বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ঈদে মুঠোভরে পেয়ে নয়, দিয়েও অনেক সুখ

  •    
  • ১৩ মে, ২০২১ ১১:২৬

সবচেয়ে কষ্টের সময় কাটছে শিশু-কিশোরদের। টানা দেড়টা বছর স্কুল, খেলাধুলা, বেড়াতে যাওয়া, বাবা-মায়ের হাত ধরে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করা সব বন্ধ। যারা চাকরি করেন, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় আনন্দ বছরে দুইটা বোনাস পাওয়া। এই দুই বছরে সেই বোনাসের উপরেও চাপ পড়েছে। কেউ পাচ্ছেন, কেউবা অর্ধেক পাচ্ছেন, আর কেউবা পাচ্ছেনই না। কেউ কেউ তো গত দেড়টা বছরে তেমনভাবে কোনো আয়ই করেননি। সেসব মানুষের ঈদ কোথায়?

ছোট একটি মেয়ে বাবা-মায়ের হাত ধরে নিউমার্কেটের পেছনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টোরে গিয়ে সেমাই-ঘি, ডালডা-পোলাওয়ের চাল, বিভিন্ন ধরনের গরম মসলা এবং আরও কিছু জিনিসপত্র কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরত। আর লাইট কনফেকশনারি থেকে কেনা হতো মেয়েটির প্রিয় রাংতা দিয়ে মোড়ানো বিখ্যাত নেশসতার হালুয়া।

এই দিনটি ছিল সেই মেয়েটির কাছে স্বপ্নের একটি দিন। কারণ, এর ঠিক এক দিন পরেই রোজার ঈদ। ঈদের জন্য একটা রঙিন জামা, জুতো, ফিতা, ক্লিপ কেনা হয়েছে। বাকি ছিল শুধু এই বাজারটা। মেয়েটির এখনো মনে আছে ওই নেশসতার হালুয়া কিনতে গিয়ে ওকে কিনে দেয়া হতো হট প্যাটিস, একটা পেস্ট্রি আর কিছু চকোলেট। এই জিনিসগুলোই ছিল মেয়েটির জীবনে অনেক বেশি কিছু পাওয়া। একমাত্র সন্তান হলেও হররোজ এতকিছু সে একসঙ্গে পেত না।

সেই সময়ে অর্থাৎ ৭০-এর দশকে মানুষের হাতভর্তি টাকা ছিল না, বাবা-মায়েরা সন্তানকে দেদার জিনিস কিনে দিতে পারতেন না বা চাইতেন না, এমনকি যাদের বনেদিয়ানা ছিল, তারাও টাকার চমক দেখাতেন না। ঢাকা শহরজুড়েই ভোগবাদিতার কোনো নজির ছিল না। জীবন ছিল সহজ-সরল, আন্তরিক। কাজেই বাবার কিনে দেয়া সেই সামান্য কিছু চকোলেট যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখে ঈদের দিনের জন্য অপেক্ষা করত মেয়েটি।

মাঝে অনেকগুলো ঈদ চলে গেছে। সেই মেয়েটি ছোট থেকে বড় হয়েছে। সংসারের দায়িত্ব এসে পড়েছে তার উপরে। এখন সে আর বাবার হাত ধরে কেনাকাটা করতে যায় না, বরং নিজেই অন্যের জন্য কেনাকাটা করে। সে খুব ভালো করে বুঝতে পারে বড়দের জন্য ঈদটা শুধুই দায়িত্ব। আর ঈদের আনন্দটা ছোটদেরই জন্য। সত্যি এখনও যখন ঈদের কথা ভাবি, চোখের সামনে ভেসে ওঠে শৈশবের সেই ভালোবাসাময় সাদামাটা ঈদ।

আমরা জানি ঈদ মানে আনন্দ, উৎসব ও আয়োজন। তবে গত বছর আর এই বছর ঠিক বিপরীত দুটো ঈদ উদযাপন করছি আমরা। জীবনে এমন বিবর্ণ ঈদ পরপর দুবছর ধরে চলছে। এমনিতেই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনে ঈদের আনন্দ হালকা হয়ে এসেছিল, এর মধ্যে এ রকম নিরানন্দময় ঈদ আমাদের আরও অনেকটাই দূরে সরিয়ে দিল।

অথচ ছোটবেলায় ঈদের দিনটি যত এগিয়ে আসত, আমাদের আনন্দ ততই বেড়ে যেত। শুধু ভাবনা ছিল নতুন কাপড় পরে পাড়া বেড়ানো আর মজার মজার খাবার খাওয়া। আমরা শুধু দুই ঈদেই ভালো কাপড় ও জুতা পেতাম। ঈদে কার জামা কেমন হবে, তা লুকানোর জন্য ছিল পড়িমরি চেষ্টা। অনেক না পাওয়ার মধ্যে ঈদের এই পাওয়াটা ছিল অনেক বেশি কিছু।

সংসারজীবনে এসে দেখলাম ঈদ উপলক্ষে আমার সেই পরিচিত শহরের লোকজনই ফার্নিচার, গয়নাগাটি, শাড়ি, কাপড়, পর্দা, চাদর, হাঁড়ি-পাতিল, ক্রোকারিজ সব আইটেমই কেনাকাটা করে। এমনকি নতুন ফ্ল্যাটও কিনতে দেখেছি। শৈশবের আনন্দময় ঈদের বদলে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম জাঁকজমকে।

সেই মেয়েটির শৈশব-কৈশোরে মধ্যবিত্ত বাসাগুলোতে ঈদের চার-পাঁচ দিন আগে বাসার চাদর, টেবিল ক্লথ, সোফার কভার, পর্দা সব ধোলাই করা হতো। ওই কটা দিন আমাদের বেশ আবরণহীন অবস্থায় থাকতে হতো। সবকিছু ধুয়ে, কড়া করে মাড় দেয়া হতো। পুরোনো জিনিস নতুন করে সাজানোর সে এক অন্যরকম আনন্দ ছিল।

