গোটা বিশ্বের মুসলমানরা যখন করোনা আতঙ্কের মধ্যে সীমিত পরিসরে ঘরোয়াভাবে ঈদুল ফিতর পালন করেছে, সেখানে ঈদের দিন অনেক ফিলিস্তিনির ঘুম ভেঙেছে বোমার শব্দে। ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের মধ্যে বিরোধ ও সংঘাত গত কয়েক দশক ধরেই চলছে। কিন্তু গেল সপ্তাহে আকস্মিকই সংঘাতের তীব্রতা বেড়েছে। ২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলিদের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের সাত সপ্তাহের যুদ্ধের পর এবারই সবচেয়ে বড় ধরনের সংঘাত হচ্ছে।
গোটা বিশ্বে করোনা পরিস্থিতির অবনতির মুখে খর্ব-শক্তির ফিলিস্তিনের সঙ্গে পারমাণবিক শক্তিধর ইসরায়েলের এই সংঘাত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের মধ্যে এই সংঘাতের অবসান কবে হবে? আর কত নিরীহ প্রাণ বলি হবে?
ইসরায়েলের অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জারাহ এলাকা থেকে বেশ কয়েকটি ফিলিস্তিনি পরিবারের বাস্তুচ্যুত হওয়ার শঙ্কা থেকে এবারের সংঘাতের শুরু। এই পরিবারগুলো যেখানে বসবাস করছে, সেটির প্রকৃত মালিক ইহুদিরা বলে দাবি করে আসছে গাজায় ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের পক্ষের বেশ কটি সংগঠন। ১৯৭২ সাল থেকে আদালতে অনেক মামলা দায়ের করেছে তারা।
ফিলিস্তিনিরা এই ঘটনাকে দেখছে জেরুজালেম থেকে তাদের বাস্তুচ্যুত করার ইসরায়েলি রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ হিসেবে। এ নিয়ে এপ্রিলের শেষদিক থেকে ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ এবং ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী ও পুলিশের সঙ্গে তাদের ছোটখাটো সংঘর্ষ হতে থাকে।
গত বছরের অক্টোবরে ইসরায়েলি আদালতের এক আদেশে চারটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে বাড়ি ছাড়তে বলা হয়।
২ মে তাদের সময়সীমাও বেঁধে দেয়া হয়। পরে দুই দফায় আদালতের ওই আদেশ স্থগিত হয়ে যায়। পরিবারগুলো আদালতের ওই আদেশের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে। ওই আবেদনের শুনানি হওয়ার কথা ছিল এর মধ্য। পরে তা পিছিয়ে গেছে।
সম্প্রতি ইফতারের জন্য ফিলিস্তিনিদের জমায়েতে ওই পরিবারগুলোতে উপস্থিত হলে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়।
ইসরায়েলের সেনাবাহিনী আল আকসা মসজিদে ব্যাপক জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু জুমাতুল বিদার শুক্রবারে আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে জড়ো হন হাজার হাজার মুসল্লি। সেখানে ফিলিস্তিনি পরিবারকে উচ্ছেদের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ করেন অনেকে।
একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে ইসরায়েলি পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে রাবার বুলেট ও স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করে পুলিশ।
অপরদিকে পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করেন বিক্ষোভকারীরা। এই ঘটনার জের ধরে কয়েক দফা মসজিদুল আকসায় হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। এর জবাবে গাজা নিয়ন্ত্রণকারী ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইজরায়েলকে লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালায়। হামাসের রকেট হামলার পর ইজরায়েল গাজায় বিমান হামলা শুরু করে।
ফিলিস্তিনে চলমান অস্থিরতার জেরে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ইহুদি ও ইসরাইলি আরবদের মধ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দেশটি গৃহযুদ্ধের মতো অবস্থায় রয়েছে। ইতোমধ্যেই চার শ’র বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ইজরায়েল সরকার বেশির ভাগ সংঘাতের জন্য আরব মুসলিমদের দায়ী করছে। অন্যদিকে আরবরা বলছে, তারা ইসরাইলি দাঙ্গাবাজদের হাতে আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের ঘরবাড়িতে হামলা চালানো হচ্ছে। এদিকে ইজরায়েল গাজা-ইজরায়েল সীমান্তে বিপুল সৈন্য ও ট্যাঙ্ক জড়ো করছে। হুংকার ছাড়ছে হামাসও।
