায় নিতে চেয়েছে। তারা প্রাথমিকভাবে সফলও হয়েছে। যে পাকিস্তানি ধারাকে পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়, সেই পরাজিত ধারায় দেশকে নিয়ে যাওয়াই ছিল ঘাতক এবং তাদের মুরুব্বিদের লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধু হত্যার ছয় বছর পর শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসা ছিল ওই খুনিচক্রের বিরুদ্ধে প্রথম কার্যকর প্রতিবাদ। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের বজ্রমুঠি শিথিল হওয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতার শুরু।

শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান যখন ঢাকার মাটি স্পর্শ করে তখন আকাশ ভেঙে নেমেছিল বৃষ্টি। বিমান থেকে মাটিতে নেমে শেখ হাসিনা কান্না থামাতে পারেননি। আবেগতাড়িত হওয়াই ছিল তার জন্য স্বাভাবিক। একদিন আকাশের কান্না, আর একদিকে শেখ হাসিনার কান্না- দুইয়ে মিলে গ্লানি মোচনের এক বিশেষ মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে রাষ্ট্রটির জন্ম দিয়েছিলেন, সেই রাষ্ট্র তার জীবন রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। নিজের পরিচর্যায় আন্তরিক দরদে গড়া দল, আওয়ামী লীগ, যে দল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, সে দলটিও মুজিব-হত্যার আকস্মিকতায় ছিল হতবিহ্বল। তারাও কোনো কার্যকর প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির সম্মিলিত ব্যর্থতা খুনিদের উল্লাস নৃত্য দেখতে বাধ্য করেছিল গোটা জাতিকে।

নেতার লাশ যখন রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে পড়ে ছিল, তখন তারই অনুসারী হিসেবে পরিচিত খন্দকার মোশতাকসহ অনেকেই চরম কাপুরুষতা দেখিয়ে নতুন মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছে। তারপর নানা ঘটনাধারায় সময় গড়িয়েছে। উত্থানপতন চলেছে ক্ষমতা দখলকারীদের মধ্যেও।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় চারনেতাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে মূলত নেতৃত্বশূন্য করা হয়েছিল। হতোদ্যম, হতবল আওয়ামী লীগ আবার সংগঠিত হোক, শক্তি অর্জন করুক, সেটাও চায়নি ক্ষমতাদখলকারীরা।

দেশের রাজনীতি যখন চরম এক অনিশ্চয়তার মুখে, জাতির পতাকা যখন ‘খামচে ধরেছে পুরনো শকুন’ – ঠিক সেই সময় আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন শেখ হাসিনা। যার রক্তে বহমান শেখ মুজিবের রক্ত। পিতা মুজিব চাননি তার কন্যা রাজনীতির ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথে হাঁটুক, তাই তার বিয়ে দিয়েছিলেন একজন বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সেই কন্যাকেই হতে হলো পিতার স্বপ্ন পূরণের কঠিন পথের পরিব্রাজক। শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্ব নেয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্য যে আবেগ ও উচ্ছ্বাস তৈরি হয়, তা আরও বেগবান হয় এক বৈরী পরিবেশে দেশে ফিরে আসায়।

শেখ হাসিনা যাতে দেশে ফিরে আসতে না পারেন, তিনি যাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিতে না পারেন, তার জন্য নানা ঘোট পাকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন জিয়া এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা। শেখ হাসিনার সাহস ও দৃঢতার কাছে পরাভূত হয়েছে ষড়যন্ত্রকারীরা। আওয়ামী লীগের মধ্যেও বিভীষণ ছিল, ছিল মোশতাকের প্রেতাত্মা । কিন্তু তারা সুবিধা করতে পারেননি শেখ হাসিনা এবং তৃণমূল পর্যায়ের মুজিবভক্তদের জীবনপণ ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞার কাছে।

