ছেলেবেলায় দেখতাম কোনো শিক্ষক অবসরে গেলে শিক্ষার্থী এবং সহকর্মীরা তাকে আয়োজন করে বিদায় দিত। সবাই আবেগঘন স্মৃতিচারণ করত, একটি মানপত্র পাঠ করা হত এবং সেটি বাঁধাই করে দেয়া হতো। সঙ্গে শিক্ষক মুসলমান হলে তসবিহ, জায়নামাজ, কোরআন শরিফ, লাঠি ইত্যাদি উপহারও দেয়া হতো। একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক যদি এই মর্যাদা পান, তাহলে শিক্ষকদের মধ্যে যার মর্যাদা সবার ওপরে, সেই উপাচার্যের বিদায় সংবর্ধটনাটা তো জাতীয়ভাবেই হওয়া উচিত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহানের বিদায়টা জাতীয় ইস্যুই হয়েছে, তবে একটু নেতিবাচকভাবে। তার বিদায়ের দিনে বিক্ষোভ হয়েছে, ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে মারামারি হয়েছে। দুই দফায় আট বছর উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের পর তাকে বিদায় নিতে হয়েছে পুলিশ পাহারায়।
মেয়াদের শেষ দিনে তিনি সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৩৭ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন। অবশ্য সে নিয়োগ স্থগিত করে দিয়েছে সরকার। চলছে তদন্ত। একজন উপাচার্যকে নিয়ে যখন পত্রিকায় শিরোনাম হয়, ‘চক্রের পকেটে ৫ কোটি, ভিসি ৫০ লাখ!’ তখন লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়। অবশ্য ড. আব্দুস সোবহানের ন্যূনতম নীতিবোধ আছে বলে মনে হয় না। কথায় বলে ‘চোরের মায়ের গলা সবসময় বড়ই হয়।’ আমাদের যত লজ্জাই লাগুক, ড. সোবহানের লজ্জা আছে বলে মনে হয় না
তিনি বরং তার এই অপকর্মের সাফাই গাইছেন, বলছেন, মানবিক কারণে তিনি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নিয়োগ দিয়েছেন। কিছুদিন আগে মামুনুল হক আমাদের ‘মানবিক বিয়ে’ শিখিয়েছিলেন। আর এবার ড. সোবহান শেখালেন ‘মানবিক নিয়োগ’। নিয়োগ হতে হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, নিয়ম মেনে। এখানে যে মানবিকতার কোনো ব্যাপার নেই, এটুকু নৈতিকতা ড. সোবহান দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে অর্জন করতে পারেননি!
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। সেই মেরুদণ্ডের মাথা হলো বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় হলো শিক্ষার সর্বোচ্চ ধাপ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিই সবার আগ্রহ। সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার ব্যয় নামমাত্র। শিক্ষার মানের দিক থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কেই অনেকে এগিয়ে রাখেন। নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগই এখনও মানের দিক থেকে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাড়িয়ে গেছে। তবে উচ্চব্যয়ের কারণে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এখনও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ এখনও বেশি।
দেশে এখন ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো মানদণ্ডেই বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে পরিচিত, আমাদের সবার গর্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও কোনো রেটিংয়ে আগাতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বললেই আন্দোলন, সংগ্রাম, রাজনীতির ঐতিহ্যই সামনে আসে; শিক্ষা বা গবেষণা নিয়ে গর্ব করার মতো কিছু নেই। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও দশ টাকায় এক কাপ চা, একটা শিঙাড়া, একটা চপ এবং একটা সমুচা পাওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব করেন।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছেন উপাচার্যরাই। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মানে সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তি। একসময় দেশে সম্মানের সর্বোচ্চ আসনটা তাদের জন্যই বরাদ্দ থাকত। উপাচার্য নাম শুনলেই শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসত। সেই দিন পাল্টেছে অনেক আগেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য এখন সরকার নিয়োগ দেয়। আর নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথম বিবেচনা হয় দলীয় আনুগত্য।
বেশ কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগের এক সম্মেলনে দেখি, এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দলীয় কার্ড গলায় ঝুলিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বসে আছেন। অথচ উপাচার্য হিসেবে তিনি সম্মানের অন্য সারিতে বসতে পারতেন। তিনি দলীয় পরিচয়টাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কোনো কোনো উপাচার্য টক শোতে এমনভাবে সরকারের পক্ষ নেন, আওয়ামী লীগ নেতারাও মুখ টিপে হাসেন। কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে মনে হয় ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি। সমস্যার শুরুটা এখানেই।