ইতিহাসের দিকে ফিরলে আমরা দেখতে পাই ১৯৪৮-এ ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের সময় থেকেই তা প্যালেস্টাইন তথা আরব দুনিয়ার সঙ্গে (মার্কিন ও ন্যাটোর মদতে) বার বার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছে। অথচ বিশ শতকের প্রথমদিকেও প্যালেস্টেনীয় ও ইহুদি জাতিসত্তার আন্দোলনের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল।
১৯২০ সালের ফ্রান্স-সিরিয়া যুদ্ধে সিরিয়ার পরাজয়ের পর এই শান্তি ক্রমশ বিঘ্নিত হতে শুরু করে। প্যালেস্টেনীয় জাতিসত্তার আন্দোলনের এই পর্বের অন্যতম রূপকার হজ আমিন আল হুসেইনি প্যালেস্টেনীয় আরবদের নিজস্ব দেশের দাবিকে সামনে নিয়ে আসেন।
এই সময়েই ইউরোপে ফ্যাসিস্টদের ইহুদি বিতাড়ন ও নিপীড়নের অধ্যায় শুরু হলে তারা প্যালেস্টাইনে চলে আসতে থাকেন। প্যালেস্টাইনে বাড়তে থাকা ইসরায়েলি জনসংখ্যার চাপের প্রেক্ষিতে আরব প্যালেস্টেনীয়দের নিজেদের দেশের দাবি সংকটজনক হয়ে উঠছে বিবেচনা করে আমিন হুসেইনি ইহুদি জাতিসত্তার আন্দোলনকে আরব প্যালেস্টেনীয় জাতিসত্তার আন্দোলনের প্রধান শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেন।
বিভিন্ন আরব দেশে আরব প্যালেস্টেনীয় জাতিসত্তার আন্দোলনের সমর্থন তৈরি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই প্যালেস্টানীয় ইহুদি ও প্যালেস্টেনীয় আরবদের মধ্যে বেশ কিছু রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়।
ইতোমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজুড়ে জার্মানিসহ নাৎসী ও ফ্যাসিস্টদের দ্বারা বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাপক ইহুদি বিতাড়ন ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর পরই ইউরোপের নানাদেশ থেকে বিতাড়িত ইহুদিদের পুনর্বাসনের প্রশ্নটি সামনে চলে আসে।
১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ প্যালেস্টাইনকে তিনভাগ করার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যার একটি হবে আরব রাষ্ট্র, একটি ইহুদি রাষ্ট্র ও আলাদা অঞ্চল হিসেবে থাকবে জেরুজালেম, যে ঐতিহাসিক শহর ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম – এই তিন ধর্মেরই অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান। এই ঘোষণার পরদিন থেকেই আরব ও ইহুদিদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়।
ইসরায়েলের বর্তমান আগ্রাসী ভূমিকা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে ভাবিয়ে তুললেও এই রাষ্ট্রটির জন্ম-ইতিহাসের মধ্যেই রয়েছে সংকটের বীজ। বিস্ময়কর হচ্ছে, ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় মিত্র আমেরিকা কিন্তু ইসরায়েলের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল।
ব্রিটিশরা ইজরায়েল ছাড়ার দুদিন আগেও (মানে ইজরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার দুদিন আগে) আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং স্টেট সেক্রেটারি জর্জ মার্শাল ইজরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। ইজরায়েলকে মেনে নিতে চাইছিলেন না মার্শাল, কারণ উনি জানিয়েছিলেন, ইসরায়েলের জন্ম হলে অশান্ত হবে মধ্যপ্রাচ্য। যুদ্ধ হবেই।
এমন অবস্থায় পালেস্টাইনে ব্রিটিশদের আর দুদিন বাকি আছে (১৪ মে, ১৯৪৮)-বেন গ্রুন ট্রুম্যানের কাছে দূত পাঠালেন ইসরায়েলের স্বীকৃতির জন্য। ট্রুম্যান জিউ ভোটব্যাংকের জন্য ইসরায়েলের স্বীকৃতি দিতে চাইলেন।
মার্শাল এসব শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ট্রুম্যানের কাছে জানতে চাইলেন, আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ তিনি চাইছেন কি না। ট্রুম্যান এসব কিছু শুনলেন না- আমেরিকা ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে বলে জানিয়ে দেয়।