১৯৮১ সালের বৃষ্টিস্নাত ১৭ মে শেখ হাসিনাকে বরণ করার জন্য জনতার ঢল নেমেছিল। যারা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হারিয়ে দুফোঁটা চোখের জল ফেলতে পারেননি, তারা ১৭ মে অকাতরে চোখের জল ঢেলে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন যেন। শেখ হাসিনার দেশে ফেরার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও তাৎক্ষণিকভাবেই তৈরি হয়েছিল পরিবর্তনের অভিঘাত। মুক্তিযুদ্ধের হারানো চেতনাকে ফিরিয়ে আনার রাজনীতি বলবান হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল।

শেখ হাসিনা বাবার মতো রাজনীতিতে সাফল্য দেখাতে পারবেন কি না তা নিয়ে শুরুতে কারো কারো মধ্যে সংশয় ছিল। রাজনীতি থেকে যিনি নিজেকে পিতার ইচ্ছায় দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন, তিনি পিতার রাজনীতির ধারা এগিয়ে নিতে পারবেন কি না সে প্রশ্নও ছিল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই শেখ হাসিনা প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, তার ধমনীতে শেখ মুজিবের রক্ত বহমান, তাই তিনি পরাজয় মানতে জানেন না।

যারা ভেবেছিলেন বাংলাদেশে মুজিব হত্যার বিচার হবে না, আওয়ামী লীগ আর কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারীদের বিচার হওয়া সম্ভব নয়, তাদের ভুল প্রমাণ করেছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে আর সবাই পরাজিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যেমন তার সময়ের অন্য সব রাজনীতিকের ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন, শেখ হাসিনাও তেমনি তার সময়ে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। কাজটি অবশ্যই সহজ ছিল না। ঘরে-বাইরে বৈরিতা ছিল এবং আছে। সব মোকাবিলা করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার এক বিরল কৃতিত্বের অধিকারী এখন শেখ হাসিনার।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন শেখ হাসিনা। রাজনীতিবিদরা সাধারণ ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিতে অভ্যস্ত। ক্ষমতার বাইরে থেকে যা বলেন, ক্ষমতায় গিয়ে তা করেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা এখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি যা বলেন, তা করেন। চাপ দিয়ে, আন্দোলনের নামে সহিংসতা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে নমনীয় করা যায়নি, যায় না।

তিনি যেটা সঠিক মনে করেন, সেটা বাস্তবায়িত করার জন্য যে যে পদক্ষেপ নেয়া দরকার তিনি তা নিতে পিছপা হন না। তবে তাকে কখনও কখনও কৌশলী হতে হয়, সময় ও সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তাতে কারো কারো মধ্যে সংশয়ও হয়ত তৈরি হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত শেখ হাসিনা তার নিজের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দৃঢ়তা দেখাতে ভুল করেন না। তার গৃহীত পদক্ষেপ সবাইকে নিশ্চয়ই খুশি করে না। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত সমাজে রাজনীতিতে একমত একপথ হয়ে চলা সহজ নয়। তবে শেখ হাসিনার হাত ধরে রাজনীতিতে অস্থিরতা অনেকটাই দূর হয়েছে।

শেখ হাসিনাকে যদি সময় ও সুযোগ দেয়া যায় তাহলে তিনি সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন। তিনি পর পর তিনবার দলকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করে তার রাজনৈতিক কৌশলের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন। রাজনীতি মূলত নীতি ও কৌশলের খেলা। কৌশলে তিনি শতভাগ জিতেছেন। তবে দেশে নীতিহীনতার রাজনীতি প্রকট হয়ে উঠেছে। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। রাজনীতি পরিণত হয়েছে কেনাবেচার পণ্যে। রাজনীতির ব্যবসা অনেকের ভাগ্য বদলে সহায়ক হয়েছে। এটা দুঃখজনক। রাজনীতি নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব অনেকের মধ্যেই প্রবল। নষ্ট রাজনীতি নিয়ে হতাশাও ব্যাপক। সেজন্য এখন ক্ষমতার রাজনীতির পাশাপাশি নীতির রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার সাফল্য দেখার অপেক্ষায় দেশের মানুষ।

করোনাভাইরাস এক অযাচিত চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে এসেছে, তারপরও আশা, যিনি পারেন, তিনি সব বিপদ-দুর্যোগই মোকাবিলা করতে পারেন।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এ বিভাগের আরো খবর