পাড়ার বিভিন্ন বাড়ি থেকে কিছু ফুল, পাতা এনে ঘর সাজানো হতো। তখন ফুলের জন্য কোনো বাজার ছিল না। ঈদ উপলক্ষে আম্মা নেপথলিনের গন্ধমাখা চাদর, কুরুশ কাঁটার টেবিল ক্লথ, ড্রেসিং টেবিলের ঢাকনা বের করতেন। ৭০-৮০-এর দশকে এ রকম ঈদ অভিজ্ঞতা ঢাকা শহরের অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারেরই আছে।

ঈদের দিন ভোর থেকে রান্নার গন্ধে ঘুম ভেঙে যেত- সেমাই, জর্দা, পোলাও, কোরমার গন্ধ। ঘুম থেকে ওঠার আগেই আম্মা টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফেলত। আম্মার বহু শখের ক্রোকারিজগুলো সেদিনই শোকেস থেকে বের করা হতো। বাসার ছেলেরা নামাজ থেকে ফিরে এলে সবাই একসঙ্গে বসে নাশতা খেয়েই নতুন কাপড় পরে বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়াই ছিল ঈদের নিয়ম। অন্যান্য দিন যা যা কিনে খেতে পারতাম না, সামান্য সালামির টাকা দিয়ে তাই খেতাম বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে। রাতের খাবার খেয়েই বসে যেতাম বিটিভির সামনে ঈদের আনন্দমেলা ও নাটক দেখতে।

এই ঢাকা শহরেই মধ্যবিত্ত পরিবারের আজকালের ঈদ এবং আমাদের ছোটকালের ঈদের সবকিছুর মধ্যেই অনেক ফারাক হয়ে গেছে। তখন ঐশ্বর্য ছিল কম কিন্তু আনন্দ ছিল বেশি। আজকালকার শিশুরা এত জামা-কাপড়, এত খেলনা, খাওয়াদাওয়া পায় বলে হয়তো ঈদের জামা-জুতো কেনার আনন্দটা তারা সেভাবে উপলব্ধিই করতে পারে না।

যাহোক, পরপর দুবছর করোনার কারণে প্রায় প্রত্যেকেরই ঈদ আনন্দ অনেকটাই সংকুচিত হয়ে গেছে। কারও কারও জীবন থেকে ঈদ আনন্দ চলেই গেছে। যে পরিবারগুলো প্রিয়জন হারিয়েছে, যে পরিবারগুলো কাজ হারিয়েছে, তারা এখন একেবারেই আনন্দশূন্য।

এ ছাড়া দিনরাত এক করে কেনাকাটা করা, চাঁদরাতে ঘুরে বেড়ানো, বাজি ফোটানো, নতুন কাপড়-আসবাবপত্র-গৃহের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা, ঈদের উপহার দেয়া-নেয়া, গ্রামে যাওয়া, শহরময় ঘুরে বেড়ানো, দেশ-বিদেশে ছুটি কাটাতেও যাওয়া হচ্ছে না।

সবচেয়ে কষ্টের সময় কাটছে শিশু-কিশোরদের। টানা দেড়টা বছর স্কুল, খেলাধুলা, বেড়াতে যাওয়া, বাবা-মায়ের হাত ধরে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করা সব বন্ধ। যারা চাকরি করেন, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় আনন্দ বছরে দুইটা বোনাস পাওয়া। এই দুই বছরে সেই বোনাসের উপরেও চাপ পড়েছে। কেউ পাচ্ছেন, কেউবা অর্ধেক পাচ্ছেন, আর কেউবা পাচ্ছেনই না। কেউ কেউ তো গত দেড়টা বছরে তেমনভাবে কোনো আয়ই করেননি। সেসব মানুষের ঈদ কোথায়?

দেশে অগণিত দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ আজ পেটপুরে খেতে পারছেন না। কোনো কাজ নেই তাদের। দিনে দিনে আরও অনেক মানুষ বেকার হবেন। যেহেতু ঈদের সামাজিক আনুষ্ঠানিকতার ব্যয় অনেকটাই কমে গেছে, কাজেই সচ্ছল মানুষ যদি কিছু দান করেন, তবেই নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের মুখে কিছু হাসি ফুটবে।

অসহায় মানুষ যদি আপনার দেয়া টাকায় দুমুঠো ভাত মুখে তুলতে পারেন বা একজন মানুষও যদি তার বাড়িভাড়ার টাকাটা দিতে পারেন বা ঝড়ে উড়ে যাওয়া চালটা ঠিক করতে পারেন বা একটা গরু-ছাগল কিনতে পারেন, তবে সেটাই হবে সবার জন্য অনেক কিছু পাওয়া।

মাঝখানে অনেকগুলো বছরে রাংতামোড়া নেশসতার হালুয়া খাওয়া মেয়েটিও অনেকটাই বদলে গিয়েছিল। ছোট ছোট প্রাপ্তিতে তার মন ভরত না। এই করোনার কারণে সৃষ্ট অভাব তাকে আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে- যদি ভালোবাসা ও আন্তরিকতা থাকে, তবে খুব ছোট কিছুতেও আনন্দ পাওয়া যায়। শুধু মুঠোভরে পেয়ে নয়, দিয়েও অনেক সুখ পাওয়া যায়। আসুন করোনা আক্রান্ত দেশে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচি। আর সেটাই হবে আমাদের ঈদের আনন্দ। ঈদ মোবারক!

লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

এ বিভাগের আরো খবর