প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা যেদিন বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শেখার আছে, সেদিনই ঢাকা-১৮ উপনির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে এই নির্বাচন আরও নিচে নেমে গেছে।
সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই পরিচালক পদগুলোর মতোই সমঝোতার ভিত্তিতে সভাপতি ও সাত সহ-সভাপতি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।এফবিসিসিআইয়ের ২০২১-২৩ সাল মেয়াদি নির্বাচনের সর্বশেষ ধাপে সভাপতি ও সাত সহ-সভাপতি পদে মনোনয়ন জমা নেয়া হয়। আট পদে আটজনই মনোনয়ন জমা দেয়ায় তাদের প্রত্যেককেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করেছে নির্বাচন বোর্ড। গতবারও ভোট দেয়ার সুযোগ পাননি সাধারণ সদস্যরা। কারণ ওই বছরও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন ৪২ পরিচালক।
সভাপতি পদেও তখন একক প্রার্থী ছিলেন একজন। অর্থাৎ বিনা ভোটে বা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার এই ঘটনা এখন দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক চর্চার পথে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা স্থানীয় সরকার এমনকি বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের নির্বাচনেও তার ঢেউ লেগেছে।
আর কোনো নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হোক বা না হোক, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও কমিশনারদের প্রতিটি পদের বিপরীতে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী একাধিক প্রার্থী থাকতেন এবং মেয়র বা চেয়ারম্যান পদে না হলেও কাউন্সিলর ও কমিশনার প্রার্থীদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতো। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এখন এই অনেক কাউন্সিলর ও কমিশনারও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্ন হলো, কেন জাতীয় সংসদ থেকে স্থানীয় সরকার এমনকি বেসরকারি সংগঠনের নির্বাচনেও প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে যাচ্ছেন?
বাংলাদেশের কাছ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শেখার আছে বলে সিইসি যে মন্তব্য করেছেন, সেই যুক্তরাষ্ট্রে কি এরকম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা জয়ী হন? সুদূর মার্কিন মুল্লুকের কথা না হয় বাদ, প্রতিবেশী ভারতে বিশেষ করে করে পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি যে নির্বাচন হলো, সেরকম একটি নির্বাচনও বাংলাদেশে সবশেষ কবে অনুষ্ঠিত হয়েছে—তা মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার মনে করতে পারেন?
নির্বাচনের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়কে যেরকম কটাক্ষ করেছেন, তীর্যক ভাষায় আক্রমণ করেছেন, সেই মোদিই নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরে মমতাকে যে ভাষায় অভিনন্দন জানিয়েছেন, আমাদের দেশে এরকম ফলাফল মেনে নিয়ে বিজয়ীকে অভিনন্দন জানানোর সংস্কৃতি কি গত পঞ্চাশ বছরেও গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে?
যদি না হয়, তাহলে বাংলাদেশের কাছে থেকে নির্বাচনি ব্যবস্থার কোন দিকটি যুক্তরাষ্ট্রের শেখার আছে বলে সিইসি মন্তব্য করলেন?
সিইসির দাবি, ‘যুক্তরাষ্ট্র ৪ থেকে ৫ দিনে ভোট গুনতে পারে না। কিন্তু আমরা ৪ থেকে ৫ মিনিটে গুনে ফেলি।’ কে কত দ্রুত ভোট গুনতে পারে, সেটি যদি একটি ভালো ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মানদণ্ড হয়, তাহলে এটি নিয়ে কথা বলা এবং বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। কারণ ভোট কোন প্রক্রিয়ায় কত দ্রুত গণনা করা যাবে সেটি পুরোপুরি নির্ভর করে প্রযুক্তি এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দক্ষতার ওপর।
ভোটে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকল না, ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারলেন না, বুথের ভেতরে গিয়ে নির্দিষ্ট প্রার্থীর লোকেরা ভোটারদের প্রভাবিত করবেন, নির্বাচনি ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা, প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং অফিসার এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়া প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করলেন, অথচ ভোট দ্রুত গণনা করে নির্বাচন কমিশন তৃপ্তির ঢেকুর তুললে সেটি কোনো ভালো বার্তা দেয় না।
ভারতে অনেক সময় যেদিন ভোট সেদিনই ফলাফল ঘোষণা হয় না। কদিন পরে ঘোষণা করা হয়। এর অর্থ কি এই যে তাদের ভোটিং সিস্টেম বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ?
ভোটের কয়েক দিন পরে ফলাফল ঘোষণা করা হলেও সে দেশে পরাজিত প্রার্থীরা কারচুপির অভিযোগ এনে ভোটের মাঝপথে সরে যান না। সুতরাং, দ্রুত ভোট গণনা করা যায়— শুধু এই যুক্তিতে একটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়ে যায় না।
যদিও সিইসি তখন এ-ও বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের কাছ থেকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের শেখার আছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেও বাংলাদেশের শেখার আছে। প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনি ব্যবস্থার কাছ থেকে বাংলাদেশ কী কী শিখেছে?
যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের নির্বাচনি ব্যবস্থার কাছ থেকে বাংলাদেশ যে ইতিবাচক কিছু শেখেনি তা নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের কথাতেই স্পষ্ট। ঢাকা-১৮ উপনির্বাচনের দিনও তিনি বলেছেন, নির্বাচন মোটেও অংশগ্রহণমূলক হয়নি। বিরোধী দলের কোনো পোলিং এজেন্টকে কোনো কেন্দ্রে দেখা যায়নি। পুরো নির্বাচনি এলাকায় একটি দলের পোস্টার, প্ল্যাকার্ড ও বিলবোর্ড দেখা যায়, যা আচরণবিধি অনুযায়ী নির্বাচনের আগে তুলে ফেলা উচিত ছিল।
মাহবুব তালুকদার বলেছেন, নির্বাচনকে আমি কেবল প্রার্থীর বা দলের জয়-পরাজয় বলে মনে করি না। তার মতে, ‘নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রে উত্তরণের একমাত্র অবলম্বন। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশীদারমূলক ও গ্রহণযোগ্য না হলে ক্ষমতার হস্তান্তর স্বাভাবিক হতে পারে না। নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হলে দেশের স্থিতিশীলতা, সামাজিক অস্থিরতা ও ব্যক্তির নৈরাশ্য বৃদ্ধি পায়।’
একটি নির্বাচন কীভাবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশীদারমূলক ও গ্রহণযোগ্য হয়? এর মানদণ্ডসমূহ কী এবং যখন জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার এমনকি এফবিসিসিআইয়ের মতো সংগঠনের শীর্ষ পদেও একাধিক প্রার্থী থাকেন না, সেই নির্বাচনকে কি আদৌ নির্বাচন বলা যায়?
নির্বাচন মানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন মূলত সিলেকশন। প্রশ্ন উঠতে পারে, কোনো পদে একাধিক প্রার্থী না থাকলে তাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ঘোষণা যেহেতু অসাংবিধানিক বা বেআইনি নয়, সুতরাং কেন একে নির্বাচন বলা যাবে না?
এই যুক্তিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত কাউকে অবৈধ বলার সুযোগ নেই এটা যেমন সত্য, তেমনি কেন একটি পদের বিপরীতে একাধিক প্রার্থী থাকেন না— সেই প্রশ্ন তোলাও সংগত। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কেন এই প্রবণতা বেড়েছে—তারও নির্মোহ বিশ্লেষণ জরুরি।
স্মরণ করা যেতে পারে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও মেয়র পদে একাধিক প্রার্থী না থাকায় নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী। রাজনীতি ও ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় এখানে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের শরিক জাতীয় পার্টির প্রার্থী। কিন্তু তিনিও প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জাপা প্রার্থী বলেছেন, যেহেতু ইকরামুল হক টিটু প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত প্রার্থী, তাই তিনি দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে টিটুকে সমর্থন জানিয়ে ভোটের মাঠ থেকে সরে গেছেন। এর আগে উপজেলা নির্বাচনের চার ধাপে ১০৮ চেয়ারম্যানও বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার এই প্রবণতা গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে কি না এবং এরকম বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা কেন বাড়ছে— সেই প্রশ্নের জবাব খোঁজা দরকার। কারণ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকলে একসময় পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থার প্রতিই মানুষের আগ্রহ শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর কিংবা প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোটই প্রধান উপায়। আর ভোট বলতে বোঝায় গোপন ব্যালটে স্বাধীন ও নির্ভয়ে নাগরিকের অধিকার প্রয়োগ। অর্থাৎ একাধিক প্রার্থীর মধ্য থেকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনি ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের প্রতিনিধি বেছে নেয়ার সুযোগ হচ্ছে নির্বাচন। এটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার।
সুতরাং যখন কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, তখন সেখানে নাগরিকের এই সাংবিধানিক অধিকারও ক্ষুণ্ন হয়। সেটি স্থানীয় সরকার হোক কিংবা জাতীয় সংসদ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দেড় শ’র বেশি প্রার্থী এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই বিরল।
বাস্তবতা হলো, পুরো নির্বাচন পদ্ধতিটিই এমন করে ফেলা হয়েছে যে, এখন ভোটের আগেই জানা যাচ্ছে যে, কে জয়ী হবেন বা কাকে জয়ী করা হবে?
যদি এটি আগেভাগেই নিশ্চিত হয় যে কে জয়ী হচ্ছেন তাহলে তার সঙ্গে কেউ লড়াই করতে যে কেউ আসবেন না—এটিই স্বাভাবিক। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন ও সমর্থন মানেই তিনি জয়ী। অর্থাৎ তিনি জয়ী হবেন বা তাকে জয়ী করা হবে। পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থাটিই তার অনুকূলে থাকবে।
পক্ষান্তরে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জন্য বরাদ্দ পদে পদে হয়রানি, মামলা, ভোটের দিন পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, ভোটের আগ থেকেই পোলিং এজেন্টদের ভয়-ভীতি দেখানো এবং ক্ষেত্রবিশেষে শারীরিক আক্রমণ।
সুতরাং ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত বা সমর্থিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করা মানে তাকে শুধু একজন শক্তিশালী প্রার্থীর বিরুদ্ধেই লড়াই করা নয়, বরং পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা। এই শক্তি বা হিম্মত যাদের নেই, তারা ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত বা সমর্থিত প্রার্থীর সঙ্গে লড়াই করেন না।
অনেকে শেষ মুহূর্তে মাঠ ছেড়ে চলে যান। কেউ কেউ আপস করেন। যখন এরকম একটি ভয়াবহ প্রবণতা জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার এমনকি বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তখন সেই দেশের নির্বাচন পদ্ধতির আমূল সংস্কারের দাবি তোলাই নাগরিকের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হয়ে ওঠে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক