বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অনন্য উচ্চতার ৪০ বছর

  •    
  • ১৭ মে, ২০২১ ১৪:২৪

১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত সরকার পরিচালনায় শেখ হাসিনা গণতান্ত্রিক ধারার চর্চায় সর্বোচ্চ প্রমাণ দিয়েছিলেন। কিন্তু কতগুলো মৌলিক জটিল সমস্যাও সমাধান তাকে করতে হয়েছিল। প্রথমটি ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করে যে অধ্যাদেশ জারি করা হয়, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে (১৯৭৯) যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল সেটিকে রোহিত করা রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন ছিল।

বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে দুটি প্রত্যাবর্তন দিবস বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। প্রথমটি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, দ্বিতীয়টি ১৯৮১ সালের ১৭ মে। প্রথমটি পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র নির্মাণের দায়িত্ব নেয়ার জন্য ঘটেছিল, দ্বিতীয়টি ঘটেছিল তারই কন্যা শেখ হাসিনার জীবনে– যিনি দল ও রাজনীতিতে পিতার শূন্যতা পূরণ করতে বিদেশ থেকে স্বদেশে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে আসার সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের বুলেটে সপরিবারে নিহত হন। সৌভাগ্যক্রমে দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে যান।

বড় কন্যা শেখ হাসিনাকেই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পৌনে ৬ বছর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করতে হয়েছে। শেখ হাসিনার এই প্রত্যাবর্তনের এবার ৪০ বছর পূর্তি। ৪০ বছর তিনি দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন, দলকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছেন।

দুই পর্বে সাড়ে ১৭ বছর সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। তার এই দুই মেয়াদের দায়িত্ব পালনে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনীতি ও উন্নয়ন এখন ইতিহাসের নিরিখে মূল্যায়ন করার যথেষ্ট যৌক্তিকতা ও বাস্তবতা রয়েছে। কারণ তিনি দলের জন্য যেমন শূন্যস্থান পূরণে ভূমিকা রেখেছেন, একইভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনা এবং আর্থসামাজিক সমৃদ্ধি ঘটানোর ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন যা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বাঁক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে। সেই রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের যেসব সদস্য অবস্থান করছিলেন তাদের সকলকেই ঘাতকরা হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় পাকিস্তানি ভাবাদর্শে শাসকদের অধিষ্ঠিত করা। বাংলাদেশ যেন কোনো অবস্থাতেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণহীন রাষ্ট্রব্যবস্থারূপে গড়ে উঠতে না পারে।

বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এমন একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নির্মাণ শুরু করেছিলেন। সেটি আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় একটি গোষ্ঠীর মন:পূত ছিল না। তারা হত্যা-ক্যুয়ের মাধ্যমে তাদের ষড়যন্ত্র অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বাস্তবায়ন করেছিল। ১৫ আগস্ট ছিল সেসব অপশক্তির গোপন ষড়যন্ত্রের হত্যাকাণ্ড। তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর সামরিক স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করে, মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত অপশক্তিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী রাজনৈতিক দলসমূহকে দ্বিধাবিভক্ত করে, নেতৃবৃন্দের অনেককেই হত্যা ও কারারুদ্ধ করা হয়, তৈরি করা হয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতা, আমদানি করা হয় প্রতিক্রিয়াশীলদের, পাকিস্তানি ভাবাদর্শের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে।

এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশ গড়ে তোলা যেন চিরকালের জন্য অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন এক গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চালু করা হয় যার পেছনে পরাজিত পাকিস্তান এবং তাদের মিত্রশক্তিসমূহ ও দেশীয় সাম্প্রদায়িক, উগ্রবাম, উগ্রডান, সুবিধাবাদী, হঠকারী রাজনৈতিকগোষ্ঠী নানাভাবে যুক্ত হয়ে যায়। এদের হাত থেকে রাষ্ট্রক্ষমতাকে মুক্ত করা এবং অসাম্প্রদায়িক ধারার রাষ্ট্র নির্মাণ কতটা কঠিন ও জটিল বিষয়ে পরিণত করা হয়েছিলো সেটি রাষ্ট্র ও রাজনীতির অনেক বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ মানুষের পক্ষেও অনুমান করা বেশ কঠিন ব্যাপার। ১৯৭৫-এর পর থেকে বাংলাদেশ সেরকমই এক উলটো রথে পথ পরিভ্রমণ শুরু করে। এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দল ও রাজনীতিকে সক্রিয় করা, রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে ফিরিয়ে আনা, সেভাবে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা বেশ কঠিন ও জটিল করে ফেলা হলো। তবে ইতিহাস কখনো সরলরেখায় চলে না। এতে অনেক ঘাত ও প্রতিঘাত সৃষ্টি হয়।

