মালয়েশিয়ার কুয়ানটন পোর্ট থেকে চায়নার জাহাজ মালমাল ভর্তি করে ছেড়ে শ্রীলংকার হাম্বানটোটায় আসবে, সেখান থেকে পাকিস্তানের বেলুচিস্থানের গোয়াধর পোর্ট হয়ে মায়নামারের কেয়াকপুতে। আর সেখানে মাল খালাস করে রোড ও রেল পথে চলে যাবে চায়নায়। ইন্দো-প্যাসিফিকে এটা চায়নার ছোট একটা নয়া নৌ সিল্ক রুট বা বেল্ট এন্ড রুট। কেয়াকপু তৈরি হচ্ছে, কুয়ানটন উন্নয়ন হচ্ছে, হাম্বানটোটা তৈরি শুধু নয় চায়না লিজও নিয়ে নিয়েছে আর পাকিস্তানের গোয়াধর বন্দর এখন এক অর্থে চায়নার।
চায়না যখন এই পোর্ট গুলো তৈরির কাজ অনেকখানি শেষ করে এনেছে এ সময়টা তারা কিন্তু শুধু পোর্ট তৈরি নিয়ে বসে থাকেনি। চায়না নৌ শক্তিতে অনেক পিছিয়ে ছিলো, তারা ইতোমধ্যে নৌ শক্তিতে গত ২০২০ এ আমেরিকাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। অর্থনীতিতে ধারনা করা হচ্ছে ২০২৮ এ তারা আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে। তাছাড়া এই যে পোর্ট গুলো এখন তারা তৈরি করছে সবগুলোতেই নেভাল বেস করার যাবতীয় কাঠামো তারা তৈরি করেছে। এবং মায়ানামার থেকে পাকিস্তান ও থাইল্যান্ড থেকে শ্রীলংকা অবধি তাদের নৌ শক্তির আওতায় আনার উদ্দেশ্য নিয়েই এগুচ্ছে।
এছাড়া আগের থেকেই সাউথ চায়না সি’র একক আধিপত্য চায়নাই দাবী করে আসছে। তাই সাউথ চায়না সি থেকে শুরু করে ইন্দো Ñ প্যাসিফিক, এমনকি বঙ্গোপসাগরের আধিপত্য নেয়াও চায়নার এই লক্ষ্যের মধ্যে। যেহেতু কেয়াকপু বঙ্গোপসাগরে।
চায়নার এই ইন্দো- প্যাসিফিক এলাকার আধিপত্য এক সময়ে তারা একক আধিপত্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তার উদাহরণ সাউথ চায়না সি। সাউথ চায়না সিতে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনস, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই এর দাবী থাকা সত্ত্বেও চায়না এটা তার একক বলেই দাবী করে-বাদবাকি সকলের দাবী কামানের মুখে উড়িয়ে দিতে চায়।
তাই স্বাভাবিকই গোটা বিশ্বের চিন্তা চায়না নেভাল শক্তি আরো বাড়ালে তারা এক সময়ে ইন্দো প্যাসিফিকে এসে সাউথ চায়না সিতে যে আচরণ করছে, ঠিক একই আচরণ করবে।
কিন্তু এ মুহূর্তে এককভাবে চায়নাকে রুখে দেয়ার ক্ষমতা আমেরিকার নেই। যে কারণে ওবামার আমল থেকে তারাও এর বিপরীতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর এই প্রস্তুতির বড় অর্জন তাদের জন্যে কোয়াড। আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ইন্ডিয়াকে নিয়ে তারা চায়নার এই নৌ পথ দখল ও সামরিক আধিপত্যের বিপরীতে চার শক্তির একটি সামরিক জোট গড়তে যাচ্ছে। অনেকদিন যাবৎ চার শক্তির এই জোটের বিষয়টি আলোচনার পর্যায়ে ছিলো। বলা যেতে পারে ২০১৯ অবধি এটা আলোচনার পর্যায়েই ছিলো।
তবে এই আলোচনার পর্যায়ে থাকা অবস্থায় চায়না যেমন নিজেকে এগিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও মিয়ানমারে পোর্ট সহ নেভাল বেজের কাজ এগিয়ে নিয়েছে। আমেরিকাও বেশ কিছু কাজ করেছে। বাইডেন তখন ওবামার ভাইস, এ সময়ে ওবামা ভিয়েতনাম সফর করেছেন। এবং ভিয়েতনামকে সামরিক সহযোগীতা বাড়ানোর জন্যে তাদের সঙ্গে চুক্তিও করেছে আমেরিকা। সামরিক প্রযুক্তি ও সমারস্ত্র বিক্রি করা শুরু করে তাদের কাছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পরাজিত জাপানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও সামরিক সরঞ্জাম তৈরির ওপর যে বিধি নিষেধ ছিলো সে বিষয়টি তুলে নেয়ায় সাহায্য করে আমেরিকা। জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আবেও পার্লামেন্টে বিষয়টির সুরাহা করে হাত দেন শক্তিশালী সমরাস্ত্র তৈরির কাজে। আর এ কাজটি যে জাপান কত দ্রুত করতে পারে তার প্রমান তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে দিয়েছিলো। আর এখন তো তারা আরো অনেক বেশি প্রযুক্তিতে এগিয়ে।
অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া শেষ অবধি চায়না থেকে সরে এসে আমেরিকাকেই গ্রহন করেছে। আর এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যায় ২০১৮ সালে চায়নার টেলিকম কোম্পানিকে কাজ না দেবার প্রক্রিয়াটি শুরু হওয়ায়। চায়নাও এর বিপরীতে অনেক বেশি ট্যারিফ বসায় অস্ট্রেলিয়ান রফতানি আমদানীতে। এবং তাদের সঙ্গে মূল অর্থনৈতিক আলোচনাও বাতিল করে দেয়। এর বিপরীতে অস্ট্রেলিয়া তার নিজের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা পার্লামেন্টে আইন পাস করে চায়নার বেল্ট এন্ড রোড ইনেসেটিভ অবকাঠামো চুক্তি বাতিল করে।
এর পাশাপাশি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আর্মির অধিকারী দেশ ভারতের জোট নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে টেনে এই সামরিক জোটে আনার চেষ্টা চালাতে থাকে আমেরিকা। যদিও ২০১৯ অবধি অনেকখানি আলোচনা এগিয়ে ছিলো তবে বিষয়টি দ্রুত এগিয়ে যায় চায়না ভারতের লাদাখ আক্রমনের পরে। তাছাড়া সাউথ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে ভারতের একটি অলিখিত জোট ছিলো, কেবল মাত্র পাকিস্তান ছাড়া। ওই অলিখিত জোট থেকে শ্রীলংকাকে অনেকখানি টেনে পাকিস্তানের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ও নেপালের রাজনীতি ও সমরনীতিতে চায়না হস্তক্ষেপের পরে- ভারত দ্রুতই কোয়াডের দিকে এগিয়ে যায়। আর আমেরিকা যে শুধু ভারতকে কোয়াডের সদস্য হিসেবে পেয়েই তাদের দ্বায়িত্ব বা কাজ শেষ করে, তা নয়। তারা ভারতের নেভী থেকে শুরু করে ল্যান্ড ও এয়ারের প্রযুক্তি বদলেও এগিয়ে এসেছে। ভারতের সামরিক প্রযুক্তির একটা বড় অংশ ছিলো সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়েনের। এখন সে সব ক্ষেত্রে আমেরিকা তাদের প্রযুক্তি শুধু দিচেছ না, ভারতের সঙ্গে মিলিতভাবে এফ-১৬ বিমান ও সাবমেরিন সহ অনেক কিছুই তৈরি করতে যাচ্ছে।
এর পাশাপাশি আমেরিকাও জাপান চাচ্ছে সাউথ ইস্ট এশিয়ার কিছু দেশ যেমন ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া এবং ্ইন্দোনেশিয়া কোয়াডের সহযাত্রী হোক।
ইন্দো প্যাসিফিকের এমনকি বঙ্গোপসাগরের আধিপত্য নিয়ে চায়না ও কোয়াড জোট মোটামুটি এমন একটি অবস্থানে এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে।
আর ঠিক এই সময়ে পাঁচ লাখ কোভিড টিকা সৌজন্য হিসেবে দেবার আগেই চায়নার রাষ্ট্রদূত প্রকাশ্যে বাংলাদেশে সকল ধরনের কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভেঙ্গে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে জানিয়ে দিলো, বাংলাদেশ যদি কোয়াডে যায়- তাহলে চায়নার সঙ্গে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক খুবই খারাপ হবে।
ইন্দো-প্যাসিফিক না হলেও ্ইন্ডিয়ান ওসান রিজিওন কান্ট্রি নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ২০১৯ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ওসান রিজিওন কান্ট্রি’র সম্মেলনের প্রধান অথিতি হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, এই এলাকায় পৃথিবীর ৩৪ শতাংশ লোক বাস করে। তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে, জীবন যাত্রার সঙ্গে ইন্দো- প্যাসিফিক এমন কি বে অফ বেঙ্গল জড়িত। তাই এলাকাকে শান্তিপূর্ণ অবস্থান হিসেবেই রাখতে হবে। এর অর্থ দাঁড়ায় কোন একক আধিপত্যের সঙ্গে বাংলাদেশ যাবে না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও তাই।
আর বাংলাদেশ বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে এবং শেখ হাসিনার শাসনামলে সব সময়ই স্বাধীনভাবে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। সেখানে চায়না যদি বাংলাদেশকে পাকিস্তান মনে করে । এবং আজ তার পররাষ্ট্রনীতি, কাল তার অর্থনীতিতে ডিক্টেড করতে চায়, তাহলে চায়না ভুল করবে। তাদের ইতিহাস মনে রাখা উচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে হিটলারের জার্মানি একক ভাবে শক্তিশালী হয়েছিলো। কিন্তু মিত্র শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে সেদিন হিটলার এবং জার্মানীকেই সব থেকে বেশি মূল্য দিতে হয়। তাই কারো ওপর চোখ রাঙানোর আগে যে কোন দেশের উচিত, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া।