সবার আগে ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সব কমিউনিস্ট দেশ। শুধু তাই নয়, প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ, যেটাতে হারলে ইজরায়েল পটল তুলত, সেই যুদ্ধে ইজরায়েলকে অস্ত্র সাহায্য করে চেকোশ্লোভাকিয়াসহ সোভিয়েত ব্লক।
আমেরিকা তখন ইসরায়েলের ওপর ‘অবরোধ’ চাপিয়েছিল। তবে ইজরায়েল গঠনের মূল পরিকল্পনাকারী হচ্ছে ইংল্যান্ড এবং ওখানকার জায়নিস্ট লবি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের যেসব অংশ অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত তা ব্রিটিশদের করায়ত্তে আসে। এর মধ্যে একটা ছিল ম্যান্ডেট ফর প্যালেস্টাইন।
১৮৯৭ সাল থেকেই ইহুদিরা চেয়েছিল নিজেদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে। ১৯১৭ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভূমি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
১৯১৭ সালের নভেম্বরে তুরস্কের সেনাদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে ব্রিটেন। তখন ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য সহায়তা করবে। ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর বিষয়টি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রটস চাইল্ডকে। এতেই সেই কন্ট্রোভার্শিয়াল ‘ন্যাশানাল হোম ফর জুয়িশ পিপলের’ কথা আছে।
১৯৪৮-এর অনেক পরের কথা। এর মাঝে দফায় দফায় বড় সংখ্যায় জুয়িশ মাইগ্রেশান হয়েছে প্যালেস্টাইনে, ইউরোপের বিভিন্ন অংশ থেকে। এতে ওই অঞ্চলের ডেমোগ্রাফি বদলেছে, এবং ডিপসিটেড আরব-জুয়িশ টেনশানের সৃষ্টি হয়েছে।
হিটলার জার্মানি থেকে এই অভিবাসন উৎসাহিত করেছিলেন, জায়নিস্ট ফেডারেশান অফ জার্মানির সঙ্গে হাভারা এগ্রিমেন্ট করে। এতে কথা হয়েছিল ইহুদিরা যদি জার্মানিতে তাদের সব সম্পত্তি ছেড়ে প্যালেস্টাইনে চলে যায়, তার পরিবর্তে তারা ওইসব জিনিসের রিপ্লেসমেন্ট ফ্রিতে পেয়ে যাবে প্যালেস্টাইনে বসে, ঠিক জার্মানের রপ্তানি পণ্যের মতো।
ইজরায়েল রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য কে আসলে দায়ী, এই আলোচনায় উল্লিখিত ভূমিকাটা বাদ দিলে আসল ব্যাপারটাই হারিয়ে যায়।
এর পর ভলগা-যমুনায় বহু জল গড়িয়েছে। ১৯৪৮-এ দুই যুযুধান পক্ষ (ইজরায়েল ও ব্রিটিশ) এখন এক টেবিলে খায়। জিওপলিটিক্সের গতি মেসি-নেইমারের ডজের মতোই চপল। এই ডান দিক তো এই বাঁদিক। কেউ কারো স্থায়ী শত্রু নয়, কেউ কারো স্থায়ী বন্ধু নয়। যে আমেরিকা একদিন ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছিল, আজ তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসঙ্গে অন্য দেশে বোমা ফেলে। তবে ব্রিটিশদের হাতে রোপিত বিষবৃক্ষগুলো এখন আমেরিকার পরিচর্যায় মহিরুহে পরিণত হতে চলেছে।
এটা স্পষ্ট আরব প্যালিস্টেনীয় জাতিসত্তার পূর্ণ মর্যাদা ছাড়া এই চলমান যুদ্ধ ও রক্তক্ষয়ের কোনো স্থায়ী সমাধান নেই। ইজরায়েল মার্কিন ন্যাটো অক্ষ কিছুতেই স্বাধীন ভূখণ্ড ও জাতিসংঘে সদস্যপদসহ আরব প্যালেস্টেনীয়দের দীর্ঘকালের ন্যায্য দাবিকে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। এই প্রত্যাখ্যানই নানা জঙ্গি আক্রমণের দিকে প্যালেস্টেনীয় জাতিসত্তার আন্দোলনকে ঠেলে দেয় ও তাকে অজুহাত করে ইজরায়েল ন্যাটো মার্কিন অক্ষের সমর্থনে পালটা হামলা চালায়।
বস্তুতপক্ষে, ইসরায়েলের মধ্য দিয়ে আরব দুনিয়ায় মার্কিন অক্ষ নিজেদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার কৌশল হিসেবেই ইজরায়েল প্যালেস্টাইন সংঘর্ষকে জিইয়ে রেখেছে। তবে এবার যেভাবে দু পক্ষ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পথে এগোচ্ছে, মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন যেভাবে ‘আক্রান্ত হলে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে’ বলে ইসরায়েলের ভূমিকার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করছেন, তাতে রক্তক্ষয়ের নয়া পর্বের সূচনা হতে পারে এই এলাকায়! যুদ্ধবাজ স্বার্থান্ধ ‘উন্মাদ’দের কারণে মানবজাতিকে আর কতবার রক্তগঙ্গায় ভাসতে হবে, এটাই প্রশ্ন!
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক