বর্তমান বিশ্বে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র তার প্রতিবেশী বা দূরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যে বাণিজ্যিক বা কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে তার মধ্যে কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বর্তমান গ্লোবালাইজেশনের যুগে কোনো রাষ্ট্রকে কটাক্ষ বা ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। বৈশ্বিক কূটনৈতিক কার্যক্রম যখন বিরাজমান সুসম্পর্কের ভিত্তিতে তখন একটি দেশের অভ্যন্তরে থেকে সেই দেশকে হুমকি দেয়া এবং ভয়-ভীতি প্রদর্শন নিশ্চিতভাবে চরম অপরাধ। আর এ কারণেই বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতকে সবার সামনে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
একটি রাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতিতে কী যুক্ত করবে এবং কী বাদ দেবে তা সেই রাষ্ট্রের একান্ত নিজস্ব বিষয়। সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি চিন্তা করেই মন্তব্য করা উচিত ছিল চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিংয়ের। গণমাধ্যমের সামনে এসে বাংলাদেশকে সতর্ক করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের জোট ‘কোয়াড’-এ বাংলাদেশের অংশগ্রহণ চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ‘যথেষ্ট খারাপ’ করবে।
চীনের এই রাষ্ট্রদূত অবশ্য বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কখনই খুব একটা উদ্যোগী ছিলেন না। বরং বিগত বছরগুলোতে বিতর্কিত বেশ কিছু কাজের জন্য হয়েছেন সমালোচিত। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় শোক দিবসে অর্থাৎ ১৫ আগস্টে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বা ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারকে কোনো শোকবার্তা প্রেরণ করেননি। কিন্তু ১৫ আগস্ট বেগম খালেদা জিয়ার ভুয়া জন্মদিন উপলক্ষে ঠিকই শুভেচ্ছা বার্তা প্রেরণ করেছেন তিনি। এমন একটি কাজের জন্য সমালোচনার শিকার হবার পরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের বেঁচে থাকা কোনো সদস্যকে শোকবার্তা জানাননি এই রাষ্ট্রদূত।
বাংলাদেশের জাতির পিতার শাহাদাতের দিনে শুভেচ্ছা বার্তা প্রেরণের মাধ্যমে তিনি কোন কূটনীতির চর্চা করছেন তা সকলের কাছে স্পষ্ট। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই যে জন্মদিন বেগম খালেদা জিয়ার ওপর চাপিয়ে দিয়ে গেছে, সেই জন্মদিন উদযাপনে শুভেচ্ছা জানানোর মাধ্যমে বাংলাদেশে বসে পাকিস্তানের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্কের বার্তা জানিয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। এ সকল কাজ করার পর আবার বাংলাদেশকে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক নিয়ে শাসিয়ে যাচ্ছেন তিনি! একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে তার এ সকল ঘটনার জন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকেই বাংলাদেশের পক্ষে ছিল না চীন। সর্বদাই তাদের দৃঢ় সম্পর্ক ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মাটি যে রাইফেলের গুলিতে লাল হয়েছে তা ছিল চাইনিজ রাইফেল। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানকে শুধু অস্ত্র দিয়ে নয়, বরং কূটনৈতিকভাবেও সহায়তা প্রদান করেছে চীন। এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও চীন বাংলাদেশকে মেনে নিতে সময় নিয়েছে ৫ বছর। বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ১৬ দিন পর ৩১ আগস্ট সর্বশেষ দেশ হিসেবে চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ নিয়ে চীনের আগ্রহের কেন্দ্রে আসলে কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক নয় বরং ব্যবসায়ীক লাভ রয়েছে। আর বাংলাদেশের প্রতি তার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ও এই ব্যবসায় ক্ষতির কারণেই।
সকলের নিশ্চয়ই মনে আছে, করোনা মহামারি গত বছর তুঙ্গে থাকাকালে চীনের একদল প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করে। এ সময় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পরামর্শ প্রদানের পাশাপাশি চীনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাবও দেয়া হয়। এর মধ্যে একটি প্রস্তাব ছিল করোনা পরীক্ষার জন্য চীন থেকে ফ্রি পিসিআর মেশিন গ্রহণ। যা শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করেনি বাংলাদেশ সরকার। কেননা এই ফ্রি মেশিন দিয়ে পরবর্তী সময়ে বেশি দামে টেস্টিং কিট এবং অন্যান্য দ্রব্য কিনতে বাধ্য করার শর্ত জুড়ে দিয়েছিল চীন, যা গ্রহণ করেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সুতরাং ব্যবসা হয়নি।
এ ছাড়াও বাংলাদেশে হাসপাতালে আরও বেশ কিছু অবকাঠামো উন্নয়নের প্রস্তাবও দেয়া হয়, যার সঙ্গে যুক্ত ছিল কঠিন বেশ কিছু বাণিজ্যিক শর্ত। সে কারণেই তার কোনোটিই গ্রহণ করেনি বাংলাদেশ। এমনকি সর্বশেষ বড় ব্যবসার ক্ষতিটি হয়েছে ভারত থেকে কোভিড ভ্যাকসিন গ্রহণের মাধ্যমে। কেননা বাংলাদেশের ১৭ কোটির টিকার বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা করতে চেয়েছিল চীন। কিন্তু টিকার বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতার কথা বিবেচনায় এনে বাংলাদেশ অক্সফোর্ডের টিকাকে প্রাধান্য দেয়। ফলে বাংলাদেশে একচেটিয়া ব্যবসার বাজার হারানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের এই বাজারের সাফল্য দেখিয়ে বিশ্ববাজারে ব্যবসার পরিকল্পনা মাঠে মারা যায়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত বাণিজ্যিক কারণে চীনের টিকা গ্রহণ করছে বাংলাদেশ। কেননা চীনের টিকা গ্রহণ না করলে ব্যবসার জন্যও দেশটিতে ভ্রমণ করা যাচ্ছে না। ফলে চীনের সঙ্গে ব্যবসায় যুক্ত সকলে এখন বাধ্য হয়ে অপেক্ষা করছে চীনের টিকার।
‘উলফ ওয়ারিয়র’ ডিপ্লোম্যাসি বা আগ্রাসী কূটনীতি বলে একটি বিষয় বেশ আলোচিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। বিশ্বের অনেক ছোট ও দুর্বল রাষ্ট্রে এরই মধ্যে চীন তার চীনের আগ্রাসী কূটনীতি শুরু করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই প্রথম তাদের আগ্রাসী কূটনৈতিক আচরণ দেখা গেল। কিন্তু এই আগ্রাসী আচরণেরও একটি শিষ্টাচার রয়েছে। যা মানেননি চীনের রাষ্ট্রদূত। চীনের এই আচরণের যথোপযুক্ত এবং কার্যকর জবাবও প্রদান করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন। গণমাধ্যমের সামনে এসে চীনের রাষ্ট্রদূত যা বলেছেন এবং ইতোপূর্বে যেই আচরণ তিনি করেছেন তার জন্য ক্ষমা চেয়ে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেয়া উচিত তার। অথবা বাংলাদেশের উচিত তাকে প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনা করা।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।