বিশ্ববিদ্যালয় শুধু যে শিক্ষার সর্বোচ্চ ধাপ তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় হলো একজন শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার শেষ ধাপও। বিশ্ববিদ্যালয় একজন মানুষকে শুধু চাকরি পাওয়ার জন্য কিছু সার্টিফিকেট দেবে না। বিশ্ববিদ্যালয় মানে শুধু কাগুজে উচ্চশিক্ষা নয়; বিশ্ববিদ্যালয় একজন মানুষকে শিক্ষা-দীক্ষা, প্রজ্ঞা, নেতৃত্ব, জীবনবোধ, মানবিকতা, নৈতিকতার উচ্চশিক্ষা দেবে। কিন্তু দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের যে মান, তারা শিক্ষার্থীদের কী শেখাবেন? যাদের নিজেদের নৈতিকতা নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন, শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা শেখানোর নৈতিক অধিকার কি তাদের থাকে? দুঃখটা হলো, আপনি গুগলে ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়’ লিখে সার্চ দিলে শুধু দুর্নীতি আর অনিয়মের খবরই পাবেন।
শিক্ষা-সংক্রান্ত কিছুই পাবেন না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিভিন্ন সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অনিয়ম নিয়ে তদন্ত করেছে। এখনও বেশ কয়েকটি উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অনিয়ম আর তদন্তের ফিরিস্তি দিতে গেলে সেটা মহাকাব্য হয়ে যাবে। তবে উপাচার্যদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো সবই অতি নিম্নমানের দুর্নীতি।
এক উপাচার্য বছরের পর বছর ক্যাম্পাসে যান না। ঢাকায় বসেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় চালান। মাঝে মধ্যে বিমানে গিয়ে আবার দ্রুততম সময়ে ফিরে আসেন। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দিনের পর দিন আন্দোলন করছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। আন্দোলন দেখার জন্যও তিনি যান না। একবার উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন শুনে শিক্ষকরা গেল তার সঙ্গে দেখা করতে। তিনি পেছনের দরজা দিয়ে চোরের মতো পালিয়ে চলে এলেন!
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী উপাচার্য ড. সোবহান শুধু যে মেয়াদের শেষদিনে বিধিবহির্ভূতভাবে ১৩৭ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন তাই নয়, এর আগেও মেয়ে আর মেয়ে জামাইকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নির্লজ্জতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের ধরনগুলো একটু দেখে আসি চলুন- নির্মাণকাজে অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, ক্যাম্পাসে না থাকা, ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির ঘটনা ধামাচাপা দেয়া, নিয়ম না মেনে ঢালাও জনবল নিয়োগ, শিক্ষক ও জনবল নিয়োগে দুর্নীতি, ইচ্ছামতো পদোন্নতি, কেনাকাটায় অনিয়ম। অভিযোগের যা ধরন, তাতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নয়, তদন্তটা করা উচিত দুর্নীতি দমন কমিশনের।
রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যদের অনেকে দায়িত্ব নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের পৈতৃক সম্পত্তি মনে করেন। ‘সরকার কা মাল, দরিয়া মে ঢাল’- মেনে তারা হরিলুটে নেমে পড়েন। পদাধিকারবলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য রাষ্ট্রপতি। বর্তমান আচার্য আবদুল হামিদ অনেকবার উপাচার্যদের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন; তাদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যদের ক্ষমতার হাত যেন রাষ্ট্রপতির চেয়েও লম্বা।
এখন পর্যন্ত অনেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনেক তদন্ত হয়েছে, সুপারিশ হয়েছে; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অভিযোগ গুরুতর বা আন্দোলন তীব্র হলে তাদের সরিয়ে দেয়া হয় বা পদত্যাগের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু আর্থিক দুর্নীতির শাস্তি তো কেবল অপসারণ নয়। অভিযোগের তদন্ত আর সুপারিশে দায়িত্ব শেষ নয়। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে আইনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। অপচয় করা অর্থ ফেরত নিতে হবে।
আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি শেকড় গেড়েছে। কিন্তু শিক্ষার সর্বোচ্চ ধাপ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পড়াশোনা ফেলে যদি দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যায়; তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের সামনে ভয়ংকর অন্ধকার সময় অপেক্ষা করছে। অন্তত আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। শিক্ষার মান যেমনই হোক, অন্তত নৈতিকতার মান যেন উচ্চ হয়। উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে যেন দলীয় আনুগত্যের আগে তার ব্যক্তি চরিত্র বিবেচনায় নেয়া হয়।
বিদায়ের দিনে ড. আব্দুস সোবহানের কেলেঙ্কারিও যেন নিছক তদন্তসর্বস্ব না হয়। তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি। শাস্তির একটা দৃষ্টান্ত না থাকলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুর্নীতির এই মহা উৎসব চলতেই থাকবে। এমন দৃষ্টান্ত লাগবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ দুর্নীতি করার সাহস না পায়। দুর্নীতি নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিরোনামে আসুক শিক্ষার উৎকর্ষের জন্য, গবেষণার মানের জন্য।
লেখক: সাংবাদিক-কলাম লেখক