বিশ্বব্যাপী প্রাণসংহারী মহামারি কোভিড-১৯-এর ভয়াবহতা তছনছ করে দিচ্ছে। দিশেহারা মানুষ জানে না কবে আবার ফিরে আসবে সেই স্বাভাবিক দিন। চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যেও বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় সংক্রমণভীতি। চরম চাপের মুখে পড়ে স্বাস্থ্য সেবা। এ সময়ে মানুষের চিকিৎসার প্রধান সহায় হয়ে ওঠে টেলিমেডিসিন সেবা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারির সময় চিকিৎসার সেরা বিকল্প এটি, যার মাধ্যমে রোগীরা হাসপাতালের চেয়ে বেশি সেবা পাচ্ছেন এই বিকল্প পন্থায়। মূলত, মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার করে ভিডিও কলের মাধ্যমে রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসকরা কথা বলে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়াটাই টেলিমেডিসিন সেবা।
স্বাভাবিক সময়ে টেলিসেবার কথা ভাবতেই পারেননি অনেকে। করোনা বদলে দিল সেই চিত্র। এখন দূরের গ্রামে বসেও দেখানো যাচ্ছে ঢাকার ডাক্তার। দেশের বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারও উদ্যোগী হয়ে আরও বড় পরিসরে টেলিমেডিসিন সেবা দিতে শুরু করে। ফলে গ্রাম বা প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসরত ধনী-গরিব সকলের জন্যই বিনা মূল্যে সরকারি চিকিৎসকদের কাছ থেকে চিকিৎসা পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
দেশের ৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান টেলিমেডিসিন সেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সরকারের স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩, লাইফস্প্রিং, অর্ক হেলথ লিমিটেড, সিনেসিস হেলথ, টনিক, ডিজিটাল হেলথ, প্রাভাহেলথ প্রভৃতি। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের ফেসবুক মেসেঞ্জারেও চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে ডাক্তারের পরামর্শ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। অনেক চিকিৎসক নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন ভয়েস ও ভিডিও কলে এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ভাইবার ব্যবহার করেও।
দেশের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত চিকিৎসকের কাছ থেকে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্য পরামর্শ নিতে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় ৪৮২টি হাসপাতালে একটি করে মোবাইল ফোন দেয়া হয়েছে। এসব মোবাইল ফোনের নম্বর স্থানীয় পর্যায়ে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চিকিৎসা ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এর সুবিধা পাচ্ছেন চিকিৎসক ও রোগী। এ বিষয়ে ফেনী সদরের স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাসুদ রানা বলেন, করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৫৬,৩৮৫ জনকে টেলিফোনের মাধ্যমে সেবা দেয়া হয়েছে। এই এলাকার কারও শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে কন্ট্রোল নম্বরে ফোন করেন। তাদের অবস্থা বুঝে প্রাথমিকভাবে প্রেসক্রিপশন দেয়া হয়, কয়েকটি টেস্টও করা হয়। পরবর্তী সময়ে করোনা টেস্টের জন্য নোয়াখালীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
করোনা মহামারি শুরুর দিকে অনেক হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা ছাড়া অন্যান্য সেবা যখন মিলছিল না বা প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসক রোগী দেখা বন্ধ করে দেন, তখন চিকিৎসা পরামর্শ পাওয়ার একটি জানালা খোলা ছিল, টেলিমেডিসিন। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, মহামারির সময়ে পুরোপুরি না হলেও রোগীদের একটি অংশের এ পদ্ধতিতে ভালো কাজ করেছে। তবে সব রোগীকে এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব না বা রোগীর মধ্যেও অতৃপ্তি কাজ করে। যেমন কোনো রোগী যদি তার পেটে ব্যথা বা বুকে ব্যথার কথা বলেন সেক্ষেত্রে সরাসরি রোগীর শরীরের অনেক কিছু পরীক্ষা করার থাকে। ফলে তাদেরকে হাসপাতালে শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন।
এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা নেন ঝিনাইদহ সদরের মালা আক্তার। দুই দিন ধরে মাথা ব্যথা ও জ্বর নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত চিকিৎসকের সঙ্গে নিজের শারীরিক অবস্থা নিয়ে আলাপ করেন। প্রথম দিকে টেলিমেডিসিন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারণ টেলিফোনে কার সঙ্গে কী কথা বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তাছাড়া রোগী না দেখে ডাক্তার কী ওষুধ দেবেন বা সেই ওষুধের ওপর কতটা নির্ভর করা যায় তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন। মালার স্বামী জিয়াউল হকের পরামর্শে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তারের সঙ্গে একবার কথা বলে ভুল ধারণা পালটে যায়। ডাক্তার কিছু ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে কোভিড টেস্ট করতে বলেন। পরীক্ষা করে মালা করোনা আক্রান্তের খবর জানতে পারেন। বাড়িতে তার বৃদ্ধা শাশুড়ি ও সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে ডাক্তারের পরামর্শে বাসায় আইসোলেশনে থাকেন এবং নিয়মিত ওষুধ খেয়ে ও ব্যায়াম করে সুস্থ হয়ে ওঠেন ৪২ বছর বয়সী মালা।
টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন এমন অনেকের মধ্যে রাজধানীর মো. হানিফ। সরকারি চাকরিজীবী হানিফ করোনার লক্ষণ অনুভব করায় হাসপাতালে যাওয়া অনিরাপদ ভেবে পরিচিত ডাক্তারের সঙ্গে টেলিফোনের মাধ্যমে শরণাপন্ন হন। তিনি বলেন, কাঙ্ক্ষিত বিশেষজ্ঞকে পেয়ে এবং তার পরামর্শে উপকৃত হয়েছি।
একই ধরনের কথা বললেন ময়মনসিংহের এসকে হাসপাতালের টেলিমেডিসিন সেবাগ্রহীতা করোনার ভলান্টিয়ার ও প্রেস ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী। তিনি বলেন, গত বছর ২৫ আগস্ট রাতে জ্বরে আক্রান্ত হন। পরদিন শরীরে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট এবং পরবর্তী সময়ে খাবারে স্বাদ না পাওয়ায় করোনা উপসর্গ মনে করে চিকিৎসকের সঙ্গে টেলিফোনে পরামর্শ নেন। পরীক্ষা করে করোনা আক্রান্তের রিপোর্ট পান। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. প্রদীপ চন্দ্র করের পরামর্শে ওষুধ ও স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। অসুস্থ অবস্থায় ডাক্তার ফোন করে সব সময় খোঁজখবর নিয়েছেন, যা দ্রুত সুস্থতার জন্য সহায়ক হয়েছে বলে জানান ইউসুফ।
ডা. প্রদীপ চন্দ্র করের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছর আগস্ট থেকে করোনার ভয়াবহ অবস্থার সময় বেশির ভাগ মানুষের কাছে প্রধান ব্যবস্থা হয়ে ওঠে টেলিসেবা প্রযুক্তি। তবে করোনা মারাত্মক রোগ হলেও এ থেকে শতকরা ৮০ জন এমনিতেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। তার মতে, একজন রোগীকে টেলিফোনে গাইড করলে তার মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং দ্রুত সুস্থতার সহায়ক হয়।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৯৬ শতাংশ করোনা রোগী বাড়িতে চিকিৎসা নেন। বাকি ৪ শতাংশের চিকিৎসা নিতে যেতে হচ্ছে হাসপাতালে। বাড়িতে থাকা রোগীদের বড় অংশ টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা পরামর্শ নিচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও কল সেন্টার স্বাস্থ্য বাতায়নের তথ্য অনুযায়ী করোনা মহামারি শুরুর সাত মাসের মধ্যে দেশের প্রায় ৩ লাখ করোনা রোগী এই সেবা পেয়েছেন। টেলিমেডিসিন সেবা নিয়েছেন ২ কোটি ৩৬ লাখ মানুষ। এ সেবা প্রদানে ৪ হাজার ডাক্তার যুক্ত রয়েছেন। তারা বিনা পয়সায় এই টেলিমেডিসিন সেবা দিয়েছেন। ৩৩৩ সহ সরকারের টেলিমেডিসিন সেবায় এসব কল এসেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কল সেন্টার ‘স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩’ করোনায় সংক্রমিত রোগী বা সন্দেহভাজনের কাছ থেকে প্রায় প্রতিদিন ১৫ হাজারের বেশি কল পাচ্ছে। মহামারি শুরুর প্রথম ৯ মাসে অর্থাৎ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত জাতীয় স্বাস্থ্য বাতায়নের টেলিমেডিসিন সেবার হটলাইন ১৬২৬৩ এই নম্বরে ফোন করে ১ কোটিরও বেশি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন।
করোনাকালে আরও একটি মাধ্যম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সুরক্ষা অ্যাপ। এই অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইন-রেজিস্ট্রেশন করে সারা দেশে করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক