দেশের অর্থনীতি যখন এমন এক গতিতে ধাবমান যে, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশে পরিণত হবার সম্ভাবনা প্রকট, সে সময় পরিবেশদূষণে বাংলাদেশ ঊর্ধ্বগামীর খবর কোনো সুসংবাদ নয়।
আমাদের মাটি, বায়ুমণ্ডল এবং নদীনালা সবই অত্যন্ত গর্হিতভাবে পরিবেশদূষণের ভারে ন্যুব্জ হয়ে আছে। পেট্রোলচালিত নৌকা ও অন্য সব ইঞ্জিনচালিত জলশকট অনবরত আমাদের জলপথ দূষিত করছে। নদীর ধারেকাছে নির্মল বায়ু বলে কিছু নেই। ঝাঁজালো গন্ধে এখন বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী এবং তুরাগ নদের পানিতে। মানুষের বর্জ্য, ট্যানারির রাসায়নিক বস্তুসমূহ নৌযাননির্গত পেট্রোলিয়াম পদার্থ, প্লাস্টিক কারখানার বর্জ্য ইত্যাদি এসব নদীকে ব্যবহারের অনুপযোগী করে তুলেছে।
১৯৫৮ সালে টলটলে জলের প্রবহমান বুড়িগঙ্গার কথা আমার মনে আছে। গেন্ডারিয়া থেকে মাঝে মাঝেই আমার এক মামার সঙ্গে নদীতে গোসল করতে যেতাম। নদীর পাড়ে বসে বড়শি বাওয়া মাছ শিকারিদের ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকার দৃশ্য এখনও স্পষ্ট মনে আছে। টার্গেট ছিল বৃহৎ বোয়াল মাছ ধরার। সেই প্রবহমান নির্মল স্রোতঃস্বিনী বুড়িগঙ্গার ওপর দিয়ে চোখেমুখে খরবায়ুর ঝাপটা লাগার একটা আলাদা আমেজ ছিল। এখন বুড়িগঙ্গার চারদিক বিশাল অট্টালিকায় ঘেরা, বায়ুপ্রবাহের উদ্দামতা নেই। জল পুকুরের পানির মতো নিশ্চল।
২১ এপ্রিল ২০২১ তারিখের একটি ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয় যে, বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডল পৃথিবীতে সবচেয়ে দূষিত। ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্যতার দিক থেকে পৃথিবীতে দ্বিতীয়। নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক কণা ঢাকার বাতাসে ভেসে বেড়ায়। সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, সিসা ইত্যাদি। এ ছাড়াও PM 2.5 মাপের কণাসমূহ বাতাসে ভেসে বেড়ায়, যা অনায়াসেই ফুসফুসে ঢুকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ সমস্ত ক্ষুদ্র ধূলিকণা নানা ধরনের রোগজীবাণু এবং ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ বহন করতে পারে।
বাংলাদেশে বাতাসে PM 2.5 ধূলিকণার পরিমাণ ৭৭.১০। দ্বিতীয় পাকিস্তান ৫৯.০০ এবং তৃতীয় ভারত ৫১.৯০। এ ছাড়াও ঢাকার বাতাসে ক্রোমিয়াম, পারদ তামা, নিকেল, ম্যাঙ্গানিজ, সিলভার, আর্সেনিক, লৌহ জাতীয় পদার্থ, রুবিডিয়াম, স্ট্রোনিয়াম, জিরকোনিয়াম, মলিবডেনাম ইত্যাদি ধাতুর কণা বিদ্যমান।
সিসা শরীরে বিশেষ করে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত করে। ক্ষতিগ্রস্ত করে অন্ত্রনালী ও বৃক্ক। এতে শিশুদের মস্তিষ্ক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্রোমিয়াম ত্বকে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং আর্সেনিক ত্বকে ক্যানসারের কারণ হতে পারে। পারদ কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ঢাকার চারদিকে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য বৈধ-অবৈধ ইটভাটা বায়ুদূষণের প্রধান কারণ। এদের অধিকাংশই ইট পোড়ানোর জন্য কয়লা বা কাঠ ব্যবহার করে, যা থেকে বিপুল পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়।
বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী এবং তুরাগ নদের তীরে ট্যানারিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার জন্য ব্যবহৃত অপরিশোধিত রাসায়নিক পদার্থ নদীতে ফেলা হয়। দূষিত নদীর জন্য জলে তখন যেকোনো ধরনের জীবের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, বুড়িগঙ্গা নদী এখন মৎস্যশূন্য।