প্রকৃত রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এসব পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সক্ষমতা অর্জন করেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে প্রতিহত করতে হয়। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বকে কঠিন চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হয়। তাহলেই কেবল এমন ষড়যন্ত্রের শিকার থেকে রাষ্ট্র ও জনগণকে মুক্ত করা সম্ভব হতে পারে। শেখ হাসিনা যুক্ত হওয়ার পর তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ তেমন এক ভয়ানক পরিস্থিতি থেকে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম, নীতি-কৌশল নির্ধারণ এবং নেতৃত্বের পরিণত ভূমিকার কারণে মুক্তিলাভের পথ খুঁজে পেয়েছে। তবে কোনো অবস্থাতেই ৭৫ পরবর্তী প্রতিক্রিয়াশীল ধারার মূল উৎপাটন যেমন করা যায়নি, তেমনি বাংলাদেশকে এর থাবা ও আক্রমণ থেকে মুক্ত হওয়ার নিশ্চয়তাও সৃষ্টি করা যায়নি।

১৫ আগস্টে ঢাকায় যখন বঙ্গবন্ধুর পরিবার, নিকট আত্মীয়স্বজনদের হত্যা করা হয়, তখন জার্মানিতে স্বামীর সঙ্গে অবস্থানের কারণে শেখ হাসিনা তার দুই সন্তান এবং বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। তবে তাদের বেঁচে থাকাটি ছিল তখন দুর্বিষহ যন্ত্রণাদায়ক এবং দেশে দেশে আশ্রয় খুঁজে বেড়ানোর এক কঠিন অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশে ফেরা তাদের জন্য ছিল নিষিদ্ধ।

ঘাতকরা দেশের ফেরার পথ তাদের জন্য রুদ্ধ করে রাখে। সেই অবস্থায় শেখ হাসিনার স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে অবস্থান করছিলেন দিল্লিতে। দিল্লি অবস্থানকালেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত হয়। ৭৫ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগকে দ্বিধা-বিভক্ত করা হয়। দলটির বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার ও বিদ্বেষ-ঘৃণাবোধ সৃষ্টি করা হয়। দলটি যাতে সংঘবদ্ধ না হতে পারে সেই চেষ্টা ঘাতকদের পক্ষ থেকে করা হচ্ছিল।

সুতরাং, এই সম্মেলন নিয়ে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না এমনটি শাসক ও ঘাতকরা ধরে নিয়েছিল। কিন্তু সম্মেলনের প্রাক্কালে কয়েকজন নেতা শেখ হাসিনাকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দিল্লিতে যান। তার সঙ্গে আলোচনা হয় শেষ পর্যন্ত সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে সভাপতি পদে তার অনুপস্থিতিতেই সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত করা হয়। এই নির্বাচনটি দল ও দেশের জন্য কতটা রাজনৈতিক ভূমিকা রাখবে তখন অনেকে হয়ত ভাবতে পারেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে ৭৫ পরবর্তী সময়ে বিশাল শূন্যতা, নেতৃত্বের অভাব এবং বিরোধকে কাটিয়ে ওঠার এক অবলম্বন হিসেবে তা বিবেচিত হয়।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সাড়ে ৫ বছরে নির্যাতন, জেলজুলুম, ষড়যন্ত্রের শিকার এবং নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে মূলস্রোতে ফিরে আসার এক অবলম্বন খুঁজে পায়। শেখ হাসিনাও দলের এমন আস্থার মর্যাদা দিতে দিল্লি থেকে ঢাকায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তার এই ফিরে আসার সিদ্ধান্তটি খুব সহজ ছিল না। দেশে তার আগমনকে বাধাগ্রস্ত করতে রাষ্ট্রশক্তি ও ঘাতকরা হুংকার ছুড়ছিল। তার জীবনের ওপর আঘাত আসতে পেরে জেনেও স্বামী-সন্তানকে দিল্লিতে রেখে দলের হাল ধরতে ১৯৮১ সালের আজকের এই দিনে ঢাকায় বিমানযোগে অবতরণ করেন।

ঢাকায় তখন তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে লাখ লাখ মানুষ সমবেত হয়। তিনি পৌনে ৬ বছর পর মাতৃভূমিকে স্পর্শ করেন। কিন্তু তার ছিল না বাবা-মা, ভাইদের কেউ। অথচ ৬ বছর আগে যখন তিনি ঢাকা থেকে জার্মানির উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন তখন তারা সবাই জীবিত ছিলেন। আজ তাদের কেউই জীবিত নেই। শোকাহত কান্না ও অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি সমবেত নেতাকর্মীদের মধ্যে নিজেকে যুক্ত করেন। শুরু হয় তার নতুন দায়িত্ব নেয়া এবং পথচলার কঠিন যাত্রা। এই যাত্রাটি পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। অনেক কিছুই তার জন্য নতুন করে জানা, বোঝা এবং ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি সঞ্চয় করার বিষয় ছিল। বলা চলে ৪০ বছর তিনি দলের এই বিধ্বস্ত অবস্থাটিকে নতুন করে টেনে তুলে ধরেছেন। দলের ভেতর ও বাইরে সমস্যার অন্ত ছিল না। রাজনীতিতে তখন ৭৫ পরবর্তী স্বৈরশাসন, সাম্প্রদায়িকতা, আদর্শহীনতা, সুবিধাবাদিতা, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারীদের আস্ফালন, ৭৫-এর ঘাতকদের তাণ্ডব ও ষড়যন্ত্রের আঘাত বার বার তার দিকে নিক্ষেপ করা হচ্ছিল।

বলা চলে প্রায় ৯ বছর তাকে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অভিজ্ঞতার একটি বড় ধরনের পথ অতিক্রম করতে হয়। যখন বাংলাদেশের রাজনীতির ভেতরে লুকিয়ে থাকা সূক্ষ্ম বিভাজনটি অনেকের কাছেই স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু সেটি উদ্ভাসিত হয় ১৯৯১-এর নির্বাচনকালে। বাংলাদেশকে ৩ জোটের রূপরেখায় মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের ধারায় পরিচালিত করার প্রতিশ্রুতি ছিল নামেমাত্র, মানুষকে বুঝতে না দেয়ার। কিন্তু যথারীতি নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ভাষার পরিবর্তে ধর্মের নাম অপব্যবহার করে আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করা হলো, ভারতের দালাল হিসেবে আখ্যায়িত করা হলো, ২৫ বছরের বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তিকে গোলামির চুক্তি বলে আখ্যায়িত করা হলো। সুতরাং, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে ধর্ম ও ভারতবিরোধিতা একাকার হয়ে গেল। ৭৫ পরবর্তী আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধিতার অপপ্রচার ৯১-এর নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের নিয়ামক শক্তি হয়ে গেল। বাংলাদেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধ এই নির্বাচনে হালে পানি পায়নি। বিএনপি জামাতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনীতিতে ৭৫ পরবর্তী প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তির বৈধতা নির্বাচনে প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও রাজনীতি তখন বিজয়ী শক্তির কাছে কতটা পরিত্যাজ্য, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অপরদিকে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে পরিচালিত করার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শনে ছিল না। কিন্তু দায়িত্বটি এই সময়ে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ভূমিকার অন্তর্জাত বিষয় তাই উপেক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না।

বলা চলে এখান থেকে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের রাজনীতি নতুনভাবে বুঝতে এবং কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হয়। তবে এই কবছরে তার সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামে থাকা অনেকেই সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন, নতুন দল গঠন করেছেন, আবার অনেক পোড় খাওয়া, ত্যাগী, দেশপ্রেমিক নেতাকর্মী তার আন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতি তখন ৩টি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি বিএনপি ও জামায়াতকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস এবং সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থার মিত্র শক্তি হিসেবে অবস্থান গ্রহণ করে, অন্যটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারার পুনঃপ্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আগে থেকেই পরিচিত ছিল। এর মধ্যখানে বাম এবং মধ্যপন্থার কিছু দল অবস্থান করছিল। ১৯৯৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাসদ (রব) এবং জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। এতদিন শেখ হাসিনা আন্দোলন-সংগ্রাম ও দল গঠনে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন সেটি তিনি ক্ষমতা লাভের পর প্রয়োগ করার সুযোগ পান।

১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত সরকার পরিচালনায় শেখ হাসিনা গণতান্ত্রিক ধারার চর্চায় সর্বোচ্চ প্রমাণ দিয়েছিলেন। কিন্তু কতগুলো মৌলিক জটিল সমস্যাও সমাধান তাকে করতে হয়েছিল। প্রথমটি ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুহত্যার বিচার বন্ধ করে যে অধ্যাদেশ জারি করা হয়, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে (১৯৭৯) যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল সেটিকে রোহিত করা রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন ছিল।

এমন অমানবিক মৌলিক মানবাধিকার পরিপন্থি আইন সংবিধানে রেখে কোনো দেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করতে পারে না। শেখ হাসিনা সেই কালো আইনটি সংবিধান থেকে রোহিত করার ব্যবস্থা করেন। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুরহত্যার বিচার শুরু করতে আইনগত বাধা থাকেনি। এরপর ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিচুক্তি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে দেশে তিনি দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত সমস্যার সমাধানের পথ উন্মুক্ত করে দিলেন।

দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে জানার সুযোগ করে দিলেন। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতিতে বিরাজমান বাধা দূর করার চেষ্টা করলেন। তবে এই সময় কোটালিপাড়ায় তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায়। দেশে জঙ্গিদের দ্বারা নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা বার বার হতে থাকে। মেয়াদ শেষে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। কিন্তু দেশি-বিদেশি অপশক্তি নির্বাচনে তাকে পরাজিত করার নীলনকশা তৈরি করতে থাকে। সেটিই শেষ পর্যন্ত ঘটে। বাংলাদেশে আবারও স্বাধীনতাবিরোধী রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তাদের শাসনকালে দেশে গণতন্ত্র কতটুকু ছিল, হত্যা খুন, বিরোধীদলীয় নেত্রীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র, বোমাবাজি, অকার্যকর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইত্যাদি কোন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল তা সকলেরই স্মরণে থাকার কথা।

২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ হাসিনা দেশকে ২০২১ সালে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত করার যে রূপরেখা দিয়েছিলেন সেটি ক্ষমতায় আসার পর তিনি বাস্তবায়ন করেন। বাংলাদেশ কার্যত স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয় এবং উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার জন্য যেসব সংস্কার, অবকাঠামোগত পরিবর্তন অপরিহার্য ছিল তা ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর হতে থাকে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জনে বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি, ডিজিটালাইজেশন, শিক্ষা, যোগাযোগব্যবস্থা, বড় বড় মেগাপ্রকল্প ইত্যাদি বাস্তবায়ন করা জরুরি ছিল।

শেখ হাসিনার এই মেয়াদে সেসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নয়নের একটি রোলমডেল হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, রেমিট্যান্স প্রবাহ, সামাজিক নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক সম্প্রসারণ বাংলাদেশে এখন সহজেই দৃশ্যমান। দেশকে এই পর্যায়ে উন্নীত করার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা দেশ ও বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে।

কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত সাফল্য দেখিয়ে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতি বৈশ্বিক এই মহামারিতে এখনও জিডিপি সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনায় তার দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা নিঃসন্দেহে আমাদেরকে স্বস্তির জায়গাতে রেখেছে। শেখ হাসিনা এই সময়ে বিশ্বের অল্প কজন সফল সরকারপ্রধানের অন্যতম একজন হিসেবে মর্যাদালাভ করেছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আত্মমর্যাদাশীল একটি রাষ্ট্রের অভিধা লাভ করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ইতিহাসের মূল্যায়নে অনেক বেশি ইতিবাচক ভূমিকার অবস্থান তৈরি করেছে।

লেখক: গবেষক, অধ্যাপক

এ বিভাগের আরো খবর