ঢাকার চারদিকে যে অসংখ্য প্লাস্টিক কারখানা গড়ে উঠেছে, সেসব কারখানার বায়ু পরীক্ষা করে ক্ষতিকর মাত্রার বেশ কিছু রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া গেছে, যা ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের শারীরিক ক্ষতির কারণ। সিসা পারদ, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, জিংক ইত্যাদি ক্ষতিকর মাত্রায় পাওয়া গেছে প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি-অধ্যুষিত এলাকার বাতাসে। এই ধাতুসমূহ প্লাস্টিক দ্রব্যসমূহের গায়ে অত্যন্ত আলগাভাবে লেগে থাকে। প্লাস্টিক দ্রব্য উৎপাদনের জন্য ফ্যাক্টরিগুলো প্রধানত পিভিসি ব্যবহার করে থাকে।
পিভিসি দ্রব্যের গায়ে লেগে থাকা ধাতুসমূহ নড়াচড়া করার সময় অনায়াসেই ঝরে পড়ে বাতাসে মিশে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে এ সমস্ত ধাতুর প্রক্রিয়ার ফলে শরীরে ‘রিয়েক্টিভ অক্সিডেটিভ স্পেসিস’ বেড়ে যায় এবং এতে Oxidative Stress সৃষ্টি হয়, যা দেহকোষের অভ্যন্তরে একধরনের কোষীয় অঙ্গানুতে (মাইটোকন্ডিয়্রা) পরিবর্তন ঘটিয়ে এই অঙ্গানুর শ্বাস-প্রশ্বাসের পদ্ধতিতে পরিবর্তন ঘটায়। এতে কোষসমূহের আবরণ ভেদ করে বস্তুর প্রবেশ ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে মাইট্রোকন্ডিয়ার অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট প্রক্রিয়া শরীরে কোনো কোনো অঙ্গানুর এমনই এক ক্ষমতা যে, তা রক্তবাহিত ফ্রি-র্যাডিকেলসমূহ ধ্বংস করে, যা রক্তনালীর ভেতরের তন্তু ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং রক্তনালীর ভেতরের ঝিল্লি ক্ষতিগ্রস্ত করে, রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। এতে হার্ট অ্যাটাক, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতিসাধন করতে পারে। মাইট্রোকন্ড্রিয়ার এই অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কোষের চর্বি, আমিষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঢাকার চারদিকে বিশেষ করে কামরাঙ্গীরচরের প্লাস্টিক কারখানাসমূহ ঢাকার বায়ুদূষণের একটি প্রধান কারণ। প্লাষ্টিক কারখানাগুলোর বাতাসে ধাতু-কণাসমূহের যে মাত্রা পাওয়া গেছে গড় হিসেবে তা সীসা- ৪০.২২, ক্যাডমিয়াম-৩.২৬, নিকেল- ১৮.০৮ এবং জিংক - ১০৩.৬৪।
এই পরিমাণসমূহ স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এতৎসত্ত্বেও কামরাঙ্গীরচর ও পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকার প্লাস্টিক সামগ্রী প্রস্তুতের রাসায়নিক পদার্থ প্রচুর পরিমাণে মজুত আছে। প্রায়ই পুরান ঢাকায় এই রাসায়নিক পদার্থ মজুত থাকার কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটে এবং সম্পদ ও প্রাণনাশের কারণ হয়।
অনতিবিলম্বে ইটভাটাসমূহ সংস্কার না করলে এবং অবৈধ ইটভাটাসমূহ ধ্বংস না করলে বাতাসকে কার্বন ডাই-অক্সাইড দূষণ থেকে রক্ষা করা যাবে না। প্লাস্টিক দ্রব্যাদি নির্মাণের কারখানাসমূহ এখনি সংস্কার করা প্রয়োজন এবং কারখানাগুলো নিরাপদ জায়গায় স্থাপন করা প্রয়োজন। কার্বন ডাই-অক্সাইড অন্যান্য ক্ষতিকারক গ্যাসীয় পদার্থসমূহ এবং বাতাসে ভেসে থাকা কোনো খনিজ যাতে বায়ুমণ্ডল দূষিত করতে না পারে অবিলম্বে এর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
পৃথিবীর জলবায়ু সংরক্ষণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বে ইতোমধ্যে বিশ্বনেতাদের যে সম্মেলন হয়ে গেল, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ২০৩০ সালের মধ্যে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। চীন কয়লার ব্যবহার কমিয়ে কার্বন নিঃসরণ অনেকটাই কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাস্তবে কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী পৃথিবীর ধনী এবং শিল্পোন্নত দেশগুলো বছরের পর বছর কেবল কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতিই দিয়েছে কিন্তু নানা অজুহাতে কার্যত তারা কিছুই করেনি। আমরা অপেক্ষায় থাকব জো বাইডেনের প্রতিশ্রুত কার্বন নিঃসরণ কমানো বাস্তব রূপ লাভ করে কি না তা দেখার জন্য।
লেখক: কবি-প্রাবন্ধিক, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